সৌদি আরবের ফ্লাওয়ার মেন: যে ঐতিহ্য টিকে আছে এখনও
দক্ষিণ সৌদি আরবের কহতানী গোষ্ঠির লোকেরা মাথায় ফুলের মুকুট পরে সুপ্রাচীনকাল থেকেই। ইয়েমেনের সীমান্তবর্তী আসির প্রদেশে তাদের বসতি বেশি এখন। লাল আর কমলা রঙের ফুলেই গাঁথা হয় মালাগুলো; সঙ্গে থাকে শেকড়-বাকড়। কেবল সৌন্দর্য বা সুগন্ধির জন্য ব্যবহৃত হয় না মালাগুলো। মাথা ব্যথা বা সাইনাসের অসুখ সাড়াতেও নাকি ভূমিকা রাখে।
বিবিসির থিওডরা ওরিঙ্গার সেখানে গিয়েছিলেন ২০১৮ সালে। কহতানীরা ফুল ও সবুজের পরিচর্যা করে সৌন্দর্য এবং স্বাস্থ্য উভয়ের জন্যই। এখন তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী ফুল মুকুট বিক্রি করে পর্যটকদের কাছে।
বাহরাইন, কুয়েত বা আরব আমিরাত-সব জায়গা থেকেই কহতানীরা এসে বসতি গড়েছেন দক্ষিণ আরবে। কহতানীদের এখানকার আদিপুরুষ ধরা হয়। বলা হয়ে থাকে, তারা ইব্রাহিমের (আ.) পুত্র ইসমাইলের (আ.) এর বংশধর।
গবেষক থিয়েরি মাউগের জানান, আগেকার দিনে সৌন্দর্য প্রতিযোগীতা হতো। যুবক ছেলেরা তাতে অংশ নিত। তারা প্রতিযোগীতায় হাজির হতো ফুলের মালা মাথায় জড়িয়ে। যতটা পারা যায় ততো ম্যারিগোল্ড আর জেসমিন গোঁজা হতো মালায়। মধ্যযুগের মানুষ ফুলের সঙ্গে যোগ করে বন্য বেসিলের (সুগন্ধিযুক্ত, ধনে বা পুদিনাপাতার মতো দেখতে) মতো গুল্মলতা ব্যবহার করতো। সৌন্দর্যর জন্য অনেকেই প্রতিদিন পরে ফুল। অন্যরা পরে উৎসবের দিনগুলোতে। কেউ কেউ চিকিৎসার উদ্দেশে পরে।
আসির এলাকাটা যেমন
একটা উচু মালভূমিতে এ জায়গা। গোটা সৌদি রাজ্যের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় এখানে। মে বা জুন মাসে সৌদি আরবের অনেক জায়গাতেই তাপমাত্রা পৌছায় ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে কিন্তু আসিরে তখন ঠান্ডা হাওয়া বয় আর ঝড়ের দাপটও দেখা যায়। রাজধানী রিয়াদ থেকে এ জায়গার দূরত্ব ৯০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। আসিরের শিখরগুলোই দেশের সর্বোচ্চ। পাহাড়ের কাটা কাটা খাঁজে অনেকটা চত্বরের মতো জায়গা সবুজে সয়লাব থাকে তখন। অল্প অল্প কফি, গম আর ফলফলাদিও ফলায় লোকে।
আরবী ভাষায় আসির মানে কঠিন। প্রত্যন্ত এলাকা বলেই এ নাম। লোকগানে আছে ৩৫০ বছর আগে তুর্কীদের আক্রমণ সইতে না পেরে কহতানীরা আশপাশের সমতল ভূমি থেকে উচুতে এসে ওঠে। দীর্ঘকাল অটোমান তুর্কীদের শাসনে থাকার পর ১৯৩২ সালে কহতানীরা সৌদি রাজ পরিবারের তত্ত্বাবধানে আসে।
ছোট ছোট গ্রাম কহতানীদের। গ্রাম প্রধান বা হেডম্যান শাসিত বলা যায়। গ্রামগুলোতে প্রবেশ খুব সহজ নয়। তারা একটা অদৃশ্য দেয়াল গড়ে রেখেছে প্রথমত নিরাপত্তার জন্য আর দ্বিতীয়ত রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা ভোগের জন্যও। যেমন হাবালা (দড়ি এর অর্থ) গ্রামে পৌছাতে যেমন দড়ির মই বাইতেই হতো। তবে সৌদি সরকার নব্বইয়ের দশকে কেবল কার গড়ে দিয়েছে তাই প্রত্যন্ত এলাকাটিতে পৌছানো এখন আগের তুলনায় সহজ। সরকার চায়, আদিবাসী এই দলগুলো জাতীয়তাবাদে সঙ্গে একাত্ম হোক এবং নতুন যুগের সঙ্গে তাল মেলাক।
এখনও টিকে আছে
