এ সময়ের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি চাকরির বাজার সম্পর্কে যা জানাচ্ছে
বেসরকারি একটি ব্যাংকের প্রাথমিক পর্যায়ের (এন্ট্রি লেভেল) প্রতিটি পদের বিপরীতে চাকরির আবেদন করেছেন ৬ শতাধিক প্রার্থী। যা সরকারি চাকরি পরীক্ষাগুলোর গড় পরীক্ষার্থী সংখ্যার চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। এই ঘটনা প্রমাণ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনো গ্রাজুয়েটদের জন্য চাকরি জোটানো কতোটা কঠিন হয়ে পড়েছে।
চাকরির আবেদনকারী অনেকেরই রয়েছে ভালো একাডেমিক স্কোর। কিন্তু, এতজনের মধ্যে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতার ভিত্তিতে যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচন করা নিয়োগদাতাদের জন্যও সহজ নয়। তাছাড়া, অনেকের শিক্ষাজীবন উজ্জ্বল হলেও, তারা চাকরির বাজারে নিজেদের প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়।
ব্র্যাক ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক নিয়োগ পরীক্ষায় সেরা-২০ এ রয়েছে জেলা পর্যায়ের কলেজ থেকে স্নাতক পাস কম সিজিপিএ পাওয়া প্রার্থীরা।
অন্যদিকে, বুয়েটসহ স্বনামধন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফলাফল নিয়ে পাস করা প্রার্থীরা প্রাথমিক বাছাই পর্বেই বাদ পড়ে।
বেসরকারি ব্যাংকটিতে ৭০ জন প্রবেশনারী অফিসার বা শিক্ষানবিশ কর্মকর্তার পদে নিয়োগ পেতে আবেদন করে প্রায় ৪৩ হাজার জন। অথচ, গেল বছরের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় সরকারি দপ্তরে এন্ট্রি লেভেলের ১,৮০০ পদের জন্য পরীক্ষা দেন ৪ লাখ ৪৩ হাজার জন। অর্থাৎ, প্রতিটি পদের জন্য ২৪৪ জন পরীক্ষা দেন।
বিপুল চাকরি সন্ধানীর কারণে বেসরকারি নিয়োগকর্তাদেরও প্রতিনিয়ত তাদের মূল্যায়ন কৌশল বদলাতে হচ্ছে। যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে ব্রাক ব্যাংকও নতুন কৌশলে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়।
যেমন- সাক্ষাৎকার মূল্যায়নে 'আচরণগত দক্ষতা কাঠামো' নামের একটি পদ্ধতি চালু করেছে ব্রাক ব্যাংক। আগের চাকরিপূর্ব পরীক্ষা পদ্ধতিগুলোর তুলনায় যা অনেকটাই ব্যতিক্রম।
এই পদ্ধতিতে, জ্ঞান-ভিত্তিক পরীক্ষার বদলে সাইকোমেট্রিক টেস্টের মাধ্যমে প্রার্থীর দক্ষতা বিশ্লেষণ করা হয়।
এই প্রথম দেশের কোনো ব্যাংক এ পদ্ধতির নিয়োগ পরীক্ষা চালু করেছে। এর মাধ্যমে তারা প্রার্থীদের কার্যক্রম পরিচালনা, নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা, সম্পর্ক তৈরির দক্ষতা ও সৃজনশীলতা যাচাই করে।
আলোচিত পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞাপনে উল্লেখকৃত যোগ্যতা ছিল চার বছরের সাধারণ স্নাতক ডিগ্রী। প্রার্থীদের বয়স, একাডেমিক রেজাল্ট বা নামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই হতে হবে এমন কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি। এর পরিবর্তে সারা দেশ থেকে প্রকৃত মেধাবিদের খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রথম ধাপে, ব্র্যাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ৩৫ হাজার আবেদনকারীর একটি অনলাইন পরীক্ষা নেন। এতে উত্তীর্ণ ২ হাজার জনকে পরবর্তী ধাপের জন্য বাছাই করা হয়।
সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পাওয়া এই ২ হাজারের ভেতর যারা সেরা-২০ এ স্থান পান- স্নাতকের ফলাফলে মোট ৫ পয়েন্টের মধ্যে তাদের গড় পয়েন্ট (সিজিপিএ) হলো ৩।
শিক্ষাজীবনের ফলাফলই যে কারো যোগ্যতা ও মেধার প্রাথমিক নির্দেশক নয় এ ঘটনা তাই প্রমাণ করেছে। সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পাওয়াদের মধ্যে ২ শতাংশ ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারী।
ব্র্যাক ব্যাংক জানায়, অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত আইবিএ'র (ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) গ্রাজুয়েট হয়েও সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পাননি। সে তুলনায় সেরা প্রার্থীদের ভেতর শীর্ষস্থান অধিকার করেছেন নোয়াখালী জেলার কম পরিচিত একটি কলেজের শিক্ষার্থী।
ব্যাংকটি বিহেভেরিয়াল এবং ভ্যালু পারফর্ম্যান্স টেস্টের মাধ্যমে শেষ ধাপের জন্য ১০০ জন প্রার্থীকে বাছাই করে। বাছাইকৃতদের গড় বয়স ছিল ২৫ বছর ৬ মাস। অর্থাৎ, যারা সদ্য পাস করেছেন এমন বয়সের প্রার্থীর আধিক্য ছিল। তারা চাকরির পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার পরও সন্তোষজনক দক্ষতার পরিচয় দেন।
