গ্রামেগঞ্জে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে দেন যে কিশোর
পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র এক বছরের মাথায় মুসলীম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠে পূর্ব বাংলার মানুষ। এ কে এম এমদাদুল ইসলাম তখন ফটিকছড়ি করোনেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। চলমান পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন ছুঁয়ে যায় এমদাদুলের কিশোর মন। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে ঢাকায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দম্ভোক্তির পর ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন।
কলেজ জীবনে বামপন্থী রাজনীতির পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এমদাদুল ইসলাম। সম্পর্ক গড়ে ওঠে চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সঙ্গে।
জেলা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হবার পর এমদাদুল ইসলামের ওপর দায়িত্ব পড়ে ফটিকছড়ি ও নাজিরহাট কলেজ এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে আহূত ছাত্র ধর্মঘট চট্টগ্রামেও সফল করতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঢাকায় রক্তাক্ত ট্রাজেডির খবর চট্টগ্রাম পৌঁছালে সারা শহরে দাবানলের মত বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
২২ ফেব্রুয়ারি নগরের মোমিন রোড থেকে মিছিল করে লালদীঘি মাঠে সমাবেশ করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে আয়োজিত জনসভায় যোগ দেন। সে জনসভায় গণপরিষদের সদস্য এ কে খান-কে পদত্যাগ করে বক্তব্য রাখতে বাধ্য করা হয়। উল্লেখ্য, এ জনসভায় দু'হাজারের অধিক লোক সমাগম হয় এবং সেখানে ব্যাপক গোলযোগ হয় ও একপর্যায়ে সভা ভেঙ্গে যায়।
চুয়ান্নর প্রাদেশিক নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম লীগ সরকারের শোচনীয় পরাজয়, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান, একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবস ও শহীদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলার মর্যাদা লাভ করা, শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়া, বাংলা মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার্থে বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত বাংলার তরুণ-যুবকরা গড়ে তোলে বৃহত্তর ঐক্য এবং নবতর উদ্যমে শপথ নেয় অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। আর এসবের পেছনে মফস্বল শহর এমনকি গ্রাম, পাড়া, মহল্লার তরুণ-যুবকদের সাথে অক্লান্ত পরিশ্রম, একাগ্রতা ও ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে দিনরাত কাজ করেছেন এমদাদুল ইসলাম।
স্বৈরাচার-সাম্প্রদায়িকতাবিরোধীসহ সকল গণআন্দোলনে চট্টগ্রামে সামনের কাতারে ছিলেন অ্যাডভোকেট এমদাদুল ইসলাম। বাংলাদেশের প্রতিটি গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তার।
এ ভাষা সংগ্রামী ২০০৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, প্রথমেই নিজ ভাষা ও দেশের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। তার মতে, মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে নিজের মধ্যে কখনও জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরি হয় না।
১৯৩৩ সালের ১৮ মে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ইমামনগরে জন্ম নেন এ কে এম এমদাদুল ইসলাম। ১৯৪৫ সালে দৌলতপুর এবিসি জুনিয়র মাদ্রাসা থেকে ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫০ সালে ফটিকছড়ি করোনেশন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এ কে এম এমদাদুল ইসলাম কলেজ জীবনে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৫ সালে তিনি নাজিরহাট কলেজে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বি এ পাশ করেন। সে বছরেই আইয়ুব খানের সামরিক আইন জারি হলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
এর আগে ১৯৫৭ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পঞ্চাশের দশকে তিনি তিনি যুবলীগ ও নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন।
১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এলএলবি পাশ করেন। '৬৫ সালে চট্টগ্রাম আদলতে আইন পেশায় যুক্ত হন। এর আগে আত্মগোপনে থাকাকালীন সময়ে এ কে এম এমদাদুল ইসলাম উত্তর চট্টগ্রামে নাঙ্গলমোড়া উচ্চবিদ্যালয় ও কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী অ্যাডভোকেট এমদাদুল ইসলাম সর্বশেষ ঐক্য ন্যাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর আগে তিনি গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারী নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৮৪ বছর বয়সে মারা যান তিনি।
টিবিএস ও নগদ-এর যৌথ উদ্যোগ