চোখ যে বয়সের কথা বলে!
কবি সাহিত্যিকদের লেখায় 'চোখকে কেবল মনের জানালা' হিসেবে বলা হলেও, চোখ কিন্তু আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কেও অনেক কিছু বলতে পারে।
শুষ্ক চোখ রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের লক্ষণ হতে পারে। উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল আপনার চোখের রঙিন অংশের চারপাশে সাদা, ধূসর কিংবা নীল রঙের বলয় তৈরি করতে পারে, যাকে আমরা আইরিস বলে জানি। আইরিসকে ঘিরে অনেকটা তামাটে বা সোনালী রঙের বলয় উইলসন রোগের একটি প্রধান লক্ষণ। এটি এক ধরনের বিরল জেনেটিক ডিজঅর্ডার বা বংশগত রোগ; যা মস্তিষ্ক, লিভার এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোতে তামা উৎপাদন করে। এর ফলে ধীরে ধীরে শরীরে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
শুধু তাই নয়। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, করোনারি ধমনী রোগ, এমনকি ক্যান্সারের পাশাপাশি গ্লুকোমা এবং বার্ধক্যজনিত কারণে চোখের পিছনের রক্তনালীগুলো অর্থাৎ, রেটিনার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চোখের মাধ্যমে মনের অভিব্যক্তির সঙ্গে প্রকাশ পেতে পারে শারীরিক এসব অসুস্থতার লক্ষণ।
আর এ কারণেই চিকিৎসকেরা বছরে অন্তত একবার চোখ পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
গবেষকদের দাবি, রেটিনা মানবদেহের প্রকৃত জৈবিক বয়স নির্ধারণ করতে পারে। মঙ্গলবার ব্রিটিশ জার্নাল অফ অফথালমোলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য।
মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু মহামারীবিদ্যা এবং অস্ট্রেলিয়ার চক্ষু গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক ও গবেষণাটির লেখক ড. মিংগুয়াং হে বলেন, "সিস্টেমিক ভাস্কুলার এবং নিউরোলজিক্যাল রোগ শনাক্তে রেটিনার ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।"
রেটিনার মাধ্যমে সহজেই মারাত্মক এসব রোগের পরীক্ষা করা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইউকে বায়োব্যাংক নামের সরকারি এই গবেষণাটিতে অংশ নিয়েছেন ৪০ থেকে ৬৯ বছর বয়সী প্রায় ৫ লাখ মানুষ। তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত ১ লাখ ৩০ হাজার রেটিনার ইমেজ বা ছবির ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়েছে গবেষণাটির ফলাফল।
গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মের পর থেকে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের প্রকৃত জৈবিক স্বাস্থ্য এবং ব্যক্তির প্রকৃত বয়সের মধ্যে এক ধরনের 'রেটিনাল এজ গ্যাপ' বা বয়সের ব্যবধান অনুমান করা যায়।
একজন ব্যক্তির প্রকৃত বয়স এবং চোখের মাধ্যমে নির্ধারিত স্বাস্থ্যগত জৈবিক বয়সের মধ্যে পার্থক্যের কারণে প্রতি বছর যেকোনো রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি ২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে উঠে এসেছে গবেষণায়। অর্থাৎ, প্রকৃত বয়সের তুলনায় যদি চোখের স্বাস্থ্যগত জৈবিক বয়স বেশি হয় তাহলেই মৃত্যু ঝুঁকি বাড়তে থাকবে।
রেটিনার মাধ্যমে নির্ধারিত প্রকৃত বয়স এবং জৈবিক বয়সের মধ্যে তিন, পাঁচ কিংবা দশ বছরের মতো বড় ব্যবধান কোনো নির্দিষ্ট রোগে ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত মৃত্যু ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এছাড়া উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত ওজন এবং বদঅভ্যাস যেমন- ধুমপান ইত্যাদি কারণেও বাড়বে মৃত্যু ঝুঁকি।
কম্পিউটার অ্যালগরিদমে রেটিনার রঙিন ছবি ব্যবহার করে অনেকটা নির্ভুলতার সঙ্গেই বয়স নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন গবেষকরা।
আমেরিকান একাডেমি অফ অফথালমোলজির মুখপাত্র ও ফিলাডেলফিয়ার উইলস আই হাসপাতালের চক্ষুবিদ্যার অধ্যাপক ড. সুনির গর্গ বলেন, "তবে পরীক্ষাটি যদি একটি শিশু ও একজন বয়স্ক ব্যক্তির মাঝে হয়, তাহলেই আমরা নির্ভুলভাবে বলতে পারবো। কিন্তু যদি ৭০ এবং ৮০ বছর বয়সী দু'জনের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করতে বলা হয়, সেটি হয়ত নির্ভুলভাবে সম্ভব হবেনা।" সুনির গর্গ এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত নন।
গবেষণাটিকে অনন্য বলে উল্লেখ করেছেন সুনির গার্গ। রোগীর প্রকৃত বয়স এবং রেটিনা পরীক্ষার মাধ্যমে কম্পিউটার অনুমিত বয়সের মাধ্যমে মৃত্যু ঝুঁকি নির্ধারণের ব্যাপারটি আগে অসম্ভব ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে, দুটি রোগের ক্ষেত্রে এই গবেষণা মৃত্যু ঝুঁকির হার বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর একটি কার্ডিওভাস্কুলার রোগ এবং অন্যটি ক্যান্সার। গবেষকরা বলেছেন, গবেষণায় অংশ নেওয়া অল্প সংখ্যাক মানুষ কিংবা ক্যান্সার ও হৃদরোগের চিকিৎসার উন্নতির কারণে এমনটি হতে পারে।
ড. হে এবং তার গবেষক দলের দাবি, "বিশেষত কার্ডিওভাস্কুলার ও ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত নন এমন ব্যক্তিদের 'রেটিনাল এজ গ্যাপ' পরীক্ষার মাধ্যমে মৃত্যুর ঝুঁকি কতটা বাড়ছে, তা নির্ধারণ করতে সক্ষম আমাদের এই অভিনব অনুসন্ধান।"
নতুন এই তত্ত্বটি এই মুহুর্তে সম্পূর্ণভাবে বাস্তবে প্রয়োগ সম্ভব না হলেও এটি একটি আশার আলো দেখিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। চোখের দিকে তাকিয়ে এখন শুধু মনের খবরই নয়, বরং স্বাস্থ্যের অবস্থা বোঝার পথও খুলে দিলেন গবেষকরা।
- সূত্র: সিএনএন