কেওক্রাডং ট্র্যাকিং: এটাই চ্যালেঞ্জ, এটাই আনন্দ
তরুণ বয়সী বারো জনের একদল পর্যটক; সিলেটের একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থী এরা। প্রত্যেকের হাতে একটা করে বাঁশের কঞ্চি। কিছুক্ষণ পর পর বিশ্রাম নিয়ে ধীর পায়ে উঠছেন কেওক্রাডং পাহাড়ে। ক্ষণে ক্ষণে হাঁপিয়ে উঠছেন সবাই। সামনেই দেখা যাচ্ছে কেওক্রাডং এর সর্বোচ্চ চূড়া। এখনই পৌঁছে যাব করে একে অপরকে ধরাধরি করে উঠছে তো উঠছেই সবাই।
দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ও একটি উচ্চতম পাহাড়ে ওঠার প্রসঙ্গে সাংবাদিক পরিচয়ে জানতে চাইলে ফিমা নামের এক পর্যটকের প্রতিক্রিয়া ছিল, "এটাই চ্যালেঞ্চ, এটাই মজা, এটাই আনন্দ। প্রথমবার পাহাড়ে উঠার এমন অনুভূতি জীবনেও ভুলব না। কষ্টকর কিন্তু এক কথায় অসাধারণ।"
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে ফিমা বলেন, "আমরা সবাই বগালেক থেকে কেওক্রাডং পর্যন্ত পায়ে হেঁটে পাহাড়ে ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়েই এখানে এসেছি। আমাদের ১২ জনের দলে আটজন ছেলে এবং চারজন মেয়ে রয়েছে। সবারই এখানে প্রথমবার আসা।"
"কষ্ট যত হবে হোক, বগালেক থেকে কেওক্রাডং পর্যন্ত হেঁটে এসেছি আমরা। পরদিন সকালে আবার পায়ে হেটেই বগালেক পর্যন্ত ফিরব। হয়তোবা কখনও বান্দরবানের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া হবে। কিন্তু প্রথমবার হিসেবে হঠাৎ করে এভাবে পাহাড় ট্র্যাকিং করার অভিজ্ঞতা সারাজীবন অন্যরকম অনুভূতির ব্যাপার হয়ে থাকবে," যোগ করেন তিনি।
কেওক্রাডং পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার মূর্হুতে ঢাকার উত্তরা থেকে আসা আটজনের আরেকটি পর্যটকদলের জুননু রাইন ও তোহা নামে দুই পর্যটক টিবিএসকে বলছিলেন, "শুধু ট্র্যাকিং এর জন্যই কষ্ট করে এখানে আসা। কষ্ট না করলে এ আনন্দ পাওয়া যেত না। গাড়িতে করে আসলে ট্র্যাকিংয়ে যে একটা আলাদা ব্যাপার আছে সেটা বুঝতাম না। পাহাড় উঠতে উঠতেই শারিরীক পরিশ্রম ও কষ্ট ভুলে যাচ্ছি।"
"তবে আমাদের সবাই সমানতালে হাঁটতে পারে না। কয়েকজন বারবার পেছনে পড়ে যায়। তাদের জন্যে অপেক্ষা করে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। দুর্বল লাগলে হালকা পানি খেয়ে বিশ্রাম নিলে আবারও ভাল হাঁটা যায়। সময় একটু বেশি চলে চলে যায় আর কি," বলেন তিনি।
এসব পর্যটকদলের মত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখন ট্র্যাকিং করতে অনেকেই ছুটে আসেন বান্দরবানের রুমা উপজেলার এই কেওক্রাডং পাহাড়ে। ট্র্যাকিং করার জন্য সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই চার মাস সময়কে বেছে নেন ভ্রমণপ্রিয় লোকজন। ট্র্যাকিং করে বগালেক থেকে কেওক্রাডং পর্যন্ত পৌঁছাতে লাগে প্রায় চার ঘণ্টা। ভালো করে হাঁটতে পারলে তিন ঘন্টার মতো লাগে।
বগালেক হয়ে কেওক্রাডং পাহাড় এখন তাই ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের পছন্দের জায়গা। ট্র্যাকিং করে যাওয়ার এই পথে দেখা যায় উঁচু-নিচু পাহাড়, আঁকাবাঁকা পথ ও কখনও ঝিরি ঝরণা। রয়েছে পাহাড়িদের বৈচিত্র্যময় পাড়াও। পথে পথে দেখা মেলে বনজঙ্গল ও ছোট ছোট ঝোপঝাড়ও।
পাহাড় ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের টানে ট্র্যাকিং করতে এসেছেন জানালেন ঢাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী দল। সে দলের চারজন তারেক আজিজ, হাসনাইন ইলাহি, আখজার শাকুর ও শিহাব আহমেদ এসেছেন দ্বিতীয়বার।