এসব সরকারি হাঙ্গামা সত্ত্বেও ফুলমানবদের অনেক প্রথাই এখনো টিকে আছে। হারানোর ঝুঁকির মুখে থাকা ওই প্রথাগুলোই এখন পর্যটকদের টানছে বেশি। জাবালে সওদা যেটি সৌদির সবচেয়ে উঁচু পাহাড়, তার গায়ে কহতানীরা যেমন এখনো গরম গরম বিরিয়ানীর থালা সাজিয়ে রাখে যা স্থানীয়দের তো বটেই পর্যটকদেরও আকৃষ্ট করে। হাবালায় পর্যটকদের যারা গাইড হয় তারা আজও রঙচঙা ঢোলা কাপড়-চোপড় পরে। কহতানী মেয়েরা উজ্জ্বল হলুদ, নীল আর লাল রঙের পোশাক পরে; যদিও তারা ফুলের মালা গলায় বা মাথায় জড়ায় না।
কাদা আর পাথরে গড়া কম করেও ২০০ বছরের পুরোনো ছোট ছোট ভবনগুলোর আকর্ষণ এখানে এলে কেউ এড়াতে পারবে না। ইয়েমেনের সানায় যেমন ভবন দেখা যায় এগুলো অনেকটা সেরকম। সীমানায় বেড়া ওঠার আগে যে দুই দেশের মানুষের একইরকম রীতি-রেওয়াজ ছিল তা বোঝা যায় ভবনগুলো দিয়েই। ভবনগুলোর নকশা বেশ জটিল, বিশেষ করে ছাদে যেন পানি না জমে যায় তার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করা হতো।
তাছাড়া ঘরের ভিতরের তাপমাত্রা ধরে রাখার জন্য কাদার লেপনে কারিকুরি পরিলক্ষিত হয়। ঘরের বহির্গাত্র নীল, সবুজ, লাল আর হলুদ রঙে চিত্রিত। নানান জ্যামিতিক নকশাও নজরে আসে। এটা আসিরের বিশেষ কিছু। ইউনেস্কো তাই আসিরকে ২০১৭ সালে ইউনেস্কোর ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজের তালিকায় তুলেছে। প্রতিবছর হজের মৌসুমে আবার নতুন করে ঘরগুলো রাঙানো হয়।
তবে সব ভালো যাচ্ছে না
পর্যটক আকর্ষনে উদ্যোগী হয়ে সৌদি রাজ জোর করে হাবালার মতো গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের অনেককে নতুন জায়গায় নিয়ে গেছে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে নতুন নতুন আধুনিক বাড়ি গড়ে দিয়েছে, স্কুল গড়েছে আর চাকরিও দিয়েছে কিছু। 'আসিরি কালচার' দেখে যেতে প্রচারণা চালাচ্ছে সৌদি সরকার।
বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণেই সম্ভবত হাবালার প্রতি পর্যটকদের আাকর্ষণ বেশি আর জায়গাটা সুন্দরও বটে। পর্যটক ভিড় করার কারণে কিছু সুবিধাও হয়েছে কহতানিদের। এখন অনেক পরিবারই পর্যটকদের ওপর ভর করে জীবিকা চালায়। সরকারও এখন অনেকটাই তৎপর, কহতানী সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে।
সেীদি সরকারের ২০৩০ ভিশনে পর্যটনকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হচ্ছে হেরিটেজ সাইট সংস্কার ও সংরক্ষণে, আসির এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপ্রাপ্ত। ২০১৭ সালে যেমন আর্ট জামিল নামের প্রতিষ্ঠানটি কহতানীদের শিখিয়েছে কিভাবে আসিরি দেয়ালচিত্র ডিজিটালি সংরক্ষণ করতে হয়। জেদ্দার দাল হেকমা বিশ্ববিদ্যালয় রিইনভেন্টিং আসির নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, এতে প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কহতানী স্থাপনাগুলোর অনুকৃতি তৈরি করা হচ্ছে।
শেষ বেলা
যথন রাত্রি নেমে আসে আর পর্যটক বাসগুলো হোটেলমুখো হয় তখন হাবালার মতো গ্রামগুলো ভুতুড়ে ঠেকে। ফুলের মুকুটগুলো দিনকয়েকের বেশি টিকিয়ে রাখা মুশকিল। পাপড়িগুলো ঝরতে থাকে, ফুরিয়ে আসে বাসিল আর জেসমিনের গন্ধ। বর্তমান ঢাকা দেয় অতীতকে।
তাইতো থিওডরা ওরিঙ্গারকে দার আল হেকম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান আনা ক্লিংম্যান বলছিলেন, "যখনই আপনি নতুন কিছু চাইবেন, পুরাতন তখন বিপাকে পড়বেই। যদি স্মৃতি আকড়ে থাকতে চান তবে আবিস্কার হবে না আর আবিস্কারে আগ্রহ থাকলে বারবার স্মৃতির পাতা ওল্টানোর সময় পাবেন না।"
সূত্র: বিবিসি