বাংলাভাষী চীনা বোনদের মজার জগত
ফেসবুকে বাংলা সিস লিখলে বাংলাভাষী চীনাবোনদের মজার জগত পেতে অসুবিধা হবে না কারোই। ইউটিউবেও আছে তারা একই নামে। তাদের উদ্দেশ্য – বিশাল চীনকে বাংলাভাষী মানুষের কাছে তুলে ধরা।
সবমিলিয়ে তারা ৮ জন। বাংলার প্রায় সব শব্দই বুঝি তারা জানে। ফেসবুকে তাদের ফলোয়ার আছে ১.২ মিলিয়ন। ফেসবুকে ২১ জানুয়ারির পোস্টটিতে লেখা- চীনের মুসলমানরা বসন্ত উৎসবে কী কী পছন্দ করেন? সঙ্গের ভিডিওটিতে হাসিখুশি শিখা আর জিনিয়া বলছেন, 'আপনারা কেমন আছেন? লং টাইম নো সি। বসন্ত উৎসবে মুসলিমরা কী কী খাবেন তার প্রস্তুতি নেন।'
তারপর তারা হালাল ফুডের একটি দোকান দেখালেন বেইজিংয়ের। বললেন, দোকানটির বয়স ৩০৭ বছর। একজন মুসলমান এর প্রতিষ্ঠাতা। তারপর হাটতে থাকলেন দুজনে মিলে । গেলেন একটি সুপারমার্কেটে, সেখানে একটি দোকান দেখিয়ে বললেন, চীনা ভাষায় এখানে লেখা খাসি ও গরুর মাংস পাওয়া যায়। রাইস কেক মানে চালের পিঠাও পাওয়া যায়।
আরও বললেন, এই এলাকাটা মুসলমান অধ্যুষিত। একটা দোকানে টুপি পরা একজন চীনা বিক্রেতাও দেখা গেল। শিখা আর জিনিয়া কিছু গরুর মাংসের রুটি কিনল সে দোকান থেকে। রাস্তার ওপারে আরও কিছু দোকান দেখাল তারা। সেগুলোও হালাল ফুডের। গরুর মাংসের রুটি কেনার পরে শিখা জানতে চাইল, 'জিনিয়া তুমি এবার খুশি? রাজপ্রাসাদের গরুর মাংসের রুটি। খেয়ে দেখো। কেমন? ওয়াও ভিতরে গরুর মাংস!'
তারপর তারা আরেকটি বিখ্যাত হালাল খাবারের দোকানে গেল। কিন্তু বিরাট লম্বা লাইন দেখে বলল, লাইনের মাথা কোথায় ' লাইনের মাথা খুঁজতে খুঁজতে শেষে বলল, আজ তাহলে এ পর্যন্তই। এতক্ষণে শেষ হয়ে গেছে ১৬ মিনিট।
নতুন ভিডিওতে যাওয়ার আগে চীনের বসন্ত উৎসব নিয়ে কিছু কথা এবার বলা যাক। চীনের সবচেয়ে বড় উৎসব এটি। চীনা নিউ ইয়ার উপলক্ষে এ উৎসব। ব্যস্ত দেশটিতে সাতদিন ছুটি থাকে এ উৎসব উপলক্ষে। এবারের উৎসব দিন ১ ফেব্রুয়ারি। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে চীনা চান্দ্র বর্ষ কখনো কখনো এক মাস পরেও শুরু হয়।
সাং রাজাদের (১১০০ -১৬০০ খ্রিস্টাব্দ) আমলে এ উৎসবের শুরু। দেবতা ও পূবপুরুষদের উদ্দেশে এ সময় চীনারা নানান উপহার উৎসর্গ করে। প্রায় ২৩ দিন ধরে চলে উৎসব। বসন্তের প্রথম দিনে ইরানীরাও নওরোজ উৎসবে মাতে। নববর্ষর আগের রাতে চীনা পরিবারগুলো একত্রিত হতে ভালোবাসে এবং একসঙ্গে রাতের খাবার খায়। পুরো বাড়ি সাফ করা উৎসবের অংশ- উদ্দেশ্য হলো খারাপ সবকিছু বিদায় করা আর সৌভাগ্যের ঘরে ঢোকার পথ খুলে দেওয়া।
