বাংলার জন্য লড়েছেন যে মাওলানা
ছাত্রজীবন থেকে আহমেদুর রহমান আজমী শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখতেন। পাকিস্তানি শোষকবাহিনীর কবল থেকে একটি মুক্ত স্বদেশের প্রত্যাশা বুকে লালন করতেন। প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে মাদ্রাসায় মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করলেও মন ও মননে ছিল প্রগতিশীলতা।
৫২'র ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠনে এই ভাষাসংগ্রামী আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামেও ছিল তার অনন্য ভূমিকা। তবে বাঙ্গালির ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বের মাধ্যমে জাতির কাছে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামের নেতৃত্বভাগে থাকা আজমী ১৯৫৮, ১৯৬১, ১৯৬২ ও ১৯৬৪ সালের বিভিন্ন সময়ে মোট পাঁচবার গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় চার বছর কারাগারে ছিলেন। তাকে অন্তত ১৯বার আত্মগোপনে কাজ করতে হয়েছে। আত্মগোপন করা অবস্থায় কখনো তার নাম ছিলো আজমী, কখনো মজনু, আবার কখনো মন্টু নামে।
মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী ১৯২৮ সালের ২ নভেম্বর চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের দেওখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা গোলাম রহমান ছিলেন একজন আলেম। তার মা মরিয়মুন্নেছা।
১৯৪২ সালে মিঠাছড়া স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তার বাবা তাকে আবুরহাট মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। পরিচয় হয় তার চেয়ে বয়সে বড় এটিএম শামসুদ্দিনের সাথে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ঘনিষ্ঠতা। তার কাছ থেকে সংগ্রহ করতে থাকেন খবরের কাগজ, বিভিন্ন প্রচারপত্র, ইস্তেহারসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বই। ওই এলাকার বাম রাজনৈতিক নেতা ছৈয়দুল হক মিয়ার সাথে পরিচয় হয় আহমেদুর রহমানের। যোগ দিতে থাকেন বিভিন্ন গোপন সভা-সমাবেশে। এমন খবর পিতার কাছে পৌঁছলে তাকে ১৯৪৮ সালে পাঠিয়ে দেন হাটহাজারির বিখ্যাত দারুল উলুম মাদ্রাসায়। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আহমেদুর রহমান গোপনে যুক্ত ছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের সাথে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহতের খবর তিনি জানতে পারেন পরদিন (২২ ফেব্রুয়ারি)। হাটহাজারি মাদ্রাসা ও পার্শ্ববর্তী স্কুলে দ্রুত এ খবর ছড়িয়ে পড়ে। ২৩ ফেব্রুয়ারি আহমেদুর রহমানের নেতৃত্বে হাটহাজারি সদরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল মিছিল ও সমাবেশ। ওই সমাবেশ থেকেই মাওলানা আজমীকে আহবায়ক করে গঠিত হয় হাটহাজারি থানা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। অন্তর্ভুক্ত হন চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে।
আহমেদুর রহমান আজমী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৫৮ সালের মে মাসে ওয়ারেন্ট জারি করা হয় ২৯ বামপন্থী রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে। ১৯ অক্টোবর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার করার পর পুলিশ তার কাছ থেকে মুচলেকা আদায়ের চেষ্টা করে। তিনি মুচলেকা দিতে রাজি হননি। ফলে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে।
মাওলানা আজমীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতার মামলায় ১৩ বছরের সাজা হয়। জেল থেকে আপিল করায় সাজা কমে আসে দেড় বছরে।
ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তাকে বিভিন্ন সময়েই কারাবরণ করতে হয়েছে। দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও পালাবদলে আহমেদুর রহমান আজমী বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগ, ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক সমিতি, মোজাফফর আহমদ সমর্থিত ন্যাপ, চৌধুরী হারুন অর রশিদ সমর্থিত ন্যাপ এবং গণফোরামে জেলা থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।
১৯৬৬ সালে ৩৮ বছর বয়সে মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী মিরসরাই নিবাসী মরহুম সৈয়দুল হকের কন্যা মোছাম্মৎ আনোয়ারা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আজমীর তিন ছেলে ও দুই মেয়ে।
বার্ধক্যজনিত রোগে ২০১১ সালের ভাষার মাসে ১৭ ফেব্রুয়ারির রাতে মিরসরাইয়ে নিজ বাড়িতে মারা যান এই ভাষাসৈনিক।
টিবিএস ও নগদ-এর যৌথ উদ্যোগ