যুক্তরাষ্ট্র-চীন মহাকাশ প্রতিযোগিতা কেন শুধুই কাল্পনিক গল্প!
ভয়ের রাজনীতি সব সময়েই ভালো বিকোয়। ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনী প্রচারণার কালে জন এফ. কেনেডি সোভিয়তে ইউনিয়নের সাথে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকার ভয়কে পুঁজি করেছিলেন। বলাই বাহুল্য, এ উদ্বেগকে কাজে লাগিয়ে কেনেডি হোয়াইট হাউসের সর্বোচ্চ পদটি অধিকারে সফলও হন। অথচ আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রে সোভিয়েতদের (আইসিবিএম) যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে থাকার অনুমান ছিল অলীক কল্পনা।
১৯৬২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট ম্যাকনেমারা কেনেডির সেই ভুল ধারণা ভাঙিয়ে তাকে বলেন, "পেন্টাগনের কিছু দেশপ্রেমী জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আবেগের বশেই এমন প্রচারণার জন্ম দেন। সেখানে এখনও এমন ব্যক্তিরা রয়েছেন। আমি তাদেরকে আরেকটি কল্পকাহিনি তৈরির সুযোগ দেব না।"
অথচ ছয় দশক পর একই ঘটনা আবারো ঘটছে। ভূরাজনীতির পণ্ডিত, রাজনীতিক ও জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা হুঁশিয়ার করে বলছেন, চীনের সাথে মহাকাশ প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র!
ট্রাম্পের আমলেই মহাকাশে সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীর নতুন শাখা স্পেস ফোর্স গঠন করে। সম্প্রতি এ বাহিনীর উপ-প্রধান জেনারেল ডেভিড ডি. থম্পসন সতর্ক করে বলেন, "চীনের সাথে আমাদের (সব ক্ষেত্রে) কৌশলগত প্রতিযোগিতা চলমান, মহাকাশও তার আওতায় এসেছে।"
তার মতে, "সার্বিকভাবে এর অর্থ- চীন নিজেদের মহাকাশ সক্ষমতা তৈরি করছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন অব্যাহত রেখেছে আর মোতায়েনও করছে নতুনতর সরঞ্জাম। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণায় গতি আনতে হবে, নাহলে চীন আমাদের পেছনে ফেলবে।"
মহাকাশের প্রতিযোগিতা নিয়ে এমন মন্তব্য নিঃসন্দেহে মুখরোচক সংবাদ হয়ে ওঠে। দখল করে শিরোনামের পর শিরোনাম। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র মোটেই চীনের থেকে পিছিয়ে পড়ছে না, বাস্তবতা বরং সম্পূর্ণ বিপরীত।
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মহাকাশ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র। পৃথিবীর কক্ষপথে প্রদক্ষিণরত সাড়ে ৪ হাজার কৃত্রিম উপগ্রহের মধ্যে অর্ধেকের বেশি বা ২,৭০০ স্যাটেলাইট-ই যুক্তরাষ্ট্রের। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের চেয়ে এই সংখ্যা প্রায় সাতগুণ বেশি।
একথা সত্য, ২০২১ সালে সবচেয়ে মহাকাশে সবচেয়ে বেশি রকেট উৎক্ষেপণ করেছে চীন। তবে উৎক্ষেপণের সংখ্যাই পুরো চিত্র তুলে ধরে না। কারণ চীনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের রকেটগুলো অনেকগুণ শক্তিশালী। তারা অধিক ওজন বহনে সক্ষম হওয়ায় আরও উন্নত স্যাটেলাইট, স্পেস প্রোব ও মহাকাশ যান বয়ে নিয়ে যেতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনের মহাকাশ গবেষণা ও অভিযানের তহবিল বরাদ্দ বেড়েছে সেটাও মিথ্যে নয়। ২০২০ সালে এই বরাদ্দ ছিল ৮৯০ কোটি ডলার, অথচ ওই বছর যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। এই তুলনায় চীনের ব্যয়কে সামান্যই বলা যায়।
তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের আছে বেসরকারি মালিকানায় ক্রমে বাড়বাড়ন্ত বাণিজ্যিক মহাকাশ শিল্প। এ খাতের বড় বড় সংস্থা- ব্লু অরিজিন ও স্পেস এক্সের সাথে যুক্ত হচ্ছে শত শত স্টার্টআপ। বিনিয়োগকারীরাও মার্কিন মহাকাশ অর্থনীতির খাতে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার লগ্নী করছেন।
সে তুলনায় চীনের বেসরকারি মহাকাশ শিল্প বেশ নবীন। গবেষণা, উদ্ভাবন আর অর্থায়নেও বহুগুণ পিছিয়ে।