লাল কাগজ দিয়ে ফুল বা বিভিন্ন নকশা কেটে জানালায় ঝুলিয়ে দেওয়াও উৎসবেরেই অংশ। লাল খামে পুরে টাকা উপহার দেওয়ারও চল আছে। চীনা নববর্ষ পালিত হয় মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, ব্রুনেই, ম্যাকাও, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম আর সুরিনামেও। এবারের উৎসব প্রতীক বাঘ। মানে চীনাদের জন্য আসছে ব্যাঘ্রবর্ষ।
তুহীনার চৌ
তুহীনা খুব নম্রভাষী মেয়ে। চৌ নামের একটা চীনা খাবার নিয়ে পরিস্কার বাংলায় তাকে কথা বলতে দেখলাম। তিনি বলছিলেন, চৌ মানে জাউ। প্রায় চার হাজার বছর আগে চীনা মানুষরা বুঝতে পারে বিভিন্ন খাদ্যশস্য সেদ্ধ করে ভর্তা করে খাওয়া যায়। তারপর দুই হাজার বছর আগে আবিষ্কৃত চৌ রোগ নিরাময়েও কার্যকর। তাই দিনে দিনে চৌ হয়ে উঠল ওষুধ। যেমন চালের সঙ্গে লাল খেজুর থেতলে খেলে রক্ত চলাচল বাড়ে। মিষ্টি আলুর জাউ পাকস্থলী আর হজমের জন্য ভালো। খাবারের মাধ্যমে রোগ নিরাময় চীনের একটি ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতি। চীনা ভাষায় একে বলে শি লিয়াও। শি মানে খাবার আর লিয়াও মানে চিকিৎসা।
এরপর তুহীনা চীনের কিছু মজার শব্দ নিয়ে কথা বলল। একটি যেমন ছিয়ান বাও বা মানিব্যাগ। নববর্ষ উপলক্ষে খামে টাকা পাঠানোকে চীনা ভাষায় বলা হয় হোং বাও। এছাড়া দা বাও মানে হলো প্যাক করা। তারপর তুহীনা ২০২১ সালের চীনের সবচেয়ে ১০টি জনপ্রিয় শব্দ জানাচ্ছে।
প্রতিবছরই চীনের জাতীয় ভাষা তত্ত্বাবধান কেন্দ্র ১০টি জনপ্রিয় শব্দ ঘোষণা করে। এবারের শব্দগুলো হচ্ছে- সিপিসি প্রতিষ্ঠার শততম বাষিকী (গেল জুলাইয়ে ছিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টর শততম বার্ষকী), টিকা গ্রহণ করা ও টিকা সহায়তা, তৃতীয় শব্দটি পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত – কারণ নিরপেক্ষতা বাস্তবায়ন করা, এরপর আছে চীনের মহাকাশ যান বা স্বচ্ছল সমাজ ইত্যাদি।
জিনিয়ার সঙ্গে বোটানিক্যাল গার্ডনে
'হাই বন্ধুরা আমি জিনিয়া। আমার পেছনে একটা সুন্দর মন্দির রয়েছে। কিন্তু মহামারীর কারণে এটা বন্ধ রয়েছে। তবে এখানে সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান রয়েছে। দেখুন বন্ধুরা আমার পেছনে একটি করিডর, এটি চেরি করিডর। এখানে অনেক চেরী গাছ রয়েছে। তবে এখন এই মৌসুমে অনেক ফুল দেখতে পাচ্ছি না।' অল্প সময়ের ভিডিওটি শুরু হয় একটা দ্রুতগতির ট্রেন দিয়ে। তারপর দেখা যায় লোটাস পন্ড। তারপর একটা কাঠের ব্রিজ। তারপর অনেকগুলো চেরি গাছ। তারপর আবার লোটাস পন্ডটি দেখিয়ে শেষ হয়ে যায় ভিডিওটি।
লাইট ফেস্টিভাল
পরে একটি পোস্ট দেখলাম স্টিল ফটো দিয়ে সাজানো। সেখানে শিখা আর জিনিয়া গেছে লাইট ফেস্টিভাল দেখতে। লিখেছে, 'এত সুন্দর লাইট ফেস্টিভাল, রুপকথার মতো দৃশ্য, আমাদের সঙ্গে উপভোগ করবেন বন্ধুরা?' আসন্ন বসন্ত উৎসব এবং শীতকালিন অলিম্পিক গেমসের কারণে বেইজিং শহরকে কত সুন্দর লাগছে।
