‘বাল্যবিবাহের হার শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে আদর্শ জেলা কুড়িগ্রাম’
বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ মুক্ত করার স্বপ্ন পূরণে জেলা প্রশাসনের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন একটি শক্তিশালী হাতিয়ার এবং কুড়িগ্রামের সাফল্য এই স্বপ্নযাত্রায় হতে পারে সকল জেলার জন্য আদর্শ। তবে, লক্ষ্য পূরণে সকল অংশীদারকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সমন্বিত উপায়ে কাজ করে যেতে হবে।
শনিবার কুড়িগ্রামে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত "বাল্যবিবাহ মুক্ত কুড়িগ্রাম, একটি স্বপ্নের পথে যাত্রা" শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এমনটা বলেন।
বাংলাদেশে অবস্থিত সুইডেন দূতাবাসের সহায়তায় "বিল্ডিং বেটার ফিউচার ফর গার্লস (বিবিএফজি)" প্রকল্পের আওতায় এই গোলটেবিল আয়োজন করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এবং স্থানীয় পার্টনার আরডিএস বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক ব্যাধি কমানোর লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণে কুড়িগ্রামে বাস্তবায়িত জেলা কর্মপরিকল্পনা একটি অনুসরণীয় উদাহরণ। বাল্যবিবাহের হার শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে আমরা সবাই একত্রে কাজ করেছি, এবং ভবিষ্যতেও করবো।"
অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন বিবিএফজি প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোঃ নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, "২০১৭ সালে কুড়িগ্রামে বাল্যবিবাহের হার ছিল ৬৫ শতাংশ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে একটি মধ্যবর্তীকালীন মূল্যায়ন করা হয়। তখন বাল্যবিবাহের এ হার ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসে। আমরা কুড়িগ্রামে প্রতি মাসে বাল্যবিবাহের তথ্য সংগ্রহের একটি পদ্ধতি দাঁড় করিয়েছি। সেখানে দেখা যায়, ২০১৯ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৯৪টি বাল্যবিবাহ হচ্ছিল। ২০২১ সালে এ সংখ্যা কমে ৩১ হয়।"
তিনি আরো বলেন, "২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের লক্ষ্য রয়েছে। বাল্যবিবাহ রোধে তিনটি কাজ করতে হবে। সেগুলো হলো: বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি শক্তিশালী করা, সমাজের মানুষকে সচেতন করা ও বাল্যবিবাহের শিকার নারীদের যুক্ত করা। আইনের বাস্তবায়ন ও পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাওয়ার পরেও গোপনে বিয়ে দেওয়া কিংবা প্রেমের বিয়ের মত ঘটনা এখনো ঘটছে। আইনের আরো যথার্থ প্রয়োগও অন্যতম চ্যালেঞ্জ। দেশে বাল্যবিবাহ বন্ধে আইনের সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি আমাদের আচরণের পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া দরকার।"
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে শক্তিশালী ডাটাবেজ তৈরির উপরও জোর দেন তিনি।
অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার উৎপল রায় জানান, "নিবন্ধন ছাড়াই বিয়ে দিয়ে দেওয়ার ঘটনা আমরা দেখতে পাই। থানা-পুলিশের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরব ভূমিকা রয়েছে, আমাদের হেল্পলাইন নম্বরে তথ্য পাওয়ামাত্র আমরা দ্রুত সাড়া প্রদানে সচেষ্ট থাকি।"
স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক জিলুফা সুলতানা জানান, অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার ফলে মেয়েদের জীবনে এক বীভৎস অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হয়।
তিনি বলেন, "ঝুঁকিপূর্ণ মেয়েদের চিহ্নিত করা একটি অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। ডাটাবেজ থাকলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের কাজ সহজ হয়।"
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উত্তম কুমার রায় জানান, "মাঠ পর্যায়ে কোন বিয়ে সাময়িকভাবে বিয়ে ঠেকাতে পারলেও পরবর্তীতে কোন না কোনভাবে সেই বিয়ে হয়ে যায়। গোপনে নানাভাবে বাল্যবিবাহের ঘটনা এখনও ঘটছে। এটা একটি চ্যালেঞ্জ। বাল্যবিয়ে হওয়ার ২ বছর পর্যন্ত মামলা করার সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগ গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে। করোনাকালে তথ্য পাওয়াটাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।"
গোলটেবিল আলোচনায় আরো অংশ নেন রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরে তাসনিম, চিলমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মাহবুবুর রহমান, কুড়িগ্রামের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর-এর উপ-পরিচালক শাহানা আক্তার, কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি মোঃ আহসান হাবিব নিলু, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ হারুন-অর রশিদ, ভুরুংগামারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ নুরুন্নবী, কুড়িগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক মোঃ রাশেদুজ্জামান বাবু, বিবাহ নিবন্ধক সমিতির সভাপতি মোঃ নূরুজ্জামান, উলিপরের নতুন অনন্তপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ নুরন্নবি সরকার, ঘোগাদহ মালেকা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মালেক, মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সংস্থা-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোঃ জালাল উদ্দীন, চিলমারীর যুব ফোরামের সদস্য মিজানুর রহমান, ছিনাই যুব ফোরামের সদস্য সম্পা দত্ত, একাত্তর টিভি'র জেলা সংবাদ প্রতিনিধি জনাব রাজু মোস্তাফিজ, প্রথম আলো পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি জনাম শফি খান।
আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন আরডিআরএস বাংলাদেশ-এর আব্দুল আল মামুন এবং সূচনা বক্তব্য রাখেন মেসবাহুন্নাহার।
আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা কমিউনিটি পর্যায়ে সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামি দূরীকরণের উপর জোর দেন। তারা বলেন, প্রযুক্তিগত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জও যুক্ত হয়েছে। এগুলো শক্ত হাতে মোকাবেলা করা জরুরি। পাশাপাশি প্রয়োজন যথাযথ নজরদারিও।
বিবিএফজি প্রকল্পটি কুড়িগ্রাম জেলার ৯টি উপজেলা, ৩টি পৌরসভা, ৭৩টি ইউনিয়ন পরিষদে কাজ করছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহের সংখ্যা ১৮ বছরের নিচে এক–তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা এবং ১৫ বছরের নিচে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য।