নতুন সাইকোমেট্রিক পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় প্রধান আচরণগত দক্ষতা হলো গ্রাহককেন্দ্রিকতা, মালিকানা ও ফল সরবরাহ, সততা, সহযোগিতা ও অন্যদের উন্নয়ন।
ব্র্যাক ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান আখতারউদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'আমরা মানসম্পন্ন কর্মী নিয়োগের লক্ষ্যে আচরণগত দক্ষতার কাঠামো চালু করেছি।'
তিনি বলেন, চাকরিপূর্ব পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্বের জন্য নির্বাচিত প্রার্থীদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। এক বছর প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর তাদেরকে উপযুক্ত বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হবে।
আখতারউদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'আমরা চার বছরের স্নাতক ডিগ্রিধারীদের কাছ থেকে আবেদন চেয়েছি। কোনো বয়সসীমা বেঁধে দিইনি। আমরা বলে দিইনি যে, সিজিপিএ ৩.৫ হতে হবে বা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হতে হবে। তাই আবেদনকারীর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের প্রশ্নে রিটেইল ব্যাংকিং-সংক্রান্ত পাঁচটি এবং এইচআর [মানবসম্পদ] বিষয়ে দশটি প্রশ্ন ছিল। আর বেশিরভাগ প্রশ্নই ছিল আচরণ-সংক্রান্ত। একে সাইকোমেট্রিক টেস্ট বলা হয়। এই মূল্যায়ন পদ্ধতি এখন সারা বিশ্বে অনুসরণ করা হয়।
'এর অর্থ হলো, প্রার্থীদের একাডেমিক ফলাফলের চেয়ে তারা গ্রাহকদের সঙ্গে কেমন আচরণ করবে, তার ওপর বেশি জোর দিই আমরা।'
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ব্র্যাক ব্যাংক শুরুর পর্যায়ের এই পদের মোট বেতন ৪৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০ হাজার টাকা করেছে বলে জানান আখতারউদ্দিন মাহমুদ। বেতন বাড়ায় বর্তমান জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় বহন করা সহজ হবে।
আখতারউদ্দিন মাহমুদ আরও জানান, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করা চাকরিপ্রার্থীদের ৯০ হাজার টাকার বেশি বেতনে নিয়োগ দেয়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অধিকাংশ আবেদনকারীর প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকে না বলে দেশের প্রায় ৪৬ শতাংশ বেসরকারি নিয়োগদাতা শূন্যপদ পূরণ করতে হিমশিম খায়।
'স্কিলস গ্যাপ অ্যান্ড ইয়ুথ এমপ্লয়মেন্ট ইন বাংলাদেশ: অ্যান এক্সপ্লোরেটরি অ্যানালাইসিস' শিরোনামের ওই গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মী নিয়োগের সময় নিয়োগকারীরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেয়—সফট স্কিল (৮৩% নিয়োগদাতা), হার্ড স্কিল (৬৫% নিয়োগদাতা) ও কাজের অভিজ্ঞতা (৫১% নিয়োগকারী)।
নিয়োগদাতাদের মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সফট স্কিলগুলোর মধ্যে রয়েছে: যোগাযোগ, সময় ব্যবস্থাপনা, সমস্যা সমাধান, দলগত কাজ ও নেতৃত্ব, সমালোচনামূলক চিন্তা, পেশাদার নেটওয়ার্কিং দক্ষতা ও সৃজনশীলতা।
তাদের মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হার্ড স্কিলগুলো হলো: কম্পিউটার দক্ষতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও নির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান, ইংরেজি ভাষার দক্ষতা, অপারেশনাল দক্ষতা, ব্যবসায়িক দক্ষতা, সংখ্যাজ্ঞান ও গাণিতিক দক্ষতা, সাধারণ জ্ঞান এবং চলতি ঘটনা সম্পর্কে সচেতনতা।
সিপিডি ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমপক্ষে ৫০০ জন শিক্ষার্থী এবং সদ্য স্নাতকদের ওপর সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় মূলত তাদের দক্ষতা মূল্যায়ন করা হয়। দেখা গেছে, সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা সর্বোচ্চ গড় নম্বর পেয়েছেন 'সৃজনশীলতায়', আর সর্বনিম্ন গড় নম্বর পেয়েছেন 'যোগাযোগ, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা, সংখ্যাজ্ঞান ও গাণিতিক দক্ষতায়'।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'বাজারের চাহিদা এবং স্নাতকদের দক্ষতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পাস করা গ্র্যাজুয়েটরা তাদের দক্ষতা কাজে লাগাতে পারছেন না।'
তিনি আরও বলেন, 'আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শ্রমবাজারের চাহিদা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। তবে আমাদের পর্যাপ্ত বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণকেন্দ্রের অভাব রয়েছে।'