এরপরই আছে একটি ভিডিও পোস্ট। সেখানে শিখা আর জিনিয়া বলছে, 'এখন সবখানে চলছে বসন্ত উৎসবের আয়োজন। অনেক ঠান্ডা। তুষার পড়ছে বন্ধুরা। এই উপলক্ষে চলছে লাইট ফেস্টিভাল। লেটস গো। রুপকথার মতো তুষার আর বরফের দুনিয়া এটি। মেঝেতে দেখুন লাইট নড়ানড়া চলছে। লাইট পুতুলগুলোর হাসি দেখে মনের সব দু:খ দুর হয়ে যায়। আমরা এসেছি সোলানা মলে। দেখুন স্কি পুতুলগুলো আপনাদের বরফ খেলার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। লাইট ফেস্টিভাল বসন্ত উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রেম দেবতা চত্বরে সবচেয়ে বেশি আলোর খেলা দেখুন। পান্ডাগুলোও এই উৎসবে মোটা কাপড় পরছে দেখুন।'
শিখার মশলা প্রতিযোগিতা
ভিডিওতে শিখা প্রথমেই বলে নেয়, 'দেখুন আমার সামনে সব বাংলাদেশি মশলা। আমরা আজ একটা প্রতিযোগিতা করব। তারপর সে একটি করে মশলা দেখায় আর একে একে জিনিয়া, তুহীনা, প্রেমা, মুক্তা বা শিশিরকে বলে, এইটা কি? কেউ পারে কেউ পারে না। পারলে হাসে তারা আর না পারলে বেশি হাসে। মশলাগুলোর মধ্যে আমরা দেখতে পেলাম, আদা, হলুদ, রসুন, জিরা, এলাচ, দারচিনি ইত্যাদি। আছে ধনেপাতাও।
প্রেমা-মুক্তা-রুবির বাংলাদেশ
মুক্তা রুবির কাছে জানতে চায়, 'তুমি কিভাবে অফিসে আসো?'
রুবি: হেঁটেই চলে আসি। আমার বাসা তো কাছে। আর যদি সাইকেলে আসি তবে ৫ মিনিট লাগে।
এর মধ্যে প্রেমা যোগ করল, 'আমার বাসা অনেক দূরে। আমি সাবওয়েতে করে আসি। আধাঘণ্টা লাগে।'
মুক্তা বলল, 'আমি নিজের গাড়ি চালিয়েই অফিসে আসি।'
রুবি বলল, 'আমি প্রতিবছর যখন গ্রামের বাড়ি যাই, তখন দ্রুতগতির ট্রেনে যাই। ফ্লাই করি, তবে তা ভালো লাগে না।'
প্রেমা বলল, 'আগে বাবা মায়ের কাছে শুনেছি, গ্রাম থেকে বেইজিং আসতে পাঁচ ঘণ্টা লাগতো। এখন লাগে আড়াই ঘণ্টা।'
রুবি বলল, 'আমি যখন ২০০০ সালে বেইজিংয়ে পড়তে আসি বাড়ি থেকে তখন লেগেছিল ১৬ ঘণ্টা। এখন লাগছে মাত্র ৬ ঘণ্টা।'
মুক্তা বলল, 'কয়েক বছর আগে আমরা বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। তোমাদের মনে আছে?'
রুবি: ২০০৩ সালে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম। সেখানে অনেক রিকশা। নিউমার্কেটের সামনে রিকশার ছবি তুলেছি। হোস্টেল থেকে রিকশায় করেই বিশ্ববিদ্যালয় যেতাম। তবে অনেক জ্যাম। লালবাগ কেল্লা যখন যাই, তখন রিকশায় চারজন বসেছিলাম। দুইজন ওপরে, দুইজন সিটে বসেছিলাম।'
প্রেমা: রিকশায় অনেক পণ্য পরিবহন করা হয়। অনেকগুলো বস্তার ওপর মানুষ বসে আছে।
মুক্তা: খুব মজার। বাসে উঠেছিলে?
