অপেক্ষা বাড়ল, এখনও ১৬৫ সিসির ঊর্ধ্বে মোটরসাইকেল আমদানি করা যাবে না
মোটরসাইকেল ব্যবহারকারী তরুণদের হতাশ করেছে নতুন আমদানি নীতি আদেশ। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত এই নীতি আদেশে আগের মতোই ১৬৫ সিসির ঊর্ধ্বে সব ধরনের মোটরসাইকেল আমদানি নিষিদ্ধ রেখেছে সরকার।
তবে রপ্তানির উদ্দেশ্যে মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত শিল্প প্রতিষ্ঠান ৫০০ সিসি পর্যন্ত উৎপাদন করতে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানি করতে পারবে। তিন বছর মেয়াদী এই নীতি আদেশ ২০২৫ সাল পর্যন্ত অথবা নতুন আমদানি নীতি জারি না করা পর্যন্ত বহাল থাকবে।
এছাড়া বর্তমানে সর্বোচ্চ তিন বছরের পুরনো ১৬৫ সিসি পর্যন্ত পুরনো মোটরসাইকেল আমদানি করা যেতো। দেশেই মোটরসাইকেল উৎপাদন বাড়ায় এবার পুরনো মোটরসাইকেল আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি) এ এইচ এম শফিকুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, স্থানীয়ভাবে ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল উৎপাদনের জন্য যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানির যে বিধান আমদানি নীতি আদেশে রাখা হয়েছে, তা শুধু রপ্তানির জন্য। অর্থাৎ, যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানির মাধ্যমে ১৬৫ সিসির অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরসাইকেল উৎপাদন করে শুধু বিদেশে রপ্তানি করা যাবে, দেশের সড়কে চালানো যাবে না।
তিনি বলেন, মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের আগেই আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং সম্পন্ন হয়েছে। মন্ত্রিসভার কিছু অবজারভেশন আছে, সেগুলো সংযোজন করে খুব শিগগিরই এটি গেজেট আকারে জারি করা হবে।
বাংলাদেশে অধিক সিসির মোটরসাইকেলের বাজার প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে। ২০২১ সালে ৬ লাখেরও বেশি মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে। এটি বেড়ে ২০ লাখে উন্নীত হতে পারে বলে আশা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
রানার অটোমোবাইলস, ইফাট অটোস, র্যানকন মোটরবাইকস লিমিটেডসহ বিভিন্ন কোম্পানি দেশে ৫০০ সিসি বা তার বেশি মোটরসাইকেল উৎপাদনে বিনিয়োগ করছে। এসব কোম্পানি আমদানি নীতি আদেশে দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহারের জন্য সিসি সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করে আসছিল।
রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. হাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "রপ্তানির উদ্দেশ্যে ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল উৎপাদনের জন্য যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানির সুযোগ আমাদের আগে থেকেই ছিল। আমরা এ ধরণের মোটরসাইকেল রপ্তানিও করছি। কিন্তু আমরা লোকাল মার্কেটে এ ধরণের উচ্চ ইঞ্জিন ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরসাইকেল বিক্রির সুযোগ চেয়েছিলাম। কারণ, কোনরকম রোড ট্রায়াল ছাড়া রপ্তানি করার পর সেদেশের ব্যবহারকারীদের কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে।"
"সরকার অটোমোবাইল শিল্পের বিকাশে যে স্বপ্ন দেখছে, এই আমদানি নীতি আদেশ দিয়ে তা পূরণ হবে না। এটি এক ধরণের সংকীর্ণ নীতি। সরকার যত দিন আইনি বেড়াজাল দূর করবে না, ততোদিন এ শিল্পের বিকাশ সম্ভব হবে না", জানান তিনি।
এশিয়ান মোটরবাইকস লিমিটেডের অপারেশনস হেড সাফাত ইশতিয়াক বলেন, "আমরা কাওয়াসাকির সঙ্গে ফ্যাক্টরি করার জন্য অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আমরা উৎপাদনের অনুমতি পাচ্ছি চমৎকার। কিন্তু উৎপাদনের পর স্থানীয়বাজারে বিক্রি করতে পারবো কি-না, তা স্পষ্ট না। সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকলে এ খাতে বিনিয়োগকারীরা কেন আসবে? বাংলাদেশে কারখানা করার একটাই কারণ, দেশের ভেতরে মার্কেট বড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।"
"আমাদের এই অঞ্চলে ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার মতো জায়ান্ট ম্যানুফ্যাকচারিং হাব রয়েছে এবং গ্লোবাল ব্রান্ডগুলোর এসব দেশে কারখানা রয়েছে। সেখানে তাদের ইকোনমি অব স্কেল আছে, যা বাংলাদেশে একেবারেই অনুপস্থিত। স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদন চালিয়ে গেলে একপর্যায়ে আমরা রপ্তানি বাজারে সেসব দেশকে টেক্কা দিতে পারবো", যোগ করেন তিনি।
অন্যদিকে, হিরো ব্রান্ডের মোটরসাইকেল উৎপাদক প্রতিষ্ঠান নিটল-নিলয় গ্রুপ দেশে ১৬৫ সিসির ঊর্ধ্বে মোটরসাইকেল ব্যবহার নিষিদ্ধ রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। তাদের যুক্তি ছিল, আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-২০১৮ অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ১৬৫ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল উৎপাদনের প্লান্ট স্থাপন করেছে তারা। এখন সিসি সীমা বাড়ানো হলে এসব প্লান্টে বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার কঠিন হবে এবং ব্যাংকঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমে যাবে।
