পাথর যুগের রানিরা আসলে কারা
দেবী নাকি শুধুই খেলনা? তবে পাথর যুগের (২.৬ মিলিয়ন বছর আগে শুরু, শেষ ধরা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ বছর আগে) পাওয়া সব নারী মূর্তিকেই পন্ডিতরা চেনার সুবিধার্থে 'স্টোন এজ ভেনাস' নামে ডাকেন। পাথর যুগের কমপক্ষে ২০০টি ভেনাস পাওয়া গেছে ইউরোপ আর পশ্চিম এশিয়াজুড়ে। এদের মধ্যে গ্রিমাল্ডি ভেনাসের বয়স ২৪০০০ বছর। উত্তর ইতালির রোজি গুহায় পাওয়া গেছে এটি। উচ্চতায় ২.৪ ইঞ্চি।
যতকাল ধরে মানুষ শিল্প গড়ছে ততকাল ধরেই নারী প্রিয় বিষয়। দ্বিতীয় শতকে গড়া ভেনাস ডি মিলোই কি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ নয়? তারপর ১৮৮৪ সালে জন সিঙ্গার সারজেন্টের ম্যাডাম এক্সের কথাও তো আসে। মাদাম এক্সের নিটোল ত্বক বা ভেনাস ডি মিলোর চোখা মুখের সঙ্গে অবশ্য পাথর যুগের নারী মূর্তিগুলোর কোনো তুলনা চলে না। এই মূর্তিগুলোর স্তন, পেট, পশ্চাদ্দেশ অনেক বেশি স্ফীত। তাদের নাক-চোখ-মুখ বা ঠোঁট সেভাবে স্পষ্টও নয়। তবু পাথর যুগের ভেনাসেরা (গ্রিক পুরাণের ভালোবাসার দেবী) আধুনিক দর্শকদের সেকালের সঙ্গে যোগ করিয়ে দেয়, এদের শিল্পীরা ধরায় ছিলেন ৩৫ হাজার থেকে ১৪ হাজার বছর আগে।
শীতল যুগের শিল্প
শীতল যুগ শেষ হতে চলেছে। ইউরোপে আধুনিক মানুষরা এসেছে সবে। চল্লিশ হাজার বছর আগের কথা। গুহাচিত্র আর বহনযোগ্য ছোট ছোট মূর্তি (ভেনাসসহ) বানিয়ে চলেছে সেকালের শিল্পীরা। তারা ছিল শিকারজীবী। শিকার করেই জীবন চালাত। তারা ঘুরে ঘুরে বেড়াতো, পেছনে ফিরত কমই, পেছনে কেবল রেখে যেত হাড়গোড়, ভাঙাপাত্র কিংবা ওইসব গুহাচিত্র, কখনো-কখনো দুয়েকটি ভেনাস। এখন পর্যন্ত পাওয়া ভেনাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরাতনটির নাম রাখা হয়েছে হোহলে ফেলস ভেনাস। সেটি ৩৫ হাজার বছরের পুরোনো। হাতির দাঁতে গড়া।
ভেনাস গড়ার চল মূলত শুরু হয়েছিল বরফ যুগের (২.৪ মিলিয়ন বছর আগে শুরু, সাড়ে ১১ হাজার বছর আগ পর্যন্ত ধরা হয়) শেষ ধাপে। ম্যাগডালেনিয়ান পিরিয়ডে (১৭০০০ থেকে ১২০০০ বছর আগে) আবহাওয়া ধীরে ধীরে গরম হতে থাকে। তখন ভেনাসগুলোর গড়নে পরিবর্তন আসতে থাকে। ফ্রান্সের লাসকক্স বা স্পেনের আলতামিরার গুহাচিত্রও ওই সময়কার। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন, প্যালিওলিথিক যুগের আরো অনেক শিল্পকর্ম লুকিয়ে আছে অচিন সব জায়গায় যেগুলো এখনো আবিস্কারের অপেক্ষায়।
গড়ন ও আকার
মানুষ শিল্পী হয় প্রায় ৮০ হাজার বছর আগে। কিন্তু তাদের প্রথম বিষয় মানুষ ছিল না। বিমূর্ত সব জ্যামিতিক গড়ন এঁকেছিল তারা প্রথম প্রথম। মানুষ তারপর আরো অধিক বাস্তবতায় নজর দেয়, তাদের চারপাশ খেয়াল করে দেখে, খুঁজে পায় নানান কিছু। ঘোড়া বা অরকস (আদিম ষাঁড়) যেমন। মানুষকে শিল্পীরা বিষয় করে তোলে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে। সেকালের যে সব মনুষ্য মূর্তি আজ পর্যন্ত টিকে আছে সেগুলোর হিসাব নিলে দেখা যায় পুরুষের চেয়ে নারী মূর্তিই বেশি। ২০০ নারী মূর্তির বেশিরভাগই পাওয়া গেছে পশ্চিম ইউরোপে। কিছু মধ্য ইউরোপ মানে রাইন আর দানিউব নদীর উপত্যকায় আর পূর্ব ইউরোপ এবং এশিয়ায় পাওয়া গেছে কিছু (দক্ষিণ রাশিয়া এবং দূরতম সাইবেরিয়ায়)। মানুষ তখন শিল্প গড়ত পাথরে, হাড়ে আর মাটিতে। শিল্পকর্মগুলোর বিশেষত্ব তাদের আকারে। দুই থেকে ১০ ইঞ্চির মধ্যেই হতো সেগুলো। একারণেই সেগুলো বহনযোগ্য আর যাযাবর শিকারী জনগোষ্ঠী সেগুলো জায়গায় জায়গায় বহন করে বেড়াত।