প্রেমা: বাসগুলো অনেক পরিস্কার।
রুবি: আমি একটা বাসে উঠেছিলাম যেটার দরজা ছিল না। এতো দ্রুত চলেছে যেটা থামে না।
মুক্তা: আমি চিড়িয়াখানা গিয়েছিলাম বাসে করে। লোকে খুব অবাক হয়ে দেখেছিল, দুইজন বিদেশি মেয়ে বাসে উঠেছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি দেখে দুজন পুরুষ উঠে আমাদের বসতে দিল। আমার মনে হয়, ওরা অনেক জেন্টেল।
প্রেমা: জানো, বাংলাদেশে কিন্তু আমাদের মতো রাইড শেয়ারিং আছে এখন।
মুক্তা: ও তাই?
প্রেমা: হ্যা, মোটর সাইকেল আর গাড়িতে রাইড শেয়ার করা যায়।
মুক্তা: চলো তাহলে দুই তিনবছর পর আবার বাংলাদেশে যাই।
রুবি: বাহ ভালো কথা। চলে যাবো।
রুবি বাংলা রেস্তোঁরায়
'অনেকদিন বাংলা খাবার খাই না। অনেকদিন খাই না।' বলে রুবি শালিমার নামের রেস্তোঁরায় যায়।
রুবি বলে, 'এখানকার মালিকও আমার খুব পরিচিত। খাবার তো সুস্বাদু।'
রুবি ভিতরে গিয়ে মালিকের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে। বলে, 'আরে তুমি তো অনেক মোটা হয়ে গেছ।'
মালিক: আমি তো সুখী মানুষ।
রুবি: বাহ্ ভালো কথা। আরো সুখী হও, আর মোটা হও।
রেস্তোঁরার দেয়ালে বাংলাদেশের পতাকা টাঙানো। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আছে কিছু পোস্টার। সাউন্ড সিস্টেমে বাজছিল, মনে পড়ে রুবি রায়…
রেস্তোঁরা কর্মী: আলুর দম খাবেন? ঝাল দিব?
তারপর রুবি নিজেই মুরগী তরকারি নিল বুফে থেকে। নিল সবজি। বলল, 'আমার মনে আছে যখন বাংলাদেশে ছিলাম তখন প্রায় সব ছুটির দিনে একটা বাঙালি রেস্তরায় যেতাম আর ১০০০ টাকা দিয়ে বুফে খেতাম।'
তারপর রুবি ডাল নিল। বলল, 'নানরুটি দিয়ে ডাল খেতে খুব ভালো লাগে। মিষ্টি সবার শেষে খাব।'
খেতে খেতে রুবি বলে, 'একদম বাংলাদেশের রেস্টুরেন্টের মতো টেস্ট। এই যে সমসা (সমুচা), খুব ভালো। তারপর আরাম করেই খেতে থাকে বাংলা খাবার।'
এমন অনেক ভিডিও পোস্ট আছে ফেসবুক পাতাটিতে। কয়েকটির নাম উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করা যেতে পারে- শিশিরের সাথে ঘুরে দেখুন সিনচিয়াংয়ের গ্র্যান্ড বাজার, বিশ্ব অ্যানিমেশন দিবস, হাস-নদী-পাহাড়ের ছোট্ট গ্রাম, ইয়ুনানের রাইস নুডলসের সঙ্গে সম্পর্কত প্রেমের গল্প, চীনের প্রতিবন্ধিদের জন্য প্রথম বিশেষ বইয়ের দোকান, ঢাকার কোন দোকানে সুস্বাদু ফুচকা বিক্রি হয়, 'তুই তো বন্ধু ভালো মানুষ না' (তুহীনা ও জিনিয়ার কণ্ঠে বাংলা গানের মিউজিক ভিডিও, মডেল জিনিয়া ও তুহীনা) ইত্যাদি।
উল্লেখ্য পেইজটিতে ফলোয়ার আছেন ১২ লক্ষ ৯৮ হাজারের বেশি।