নির্বাচন কমিশন গঠন: নেপাল, ভূটান পাকিস্তান কী করে, বাংলাদেশে কী করছে?
শুক্রবার পর্যন্ত মাত্র দুটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে চলমান সংলাপ শেষ করেছে। সংলাপ ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গন এখন বেশ সরগরম। নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এই সংলাপ চলবে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। নির্বাচন কমিশন পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ পাবেন। আগামী ২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব পড়বে নতুন কমিশনের উপর। সে-কারণে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব কারা পেতে পারেন তা নিয়ে মানুষের কিঞ্চিৎ আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে একটি সার্চ কমিটির রূপরেখা তৈরি করা হবে, যারা পরবর্তী নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যোগ্য কিছু মানুষের তালিকা প্রস্তুত করবেন। প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনা ও পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কমিশনার নিয়োগ দেবেন। কমিশনার হিসেবে কারা যোগ্য হবেন তা এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট করা নেই। কমিশনার হিসেবে কারা যোগ্য হবেন বা কারা যোগ্য হবেন না, তা একটি আইনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট করে নেবার নির্দেশনা আমাদের সংবিধানে রয়েছে।
আমাদের সংবিধানের বয়সও প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চললো। সংবিধানের এই নির্দেশনা গত ৫০ বছর যাবত উপেক্ষিত থেকেছে। নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত ইতিহাসের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে ২০০৬ সালের মত নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়াও ঘটেছে আমাদের দেশে। ক্ষমতাসীন বিএনপি একজন কর্মরত বিচারপতিকে দিয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রধান করেছিল। একই ব্যক্তি একই সময় দুইটি সাংবিধানিক দায়িত্বে থাকা, এটা সংবিধান লঙ্ঘনের সামিল। তারপরও এ ঘটনা ঘটেছে এবং এটা নিয়ে ঐ দলের পক্ষ থেকে রাজনৈতিকভাবে কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। আজিজ কমিশনের প্রধান, বিচারপতি আজিজ ২০০৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি'র কাছে মনোনয়ন প্রার্থনা করেছিল, যদিও বিএনপি তাকে মনোনয়ন দেয়নি।
অর্থনীতি সমিতির সম্মেলনে দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রেহমান সোবহান দেশের প্রতিটি পর্যায়ের নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও যে হারে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে তা উদ্বেগজনক। তবে রেহমান সোবহানের কথার সাথে যুক্ত করে বলা যায়, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্বলতা কাটাতে পারবে না। নির্বাহী বিভাগের কাছে রক্ষিত একক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা না গেলে পরিস্থিতির উন্নতি আশা করা যায় না।
চলতি কমিশনের বিদায় ও নতুন কমিশনের আগমনের সময়ে সংবিধান নির্দেশিত আইন প্রণয়নের বিষয়টি সামনে আসে। সকল রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করছে, কেন তারা নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আইনটি করছে না। একটানা তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা ক্ষমতাসীনদের দিকে সমালোচনার তীরটি যাবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যারা বড় গলায় সমালোচনা করছেন, তারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন কেন আইনটি করা হয়নি, তা স্পষ্ট করে বলছেন না। সব সময়, সব সরকার নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করতে চেয়েছে বা বাড়তি সুবিধা নিতে চেয়েছে, ক্ষমতা আরোহনের সোপান হিসেবে। আমাদের এখানে গণতন্ত্র তেমন বিকশিত না হওয়ার জন্য প্রায়শই অনেককে হতাশা ব্যক্ত করতে শুনি, কিন্তু কেউ এই স্বীকারোক্তিটুকু করেননি, যে আমরা ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে আইনটি না করে ভুল করেছি এবং এই ভুল নির্বাচন কমিশনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের নামান্তর। গণতন্ত্রের সৌন্দর্ষ এখানেই; এভাবেই গণতন্ত্র বিকশিত হয়।