তারপরও স্বীকার করতেই হবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের মহাকাশ কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। মহাশূন্যে নিজস্ব গ্লোবাল ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট ব্যবস্থা স্থাপনসহ চাঁদের বুক থেকেও মাটি-পাথরের নমুনা সংগ্রহ করেছে চীনের মহাকাশ যান। সুদূর মঙ্গলেও একটি একটি রোবোটিক যান নামিয়েছে দেশটি। নিজস্ব মহাকাশ স্টেশনেও নভোচারীদের পাঠাচ্ছে।
মাইলফলকগুলি নিঃসন্দেহে জোর করতালি পাওয়ার যোগ্য। তবে তাদের ভুল না বুঝে বাস্তবতার আতস কাচের তলে দেখতে হবে। তাহলে আমরা বুঝতে পারব, যুক্তরাষ্ট্র কোনোমতেই মহাকাশ দৌড়ে পিছিয়ে পড়েনি, বরং চীন বহুপথ পিছিয়ে থাকার পর সম্প্রতি লক্ষ্যণীয় গতিতে সেই ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করছে।
মহাকাশ নিয়ে চীনের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য রয়েছে। দেশটি চাঁদ ও মহাশূন্যের আরও দূরবর্তী গন্তব্যে অভিযান চালাতে চায়। এসব লক্ষ্য অর্জনে উল্লেখযোগ্য মাত্রার কারিগরি ও অন্যান্য বাধা অতিক্রম করতে হবে।
যেমন- গত বছরের জুনে রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে ইন্টারন্যাশনাল লুনার স্পেস স্টেশন স্থাপনের রোডম্যাপ প্রকাশ করে বেইজিং। এজন্য দেশটিকে তাদের সর্বাধুনিক লং মার্চ-৯ রকেট উৎক্ষেপণ করতে হবে। যদিও রকেটটি ২০১১ সাল থেকেই গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে। ২০৩০ সাল নাগাদ এটির পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণের আশা করছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। তবে ভারী রকেট নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির সমস্যা ইঙ্গিত দেয় লং মার্চ-৯ এর পরিণত রূপ নিতে আরও দীর্ঘসময় লাগতেই পারে।
চাঁদে চীনা নভোচারীদের অবতরণ নিয়েও অতি-উৎসাহের কারণ নেই, যুক্তরাষ্ট্র এই লক্ষ্য সেই ১৯৬৯ সালেই অর্জন করেছে।
এত কিছুর পরও চীনের পক্ষ থেকে মহাকাশ প্রতিযোগিতার আখ্যানে ওয়াশিংটনের নীতি-নির্ধারক ও পণ্ডিত মহলে ভয় ছড়াচ্ছে। 'পিছিয়ে পড়া'র সতর্কবাণী আসলে মহাশূন্যে মার্কিন সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিরই আহ্বান। এর অন্তরালে লুকিয়ে আছে মহাকাশ থেকে খনিজ শিল্প আহরণ ও বাণিজ্যিক শিল্পকে সহায়তা করতে মার্কিন সরকারকে তৎপর হওয়ার তাগাদা।
যেমন মার্কিন বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্টিভ কোস্ট সতর্ক করে বলেছেন, "দ্বিতীয় হওয়ার কোনো পুরস্কার মিলবে না।" তিনি জোর গুরুত্ব ও দ্রুততার সাথে ওয়াশিংটনের প্রতি পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন।
১৯৫০ এর দশকেও আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ে এমন প্রচারণা চালানো হয়েছে। কিন্তু, এতে গুরুত্ব দেওয়া হলে এবার মহাকাশে সামরিকায়ন মারাত্নক রূপ নেবে। বাড়বে প্রতিরক্ষা বরাদ্দ অপচয়ের ঝুঁকি।
মহাশূন্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ ও নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। তবে সেজন্য একটি কার্যকর মহাকাশ কৌশল প্রণয়ন দরকার। চীনের সাথে সহযোগিতা বাড়িয়েও মহাকাশ প্রতিযোগিতাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করা যাবে না। কিন্তু, তা দূর হলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়েই পারস্পরিক সহায়তার ভিত্তিতে বেসামরিক গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন করবে।
মহাশূন্য নিয়ে দুই দেশের বিজ্ঞানীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অর্থহীন প্রতিদ্বন্দ্বীতা হ্রাস করবে। যৌথ অভিযানের কল্যাণে দুই দেশই করদাতাদের বিপুল অর্থ সাশ্রয় করতে পারবে। সেজন্যই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ে অতীতের অহেতুক প্রচারণার ইতিহাসকে সতর্কবার্তা হিসেবে স্মরণে রাখা উচিত।
- সূত্র: দ্য ডিপ্লোম্যাট