এবারের ভ্রমণ নিয়ে এ চার পর্যটক টিবিএসকে বলেন, "আগেরবার গাড়িতে করে আসায় ফিলিংসটা পাওয়া যায়নি। সবকিছু দূর থেকে দেখার মত হয়ে গেছে। হেঁটে আসলেই সত্যিকার অ্যাভেঞ্চারাস ফিলটা পাওয়া যায়। ট্র্যাকিং করতে আসা পর্যটকদের নতুন অনেক জনের সাথে মেশার সুযোগ হচ্ছে। কয়েক কিলোমিটার হেঁটে যখন নতুন নতুন দৃশ্য দেখি তখন কষ্ট করে আসা বৃথা মনে হয় না।"
"এছাড়া কষ্ট করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাহাড় উঠা একটা ফিলিংস দেবে। মনের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্ম দেবে। অনেকেরই মনে হবে জীবনে কিছুই হয়নি। কিন্তু এখানে এসে এরকম সর্বোচ্চ পাহাড়ে উঠা একটা বড় অর্জন বলে মনে হবে।"
তবে এ পর্যটক দলের সদস্যরা আক্ষেপ করে বলেন, "ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে এখানকার প্রকৃতিকে অনুভব করতে আসি। দুঃখজনভাবে এই বগালেকের মত জায়গায় কিছু কৃত্রিম অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। যেটা এখানকার পরিবেশের সাথে একেবারেই মানানসই না। আর্টিফিসালি যখন কিছু করা হয় তখন স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে।"
তারা চান না ভবিষ্যতে এরকম আরও কিছু হোক। এখানে প্রকৃতি যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকুক। এটাই মানুষকে আকৃষ্ট করবে। প্রকৃতিকে যারা ভালবাসে; এখানে যা আছে তা দেখতেই মানুষ বারবার ছুটে আসবে, বলেন তারা।
বগালেক থেকে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে রওনা দেওয়ার পর পাওয়া যাবে রাস্তার পাশে ছোট ছোট টংঘর। স্থানীয় পাহাড়ি লোকজন ট্র্যাকারদের জন্য লেবুর শরবত, পাঁকা পেঁপে, আখ ও রংচা বিক্রি করে থাকে সেখানে। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত পর্যটকরা এসব খেয়ে আবার তরতাজা হওয়ার শক্তি খুঁজে নিতে পারে।
জোয়াল এন কিম বম নামে একজন দোকানি জানান, পর্যটন মৌসুমে টংঘর দোকান স্থানীয়দের কিছু বাড়তি আয়ের পথ তৈরি হয়েছে। বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার ভাল পর্যটক আগমণ ঘটে। এ সময় প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মতো বিক্রি হয়। তবে অন্য দিনে এক হাজার টাকার বেশি বিক্রি হয় না।
সেহজা ও মাহদী নামে দুই পর্যটক জানান, কয়েক কিলোমিটার হাঁটার পর প্রতিটি স্টপেজে ছোট ছোট এ টংঘরগুলো বাড়তি আনন্দের ব্যাপার। ট্র্যাকিং করার সব প্রস্ততি নিয়ে আসার পরও পেঁপে, শরবত ও আখ খেতে পারার সুযোগ দারুণ সৌভাগ্যের ব্যাপার। সবচেয়ে বড় বিষয় পাহাড়ে হাঁটার জন্য এসব খাবার ভাল শক্তি জোগায়।
নিজেদের মনে বাড়তি আনন্দ পেতে গিটার কাঁধে ঝুলিয়ে ট্র্যাকিং করে বগালেকে ফিরছিলেন পাঁচজনের একটি দল। টংঘরে বিশ্রাম নেওয়ার সময় গিটার বাজিয়ে গান ধরেন সুজন মেহেদী নামে এক পর্যটক।
হঠাৎ করে ভেসে উঠে 'অনেকটা পথ হেঁটেছি একসাথে। হেঁটেছি পাশাপাশি। তারপর সবকিছু ফেলে দূরে সরে গিয়েছে একটু একটু করে...' নামে একটা গানের সুর। এসময় পর্যটক ঘিরে থাকা টংঘর হয়ে উঠে আনন্দমুখর পরিবেশ।
টিবিএসকে সুজন মেহেদী বলেন, "পাহাড় ভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে একটা গিটার নিয়ে যাওয়া হয়। দিনের বেলায় এ পাহাড় ও পাহাড় ঘুরাঘুরির পর রাতে জমিয়ে গানের আড্ডা দেওয়া হয়। এগুলো পাহাড়ে না এসে অনুভব করা যায় না। পাহাড় ও প্রকৃতিকে ভালবাসরা মধ্যে একটা আনন্দ আছে।"
এদিকে প্রত্যেকটি পর্যটক দলে রয়েছে পথ প্রদর্শক হিসেবে একজন করে স্থানীয় গাইড। গাড়ি ভাড়া ঠিক করা, রুম বুকিং দেওয়া এবং খাবার অর্ডার দেওয়াসহ পর্যটকদের নানা সহযোগিতা দিয়ে থাকেন এ পর্যটক গাইড।