তবে নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ টিবিএসকে বলেন, "কতো সিসির মোটরসাইকেল দেশের রাস্তায় চলবে, তা নির্ধারণের সুযোগ ক্রেতা-ম্যানুফ্যাকচারারদের থাকা উচিত। তবে এ বছর অন্তত রপ্তানির উদ্দেশ্যে ৫০০ সিসি মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানির যে সুযোগ দিয়েছে, এটিকে আমি স্বাগত জানাই। এটা অটো মোবাইল ইন্ডাস্ট্রি লিবারাইজেশনের প্রথম ধাপ বলে মনে করি। আগামীতে সরকার নিশ্চয়ই দেশের ভেতরেও এ ধরণের মোটরসাইকেল চালানোর সুযোগ দেবে।"
তিনি বলেন, এ ধরণের মোটরসাইকেলের দাম অনেক, দেশে ক্রেতাও কম। তবে দাম বেশি হলেও এদেশের মানুষ বিএমডব্লিউ, রোলস রয়েস গাড়ি ব্যবহার করছে। মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রেও এমনটি হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, আমদানি নীতি আদেশে মোটরসাইকেলের সিসি সীমা বাড়ানোর পক্ষে-বিপক্ষে উৎপাদক ও সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিভক্ত হয়ে গেছে। উভয় শ্রেণীর স্বার্থ বিবেচনা করে ১৬৫ সিসির ঊর্ধ্বে সব ধরণের মোটরসাইকেল আমদানি নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি দেশে ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল উৎপাদনের জন্য যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানির বিধান রাখা হয়েছে।
তবে রিকন্ডিশনড গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে নতুন নীতিতে কোন পরিবর্তন আনা হয়নি। সম্প্রতি উত্তরা মোটরস ০-১৬০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ি আমদানির শুল্ক-কর স্তর ভেঙ্গে ০-৮০০, ৮০১-১২০০ এবং ১২০১-১৬০০ পর্যন্ত তিনটি স্তর করার যে প্রস্তাব করেছে, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে একটি প্রতিবেদন প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, নতুন আমদানি আদেশে কিছু পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। আবার কিছু কিছু পণ্য আমদানি সহজ করা হয়েছে। এতোদিন টেলিফোনিক ট্রান্সফার (টিটি) এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ দুই লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করা যেত। এটাকে বাড়িয়ে এখন পাঁচ লাখ ডলার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, "যারা শিল্পপতি তারা যে কোনো পরিমাণের জিনিস বা ইকুইপমেন্টে ইনভেস্টমেন্ট করতে পারবেন। কেউ রেফ্রিজারেটরের পার্টসের ব্যবসা করে, সে এলসি করে যে কোনো পরিমাণের পণ্য আনতে পারবে। কিন্তু টিটির মাধ্যমে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ ডলারের জিনিস আনতে পারবে। টিটি করে জিনিস আনা খুব সহজ। সে জন্য পাঁচ লাখ ডলার পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে। এটা ব্যক্তিগত ব্যবহার বা ইন্ডাস্ট্রির জন্য না, ব্যবসার জন্য।"
কৃষিপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ফিউমিগেশন পদ্ধতি তুলে দিতে আন্তর্জাতিক মাধ্যম থেকে অনুরোধ জানালেও সরকার তাতে রাজি হয়নি বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
তিনি বলেন, "ফিউমিগেশন হলো- আমরা যখন কোনো কৃষিপণ্য আনি, তখন ওটার মধ্যে কোনো ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস আছে কি না, এটা আমাদের এখানে এপিডেমিক করবে কি না। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বারবার অনুরোধ করেছে ফিউমিগেশন সিস্টেমটা তুলে দিতে। কিন্তু আমাদের বিশেষজ্ঞদের মত, আমেরিকার তুলার মধ্যে এক ধরনের পোকা থাকে। এই পোকা যদি বাতাসে চলে যায় তাহলে আমাদের উপর ক্ষতিকর প্রভাবের সৃষ্টি হতে পারে।"
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নতুন আমদানি নীতিতে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য নমুনা আমদানির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। তবে জুতা, চামড়াসহ অন্যান্য রপ্তানিমুখী খাতের জন্য নমুনা আমদানির সীমা অপরিবর্তিত থাকছে।
বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি ক্যাটাগরিতে ১২টি করে সর্বোচ্চ ৭০০ নমুনা আমদানির সুযোগ পান। এটি বাড়িয়ে প্রতি ক্যাটাগরিতে ১৫টি করে সর্বোচ্চ ১৫০০ নমুনা আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যমান নীতি আদেশে সব ধরণের নিটওয়্যার ও ওভেন রপ্তানির ক্ষেত্রে ২০% মূল্য সংযোজনের শর্ত রয়েছে। অর্থাৎ, ১০০ ডলারের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৮০ ডলারের কাঁচামাল আমদানি করা যেতো। আর প্রতি ডজন পোশাক রপ্তানির এফওবি ৬০ ডলার বা তার বেশি হলে ১০% মূল্য সংযোজনের শর্ত ছিল। আর শিশু পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে ১৫% মূল্য সংযোজনের শর্ত রয়েছে।
নতুন নীতি আদেশে বলা হয়েছে, প্রতি ডজন নিট ও ওভেনের এফওবি মূল্য ৬০ ডলার পর্যন্ত হলে ২০% মূল্য সংযোজন করতে হবে। আর প্রতি ডজনের এফওবি মূল্য ৬০ ডলারের বেশি হলে ১০% মূল্য সংযোজনের শর্তারোপ করা হয়েছে। শিশু পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজনের শর্ত অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।