একুশের প্রথম নাটক, ভাষা আজিজের ‘ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা’
অর্ধশতাব্দী আগে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বুকে পদচারণা ছিলো একই নামের তিনজন মানুষের। বিখ্যাত এই তিন ব্যক্তিকে আলাদা করে চিনতে নামের শেষে জুড়ে দেওয়া হয়েছিলো ডাকনাম। তারা হলেন হালিশহরের এমএ আজিজ (কালা আজিজ), পাথরঘাটার মোহাম্মদ আজিজ (গোড়া আজিজ) ও পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া থেকে চট্টগ্রামে ঠাঁই নেওয়া ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান। ভাষা আন্দোলনে অবিস্মরণীয় ভূমিকার কারণে ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমানকে 'ভাষা আজিজ' নামে ডাকা হতো।
ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলার জগদীশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবা তফাজ্জল হোসেন ও মা আইধননেছা মারা যান। এরপর তিনি চাচা ওয়াজেদ আলী ও খালা সবুরা খাতুনের স্নেহে লালিত-পালিত হন।
আজিজুর রহমান উলুবেড়িয়া উচ্চবিদ্যালয় হতে ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। পরে আহছানিয়া স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সিভিল বিভাগ থেকে ডিগ্রি পাস করেন।
উলুবেড়িয়া উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন আজিজুর রহমান। কলকাতায় থাকাকালীন সময়ে ব্রিটিশবিরোধী খাকছার আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। নেতাজী সুভাষ বসুর নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকদের বিচারের সম্মুখীন করার প্রতিবাদে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন আজিজুর রহমান । ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বড়ভাইয়ের সাথে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন। বসবাস শুরু করেন নগরের মোমিন রোডে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মহিম দাশের পরিত্যক্ত বাড়িতে।
চট্টগ্রামে এসে আজিজুর রহমান তমদ্দুন মজলিস ও খিলাফতে রব্বানি পার্টির আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসলেও আজিজুর রহমানের কাজ তাকে সবার শ্রদ্ধার আসনে ঠাঁই দেয়। ফলে মোমিন রোডে মহিম দাশের পরিত্যক্ত বাড়িটি হয়ে উঠেছিলো সে সময়ের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনকারীদের অন্যতম কর্মক্ষেত্র।
অল্প সময়ের ব্যবধানে ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান তমদ্দুন মজলিসের চট্টগ্রাম জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব পান। তার দায়িত্বে তমদ্দুন মজলিস অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। তিনি ভাষা আন্দোলনকে চট্টগ্রামের গ্রামেগঞ্জে সর্বসাধারণের কাছে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন। এই কর্মসূচির প্রস্তুতি পর্যায়ে তমদ্দুন মজলিস আহ্বায়ক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর অনুপস্থিতিতে তমদ্দুন মজলিস নেতা আজিজুর রহমান সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
একুশের প্রথম নাটক
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মিছিলে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে তৎক্ষণাৎ বিক্ষোভ মিছিল, হরতাল আহ্বান, লালদীঘি ময়দানে সর্বদলীয় জনসভার আহ্বান এবং পরদিন চট্টগ্রামের অফিস-আদালত বন্ধ করে সরকারি কার্যক্রম অচল করে দিতে ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমানের ভূমিকা ছিলো অগ্রণী। লালদীঘি ময়দান সংলগ্ন পার্কে অস্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপনেও তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা।
ভাষা আন্দোলন সফল করতে তিনি টানা পাঁচদিন শ্রমিক নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর আন্দরকিল্লা অফিসে অবস্থান করে লালদীঘি ময়দানে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠানে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। ২৪ ফেব্রুয়ারির ওই সভায় লক্ষাধিক জনতার সমাবেশ ঘটে।
ঘটনাবহুল '৫২ সালে ভাষা সংগ্রামের উপর রচনা করেন নাটক 'ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা'। যা রেডিও পাকিস্থানের কর্মকর্তা সাদেক নবীর পরিচালনায় চট্টগ্রামের জেএমসেন হলে মঞ্চস্থ করা হয়। এতে অভিনয় করেন চট্টগ্রামের তমদ্দুন মজলিস কর্মীরা। নাটকটি ছিল ভাষা আন্দোলনের উপর মঞ্চস্থ হওয়া তৎকালীন সারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মঞ্চনাটক।
সাংবাদিক আসিফ সিরাজ তার এক প্রতিবেদনে লেখেন, 'ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম শহরেই ভাষায় আগুন ছড়ায় সর্বাধিক, একুশের প্রথম কবিতাই শুধু নয়, প্রথম নাটকও মঞ্চস্থ হয় চট্টগ্রামে।'
১৯৫২ সালে ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমানকে সর্বসম্মতিক্রমে সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেন। তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল মুক্তিযুদ্ধেও। সিডিএর কর্মকর্তা হওয়ার সুবিধা কাজে লাগিয়ে নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ সরবরাহ করেন। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন চট্টগ্রামের বন্দরে পরিচালিত বিখ্যাত অভিযান অপারেশন জ্যাকপটে।
ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সহকারী প্রকৌশলী পদে কর্মরত ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি অবসরে যান।
পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে রাজশাহীর মেয়ে নিলুফার ফরহাদ রুনুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর। দাম্পত্য জীবনে তারা ছিলেন নিঃসন্তান। নগরের আগ্রাবাদে কিছুদিন বসবাসের পর বাড়ি বিক্রি করে সস্ত্রীক ঢাকায় চলে যান তিনি।
২০০২ সালে স্ত্রী বিয়োগের কিছুদিন পর চট্টগ্রামে ফিরলেও পরে আবারও ঢাকায় ফিরে যান তিনি। ২০০৫ সালে নিঃসন্তান আজিজুরের ঠাঁই হয় গাজীপুরের হোতাপাড়া বৃদ্ধাশ্রমে। দীর্ঘ তিন বছর খোঁজাখুঁজির পর ২০০৮ সালে বৃদ্ধাশ্রম থেকে তাকে উদ্ধার করেন ভাগ্নে এডভোকেট শেখ মুহাম্মদ ইউসুফ। ফিরিয়ে আনেন ৪০ বছরের স্মৃতিবিড়জিত চট্টগ্রামের মাটিতে। জীবনের শেষ চার বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন একটি বাড়িতে কাটিয়েছেন এই সংগ্রামী মানুষটি। সেখানেই ২০১১ সালের ২১ ডিসেম্বর ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান ওরফে ভাষা আজিজ।
অনেকটা নিভৃতে ঐদিন রাতেই চট্টগ্রাম নগরের হযরত মোল্লা মিসকিন শাহ্ (রহ:) মাজার করবস্থানে ভাষা সৈনিক ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমানকে দাফন করা হয়। নির্লোভ-নির্মোহ এ জাতীয় বীর চলে গেছেন অনাদরে-অবহেলায়।
টিবিএস ও নগদ-এর যৌথ উদ্যোগ