ঢাকা থেকে বেড়াতে যাওয়া কেওক্রাডং পাহাড়ে ১৫ জনের একটা পর্যটকদল সঙ্গে নিয়ে গাইড প্রদীপ বরুয়া বলেন, "গত বছর লকডাউনের পর থকে এ পর্যন্ত ৫০টি টিম কেওক্রাডং নিয়ে এসেছি। গাইডের পেশা ভাল লাগে। কারণ এখানে যারা আসে; সবাই আনন্দে থাকে। কেউ মনের দুঃখে আসে না। যারা আসে ভ্রমণের মাধ্যমেই আনন্দ পেতে আসে।"
"অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যারা অভিভাবক ও আত্মীয়স্বজন ছেড়ে একটা অপরিচিত জায়গায় বেড়াতে আসে। তাদের সুবিধা অসুবিধা খুব দায়িত্বশীলতার সাথে দেখতে হয়। থাকা খাওয়া থেকে শুরু করে ঘুমানো পর্যন্ত তাদের পাশে থাকতে হয়। একজন বাবা-মা সন্তানদের যেভাবে যত্ন করে ঠিক সেভাবে তাদের দেখভাল করতে হয়। এখানে শুধু গাইড হিসেবে নয়, একজন অভিভাবকের মত করে দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়," বলেন তিনি।
১৮ বছর ধরে পর্যটক গাইড করে আসা রাহাত উল্লাহ বলেন, "ট্র্যাকিং করতে আসা পর্যটকদের অনেক দর্শনীয় স্থানেও নিয়ে যাওয়া হয়। সুন্দর সুন্দর ঝরণা রয়েছে। স্থানীয় পাহাড়ি লোকজন বিভিন্ন ঝিরি ঝরণাকে যেনামে ডাকা হয় সেভাবে অক্ষুন্ন রাখতে পর্যটকদের অনুরোধ করি। বনজঙ্গলে যারা ঘুরে বেড়াই অধিকাংশই পাহাড় ও প্রকৃতির দরদী মানুষ।"
"তবে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি ইভেন্ট খুলে, না জেনে স্থানীয়দের ডাকা একটা নাম অন্যভাবে দিয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে আসল নামটা বিকৃত হয়ে যায়। এগুলোও যেন করা না হয় পর্যটকদের গাইড করে থাকি আমরা," বলেন রাহাত উল্লাহ।
রুমা উপজেলা পর্যটক গাইড সমিতি জানায়, রুমা সদর থেকে খোলা জীপ (চাঁদের গাড়ি), ল্যান্ড ক্রজার ও মোটর সাইকেলে করে সরাসরি কেওক্রাডং পর্যন্ত যেতে পারে। বগালেক পর্যন্ত পিচঢালা রাস্তা হলেও কেওক্রাডং পাহাড় পর্যন্ত রাস্তা এখনও কাঁচা সড়ক রয়েছে। কাঁদা মাটির কারণে বর্ষাকালে পুরোপুরি বন্ধ থাকে যে কোনো ধরনের গাড়ি চলাচল। এ সময় কোন পর্যটকও যায় না সেখানে।
এখন অনেক পর্যটক বগালেক পর্যন্ত গাড়িতে গিয়ে সেখান থেকে কেওক্রাডং এর উদ্দেশে পায়ে হেঁটে রওনা দেয়। হাঁটার অভ্যাস যাদের নাই অথবা হেঁটে গন্তব্যস্থলে পৌঁছার আস্থা পায় না তারা চলে যায় গাড়িতে করে। তবে গাড়িতে করে যাওয়ার তুলনায় হেঁটে ট্র্যাকিং করার পর্যটকের সংখ্যাই বেশি আসে বলে জানিয়েছেন পর্যটক গাইড সমিতি।
রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মামুন শিবলি টিবিএসকে জানান, "এসব এলাকায় আসলে প্রকৃতিপ্রেমীরাই বেশি ঘুরতে যায়। কেওক্রাডং এলাকায় পর্যটকদের থাকার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে কটেজ নির্মাণ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন এখনও কোনো অবকাঠামো গড়ে তুলেনি।"
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বগালেকের পাশে পর্যটকদের বসার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সেখানে অন্য কোন অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। বগালেকে আগের পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখতেই প্রশাসন আর কোন অবকাঠামো তৈরি করেনি।
পর্যটন মৌসুমে রুমা উপজেলায় কত সংখ্যক পর্যটক আসে নির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া না গেলেও আগামীতে উপজেলা প্রশাসেনর উদ্যোগে পর্যটকদের নিবন্ধন করার কথা জানান সরকারি এ কর্মকর্তা।