অনেক ভেনাসেরই ভ্রু, চোখ, নাক এমনকি মুখও খুঁজে পাওয়া ভার। অনেকগুলো একেবারে ডিমের মতো। যেগুলোর মুখাবয়ব পরিষ্কার সেগুলোকে গবেষকরা বলছেন নারীর সাধারণ প্রকাশ, কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির নয়। মূর্তিগুলোর বেশিরভাগই নগ্ন। কিছু মূর্তির গলায় হার, হাতে ব্রেসলেট, কোমরবন্ধনী ইত্যাদি দেখা যায়। খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে কমবয়সী মূর্তিটি ১৪ হাজার বছর আগের। হোহলে ফেলস কে হিসাবে নিলে ৩৫ থেকে ১৪ হাজার একটি দীর্ঘকাল। তাই গবেষকরা ভাবছেন আদিম মানুষের জন্য মূর্তিগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
মূর্তিপ্রাপ্তির খতিয়ান
প্রথমটি পেয়েছিলেন ফরাসী প্রত্নতাত্ত্বিক পল হুরল্ট। ১৮৬৪ সালে। তিনি তিন ইঞ্চি উঁচু একটি আইভরি নারী মূর্তি পান ফ্রান্সে লগ্রে-বেসেতে। নগ্ন মূর্তিটির মাথা ও বাহু ছিল না কিন্তু তার পশ্চাদ্দেশ ও পা পরিষ্কারভাবে চেনা যাচ্ছিল। বিশ্লেষকরা দেখলেন, সেটি ১৭ থেকে ১২ হাজার বছর আগের। হুরল্ট নাম রেখেছিলেন, উদ্ধত ভেনাস। হুরল্ট এ নামকরণ করেছিলেন সান্দ্রো বতিচেল্লির বার্থ অব ভেনাস থেকে। ওই চিত্রকর্মে রোমান দেবী ভেনাস নগ্নতার মাঝেও নম্রভাবে উপস্থাপিত।
পরের ভেনাসটি পাওয়া গিয়েছিল ১৮৯৪ সালে। তাকে বলা হচ্ছিল হুডেড লেডি, কারণ তার মাথায় একটা আবরণ ছিল। সেটার দৈর্ঘ্য ছিল মাত্রই এক ইঞ্চি। তবে গবেষকরা মনে করেন এটি বড় কোনো অবয়বের অংশ। দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের একটি গুহায় সেটি আবিষ্কার করেন এডওয়ার্ড পিয়েতে। অস্ট্রিয়ার দানিউব উপত্যকায় পাওয়া গিয়েছিল ভেনাস অব উইলিয়েনডর্ফ। জায়গার নাম থেকেই এর নাম রাখা হয়েছিল, পাওয়া গিয়েছিল ১৯০৮ সালে। এটি চুনাপাথরে গড়া, চার ইঞ্চি উচ্চতার। গবেষকরা ধারণা করেন, শিল্পী এর মাথার চুলও এঁকেছিলেন অথবা মাথায় হ্যাট পরিয়েছিলেন। এর স্তন ছিল স্ফীত, পেটও খুব উঁচু ছিল। অনেক গবেষক তাই বিশ্বাস করেন, এটি উর্বরতার দেবী ছিল।
বিতর্ক বাড়ছে
তবে সব গবেষক কিন্তু তেমন ভাবেন না। প্রথমত, ভেনাস নামকরণ নিয়েও আপত্তি অনেকের। কারণ রোমানদের ভেনাস তো দেবী, তাই নামটিই পক্ষপাতমূলক। ভেনাসগুলো যতই ছোট হোক আলোচনার জন্ম দিয়েছে অনেক। অনেকে যেমন ভাবছেন, মূর্তিগুলো দেবী হলে তাদের একটা সাধারণ চিহ্ন থাকত। কেউ কেউ ভাবছেন, এগুলো পুরোহিতের উপকরণ যাদের ওপর অতিপ্রাকৃত শক্তি আরোপিত হতো। কেউ কেউ বলছেন, এগুলো শিশুদের খেলনা মাত্র। আর সবগুলো একই উদ্দেশ্যে গড়া তা বলাও ঠিক হচ্ছে না। অনেকে বলছেন, এগুলো সেলফ পোর্ট্রেট। আর দিন যত গড়াচ্ছে বিতর্ক ততই জমছে।
যারা ভেনাস নামের বিরুদ্ধে তারাও সময় সময় বলছেন, হতে পারে দেবী নইলে কষ্ট করে গড়তে যাওয়ার হিসাব ঠিক মিলছে না। তখনকার মানুষের অফুরন্ত অবসর ছিল ভাবা ঠিক হবে না। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, মাতৃত্বকে তখনকার মানুষ সম্মান করতো। উদাহরণ হিসেবে মিলিয়ে দেখছেন কিছু হিসাব, এখনো যেসব শিকার-সংগ্রহকারী জনগোষ্ঠী টিকে আছে তাদের মধ্যে ৪০ বছরের বেশি বয়স্ক নারীরা ছয় থেকে সাত সন্তানের মা হয়ে থাকেন সাধারণত। ভেনাসদের আমলে নিশ্চয়ই শিশুমৃত্যুর হার ছিল অনেক, মাতৃমৃত্যুর হারও কম নয়। তাই কোনো কোনো গবেষক ভাবছেন, পৃথুলা নারীমূর্তি মানে আদিম ভেনাস আসলে আদিম মানুষের আকাঙ্ক্ষার একটা প্রকাশ। উর্বরা নারী মানে আসলে অধিক সন্তান জন্মদানে সক্ষম নারী। তরতাজা সন্তানও জন্ম দিতে পারে সে নারী এবং গর্ভকালীন ও তার পরবর্তী ঝড়ঝাপ্টাও সামলাতে পারে।
- সূত্র- ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক