গভীর সমুদ্রবন্দরের মতোই কাজ করছে মাতারবাড়ির জেটি
কক্সবাজারের মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে গত ১ বছরে প্রায় ৬১ হাজার ২০০ মেট্রিক টন পণ্য খালাস হয়েছে। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আনা এসব কাঁচামাল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হলে শিপিং ডেমারেজ, খালাস এবং লাইটার জাহাজে পরিবহনে অতিরিক্ত খরচ হতো ৩৫ লাখ ৮৮ হাজার ইউএস ডলার।
মাতারবাড়ি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিজস্ব ২টি জেটির মাধ্যমে খালাস হওয়ায় বিশাল অংকের এই টাকা সাশ্রয় হয়েছে বিদ্যুৎ প্রকল্পের।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, মাতারবাড়ি চ্যানেলের জেটিতে ইন্দোনেশিয়া থেকে বিদ্যুৎ প্রকল্পের ৭৩৬ টন যন্ত্রপাতি নিয়ে ভেনাস ট্রায়াম্প নামে প্রথম জাহাজ ভিড়ে ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর। এরপর ২০২১ সালের ১৫ জুলাই সিঙ্গাপুর থেকে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের যন্ত্রপাতি নিয়ে মাতারবাড়ির দ্বিতীয় জেটিতে জাহাজ ভিড়ে।
প্রাথমিকভাবে বিদ্যুৎ প্রকল্পের মালামাল আমদানির জন্য জেটি নির্মাণ করা হলেও পরবর্তীতে ওই জায়গায় মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২৫ সালে নির্মাণকাজ শেষ হলে মাতারবাড়ি বন্দরের টার্মিনালে ভিড়তে পারবে ১৮ মিটার গভীরতার জাহাজ।
এই বন্দরে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহন ছাড়াও ভারতের সেভেন সিস্টার খ্যাত ল্যান্ডলক এরিয়া আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও নেপাল, ভুটান এই বন্দরের মাধ্যমে উপকৃত হবে। ভারতের কলকাতা ও হলদিয়া থেকে ফিডার জাহাজে করে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবে। ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় ভারত, নেপাল, ভুটানের কনটেইনার বা কার্গোই শুধু আসবে না, মাতারবাড়ি থেকেই কলকাতা, হলদিয়াসহ কাছের বন্দরগুলোতে ফিডার সার্ভিস চালু হয়ে যাবে। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে বাংলাদেশ।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি আনতে ২০১৫ সালের আগস্ট থেকে জেটি নির্মাণের কাজ শুরু হয়। তৈরী করা হয় ২৫০ মিটার প্রস্থ, ১৮ মিটার গভীরতা এবং ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল বা প্রবেশপথ। গভীর সাগর থেকে জাহাজগুলো চ্যানেল দিয়ে জেটিতে প্রবেশের জন্য বসানো হয়েছে পথনির্দেশক ছয়টি বয়া।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে বার্থিং পেতে বহির্নোঙ্গরে একটি জাহাজকে ৫ থেকে ৭ দিন অপেক্ষা করতে হয়। সেক্ষেত্রে জাহাজের আকার অনুযায়ী ৮ থেকে ১০ হাজার ডলার শিপিং ডেমারেজ দিতে হতো শিপিং এজেন্টদের। প্রতিটি জাহাজের ১ দিনের জন্য ১০ হাজার ইউএস ডলার হিসাবে ৫ দিন অপেক্ষার জন্য ৫০ হাজার ডলার শিপিং ডেমারেজ দিতে হতো।
কিন্তু মাতারবাড়ি জেটিতে কোন অপেক্ষা ছাড়াই সরাসরি জাহাজ ভিড়তে পারছে। ফলে শিপিং ডেমারেজ বাবদ একটি জাহাজের গড়ে ৫০ হাজার ইউএস ডলার সাশ্রয় হচ্ছে। সেই হিসেবে গত ১ বছরে ৫৩টি জাহাজে শুধুমাত্র শিপিং ডেমারেজ বাবদ বিদ্যুৎ প্রকল্পের সাশ্রয় হয়েছে ২৬ লাখ ৫০ হাজার ইউএস ডলার।
বন্দরের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতি মেট্রিক টন পণ্য খালাসে ব্যয় হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। মাতারবাড়ি জেটিতে এই খরচ নেমে এসেছে ৪০০ টাকায়। প্রতি টন পণ্য খালাসে খরচ কম হয়েছে ৮০০ টাকা। সেই হিসেবে ৬১ হাজার ২০০ মেট্রিকটন পণ্য খালাসে সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার ইউএস ডলার। বিদ্যুৎ প্রকল্পের যেসব যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে তা সড়কপথে পরিবহনের কোন সুযোগ নেই। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সমুদ্রপথেই সেগুলো লাইটার জাহাজে পরিবহন করতে হতো।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান টিবিএসকে বলেন, "মাতারবাড়িতে গভীর বন্দর নির্মাণের আগেই বিদ্যুৎ প্রকল্পের দুটি জেটিতে ১ বছরে ৫০ এর অধিক জাহাজ ভেড়ানোকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখছি। সরাসরি প্রকল্প এলাকায় পণ্য আনলোডিংয়ের কারণে পণ্য পরিবহন ব্যয় কমে গেছে। ডেমারেজ চার্জ না থাকায় জাহাজের ফ্রেইট চার্জও কমেছে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ প্রকল্প ব্যয়ে। এটি ব্যবস-বাণিজ্যের জন্য খুবই ইতিবাচক সংবাদ।"