আশার কথা, এখন ক্ষমতাসীনরাও স্বীকার করেন, এত দিনে আইনটি না হওয়া দুঃখজনক। আগামী বছর আইনটি করা হবে বলে ক্ষমতসীন দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সেদিক বিবেচনায় এবারের সংলাপ আয়োজনের মধ্য দিয়েই নির্বাচন কমিশনের জন্য 'যোগ্য' লোক অনুসন্ধানের পর্বটি শেষ হতে চলেছে। ভবিষ্যতে আর কোন রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন কমিশন প্রশ্নে সার্চ কমিটি গঠনের জন্য ধারাবাহিক সংলাপে বসতে হবে না।
এবারের সংলাপে অংশ নেওয়া একটি দল সার্চ কমিটির জন্য মুখ বন্ধ খামের মধ্যে ৫ জন ব্যক্তির নাম রাষ্ট্রপতির হাতে দিয়েছেন। পরেরদিন খবরের কাগজের মাধ্যমে জানলাম, সংলাপে অংশ নেওয়া প্রতিনিধি দলের অন্যতম নেতা যিনি ঐ দলেও গুরুত্বপূর্ণ নেতা, তিনি নিজের স্ত্রীর নাম দিয়েছেন, সার্চ কমিটি যেন কমিশনার হিসেবে (নেতার স্ত্রী) বিবেচনা করে। এটা সকল জায়গায় দলীয় আধিপত্য বিস্তার চেষ্টার অংশমাত্র। অনুমান করা যায়, কেন এত বছরে আইন করে স্বাধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন তৈরি করা যায়নি।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৯ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন, ভোটার তালিকা তৈরি, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ, সকল স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচন ও আনুষঙ্গিক কার্যাদির সুষ্ঠু সম্পাদন কমিশনের দায়িত্ব। কমিশন স্বাধীন এবং কেবল সংবিধান ও আইনের অধীন হবেন। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল কর্তৃপক্ষের কর্তব্য।
অনুচ্ছেদ ১১৮(১) একটি আইন প্রণয়ন করে নির্বাচন কমিশনের যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। ফলে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইন করতে হবে সেটা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু এই আইন তৈরি হলেই নির্বাচনের প্রতি মানুষের যে সীমাহীন আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে তা কি দুর হবে? মানুষ তার পছন্দমত ভোটটি দিতে চায় এবং সে তার ভোটের যথাযথ প্রতিফলন দেখতে চায়। রাজনৈতিক দলগুলো যে কোন উপায়ে নির্বাচন কমিশনের উপর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব জারি রাখবার প্রবণতা মানুষকে নির্বাচন বিমুখ করে তুলেছে।
আমাদের পাশের দেশ ভারত। সেখানকার রাজনৈতিক আবহাওয়া ও সংস্কৃতি আমাদের কাছাকাছি। ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো আমাদের চেয়ে মজবুত হওয়া সত্বেও সেখানে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। রাজনৈতিক হিংসা-বিদ্বেষ ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য বিনষ্ট করছে। তারপরও আয়তন ও জনসংখ্যার বিচারে ভারত বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সেখানকার নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ অনেকটা আমাদের মতোই। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের পরামর্শ অনুযায়ি রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন। কমিশনের অপসারণ উচ্চ আদালতের বিচারপতির অপসারণ পদ্ধতির অনুরূপ। ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের কাঠামো সংস্কারের সাম্প্রতিক একটি উদ্যোগ উচ্চ আদালতে আটকে গেছে। সাংবিধানিক প্রশ্ন মীমাংসার জন্য ভারতীয় উচ্চ আদালতে বেঞ্চ নির্দিষ্ট করা রয়েছে।
ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল ৩২৪ নির্বাচন কমিশনকে স্বতন্ত্রতা দিয়েছে। আর্টিকেল ৩২৪ এর প্রয়োগের অর্থ হলো, ওখানকার পুলিশসহ বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্ব নির্বাচন কমিশনের অধীনে নেওয়া। ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশন ও তাঁর অধীনেই (১৯৯০ থেকে ১৯৯৬) ভারতের নির্বাচনের সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসেন। অনেকে তাকে 'চেঞ্জমেকার'বা পরিবর্তনের রূপকার হিসেবে চেনেন। নির্বাচন ব্যবস্থাকে আমলাতান্ত্রিকতা ও রাজনীতিকদের একাধিপত্য থেকে মুক্ত করেছিলেন। পুলিশ-প্রশাসনের ওপর কমিশনের কর্তৃত্ব ধরে রেখে আইন শৃঙ্খলা ও নির্বাচনী স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। ভারতের নির্বাচনগুলোর প্রতি মানুষের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ প্রমান করে সেখানকার নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা রয়েছে।
আমাদের প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান এমনকি পাকিস্তানেও নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের জন্য আইন রয়েছে। নেপালে সরকারি দল, সংসদের বিরোধী দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নিয়ে সেখানে কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল রয়েছে। কাউন্সিল বসে একটা খসড়া তালিকা প্রকাশ করে। প্রকাশিত তালিকার ব্যাপারে কারো কোন অভিযোগ থাকলে তা জানাতে পারে। সেখানকার আইনে গণশুনানির বিধান রয়েছে। এরপর তালিকা যায় সংসদে। সংসদ তালিকা চুড়ান্ত করলে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন।
সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য ভূটানে পার্লোমেন্টের উচ্চকক্ষের চেয়ারম্যানের নেতুত্বে একটি পর্যদ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, নিম্নকক্ষের স্পিকার ও বিরোধীদলের নেতা এই পর্যদের সদস্য। পর্যদের সুপারিশ অনুযায়ি সেখানকার রাজা নির্বাচন কমিশন নিয়োগ প্রদান করেন।
উপমহাদেশের আর এক দেশ পাকিস্তানের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১৩ এর ধারা (২এ) এবং (২বি) নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ ও ক্ষমতা স্পষ্ট করে দিয়েছে। কমিশন নিয়োগের জন্য পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ১২ সদস্যের একটি সংসদীয় কমিটি রয়েছে। সংসদীয় কমিটির অর্ধেক সরকারি দল হতে বাকি অর্ধেক বিরোধী দল হতে নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার সাথে আলোচনা সাপেক্ষে একটা প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করে সংসদীয় কমিটিতে পাঠান। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দল ঐকমত্যে আসতে না পারলে দুই জন আলাদাভাবে সংসদীয় কমিটিতে নাম দিতে পারেন। সংসদীয় কমিটি সেখান থেকে নাম চুড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠায়। এখানে ১২ জনের সংসদীয় কমিটির অর্ধেক (৬জন) সরকারী দলের হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর 'ইচ্ছারই' প্রতিফলন ঘটে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে উন্নয়ন সূচকের অনেকগুলোতে আমরা এগিয়ে। আমরা খাদ্যমান, পুষ্টি, আমিষের ব্যবহার, মাতৃমৃত্যু রোধ, নিরাপদমাতৃত্ব, মানুষের গড় আয়ু ও আয়, দারিদ্র পরিস্থিতির উন্নয়ন, জিডিপি'র প্রবৃদ্ধিতে আমরা অন্যদের তুলনার এগিয়ে। এই ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থেই ঐকমত্যের প্রতিবন্ধকতাগুলো দুর করতে হবে। রাজনীতির বস্তুগত ও কাঠামোগত সংস্কারগুলো দ্রুত সম্পন্ন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক ধারা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আমাদের আগামী নির্বাচন কমিশনের অন্যতম কাজ হবে নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা। নির্বাচনের প্রতি আস্থা কেবল একটি ভোট নয়। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নাগরিক প্রজাতন্ত্রে তার অংশীদারিত্বের জানান দেয় এবং প্রজাতন্ত্রের প্রতি মালিকানার বোধ সৃষ্টি হয়। বোধের এই বন্ধন আগামীর পথ দেখাবে।