মাতারবাড়িতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের 'মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ারড পাওয়ার প্রজেক্ট' বাস্তবায়ন করছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড। ২০১৪ সালে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। পরবর্তীতে সংশোধন করে প্রকল্পের ব্যয় ৫১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী বেসরকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের যুগ্ম সচিব (অপারেশন) আতাউল কবির রঞ্জু টিবিএসকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে লাইটার জাহাজযোগে মাতারবাড়িতে প্রতি মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন ভাড়া ৫১৮ টাকা। সেই হিসাবে ৬১ হাজার ২০০ মেট্রিক টন পণ্যের পরিবহন ভাড়া ৩ কোটি ১৭ লাখ ১ হাজার ৬০০ টাকা বা ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৬২৩ ডলার।
মাতারবাড়ি জেটিতে তেল এবং কয়লা পরিবহনের জন্য পৃথক দুটি জেটি রয়েছে। বর্তমানে এই দুটি জেটিতেই বিদ্যুৎ প্রকল্পের মালামাল খালাস হচ্ছে। ২০২৪ সালে বিদ্যুৎ প্রকল্প উৎপাদনে যাবে। প্রকল্পের কাঁচামাল কয়লাবাহী প্রথম জাহাজ ভিড়বে ২০২৩ সালে। ওই সময়ে ১৪ মিটার ড্রাফটের ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ডিডব্লিউওটি ধারণক্ষমতার বড় জাহাজ ভিড়বে। সেটি হবে এই প্রকল্পের জন্য বিশাল মাইলফলক।
কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বর্তমানে বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ ৫২ শতাংশ শেষ হয়েছে। দুটি জেটি থাকায় খুব দ্রুত আমদানিকৃত পণ্য খালাস করতে পারছি। সরাসরি প্রকল্প এলাকার জেটিতে জাহাজ ভিড়ানোর কারণে সময় এবং অর্থ দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে।"
দেশের মোট বাণিজ্যের ৯২ ভাগ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সম্পন্ন হয়। যে গতিতে ব্যবসার প্রবৃদ্ধি বাড়ছে চট্টগ্রাম বন্দর তার সক্ষমতার শেষ পর্যায়ে এসে গেছে। তাই সরকার ২০১৪ সালে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর কনসালট্যান্টের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ১৬ নভেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্প উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পটি এখনো ভূমি অধিগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
গভীরতা কম হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ৯ দশমিক ৫ মিটারের বেশি গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারে না। এ কারণে ফিডার ভ্যাসেলের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে কন্টেইনারবাহী পণ্য পরিবহন হয়। এসব জাহাজে করে প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর, মালিয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং, চীন, কলম্বোর বন্দর হয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নেওয়া হয়। একইভাবে আমদানি পণ্যও এসব বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসা হয়। এছাড়া মাদার ভেসেলগুলো বহির্নোঙ্গরে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে খোলা পণ্য খালাস করে।
বন্দর জেটিতে গড়ে প্রতিটি জাহাজে ১ হাজার ৮৭৮ টিইইউস কনটেইনার পরিবহন হয়। মাতারবাড়ি বন্দরে ৮ থেকে ১০ হাজার কন্টেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। যেটি বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়া কন্টেইনার জাহাজের প্রায় ৫ গুণ। মাতারবাড়ি চ্যানেলের গভীরতা বর্তমানে ১৬ মিটার। তা সাড়ে ১৮ মিটারে উন্নীত করা হবে।