বিশ্বের পরিত্যক্ত যত শহর!
বিশ্বে এমন অনেক শহর বা জায়গা রয়েছে যা একসময় বহু মানুষের ভিড় থাকলেও এখন সেগুলো পরিত্যক্ত। একসময় প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ থাকলেও বর্তমানে শহরগুলোতে শুধুই শূন্যতা, জনমানবহীনতা বিরাজ করছে।
কেন এই শহরগুলো এখন পরিত্যক্ত? কেনই বা সেগুলো বসবাস অযোগ্য?
একটি স্থান পরিত্যক্ত হওয়ার পেছনে নানা কারণ বা ঘটনা থাকতে পারে। আমরা জানি যুদ্ধের সময় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। অনেক স্থানে আবার পারমাণবিক বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর ফলে তা বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়ে। তাহলে জেনে নেওয়া যাক বিশ্বের এইরকম কিছু পরিত্যক্ত জায়গার কথা ও এর পেছনে থাকা কারণগুলো।
প্রিপায়াত, ইউক্রেন
প্রিপায়াত শহরটি ইউক্রেনের উত্তর অঞ্চলে অবস্থিত। ইউক্রেন-বেলারুশ বর্ডারের কাছাকাছি এর অবস্থান।
পরিত্যক্ত শহরের কথা বললে প্রথমেই চলে আসে প্রিপায়াতের নাম। সোভিয়েত ইউনিয়ন চেরনোবিল নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করলে ১৯৭৯ সালে এটিকে পৃথিবীর নবম নিউক্লিয়ার শহর হিসেবে ধরা হয়।
১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল বিকেল পর্যন্তও এই শহরের জনসংখ্যা ছিল ৪৯ হাজারের বেশি। কিন্তু ওই দিন বিকেলে চেরনোবিল দুর্ঘটনার পরই শহরটি পরিত্যক্ত ও জনশূন্য হয়ে পড়ে। সরিয়ে নেওয়া হয় সব বাসিন্দাকে।
এখন ধীরে ধীরে শহরে রেডিয়েশন কমে গেছে এবং অনেক পর্যটক শহরটি দেখতে গেলেও স্থায়ীভাবে এখানে বসবাস করেন না কেউ।
ওরাডর-সুর-গ্লান, ফ্রান্স
একসময় ফ্রান্সের এই গ্রামে ছিল জেলেদের বসবাস। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা গ্রামটিকে ভুতুড়ে গ্রামে পরিণত করেছে।
নাৎসি পার্টির এসএস সংগঠনের একটি সামরিক শাখা 'ওয়াফেন এসএস' দ্বারা ওই স্থানের বেশিরভাগ মানুষকে হত্যা করা হয়। যুদ্ধকালীন নেতা চার্লস ডি গল পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেন, ওরাডর-সুর-গ্লানকে নাৎসি নিষ্ঠুরতার প্রমাণ হিসেবে মানুষের বসবাসের জন্য নিষিদ্ধ থাকবে।
১৯৪৪ সালের ১০ জুন থেকে জায়গাটি একরকম সুনশান পরিত্যক্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে।
১৯৯৯ সালে সেখানে একটি স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়।
ওয়াররাম পার্সি, যুক্তরাজ্য
ইতিহাস জুড়ে যুক্তরাজ্যের অনেকগুলো গ্রাম পরিত্যক্ত হয়েছে। ওয়াররাম পার্সি ইংল্যান্ডের মধ্যযুগীয় একটি গ্রাম। গ্রামটিকে এখন শুধু একটি মাত্র ভাঙ্গা ভবন রয়েছে।
একসময় এখানে চমৎকার দুটি জমিদার বাড়ি ও একটি গির্জা ছিল। ভবনগুলো তৎকালীন সম্ভ্রান্ত পার্সি পরিবার দ্বারা নির্মিত।
গ্রামের জনসংখ্যা বছরের পর বছর ধরে হ্রাস পেতে থাকলে, শেষ অবশিষ্ট বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা হয়।
বর্তমানে ইংলিশ হেরিটেজ স্থানটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে।
হাশিমা দ্বীপ,জাপান
নাগাসাকির উপকূলে অবস্থিত এই দ্বীপ ব্যাটলশিপ আইল্যান্ড নামেও পরিচিত।
জাপানের দক্ষিণভাগে অবস্থিত এই দ্বীপ। নাগাসাকি শহর থেকে এর দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত এই দ্বীপে বাস করতেন পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ।
২০১৫ সালে এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায়। কিন্তু এই শহরের অতীত ইতিহাস অন্ধকারে মোড়ানো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক হাজারেরও এ বেশি কোরিয়ান এবং চীনা বেসামরিক নাগরিক এবং যুদ্ধবন্দী এখানে মারা যান বলে জানা গেছে।
এই দ্বীপে একসময় কয়লা আবিষ্কার হয়। ১৮৮৬ সালে সমুদ্রের নিচে খোঁজ মেলে কয়লার খনির। কিন্তু কয়লার জোগান ফুরিয়ে আসতেই ১৯৭৪ সাল থেকে ধীরেধীরে ফাঁকা হতে শুরু করে এই দ্বীপ।
২০০০ সাল পর্যন্ত হাশিমা দ্বীপ পরিত্যক্ত অবস্থাতেই ছিল। দ্বীপটি ভূতের দ্বীপ নামে পরিচিতি পায়। এরপর জাপান সরকার এই দ্বীপের কিছু বাড়ি মেরামত করলে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ে।
ক্র্যাকো, ইতালি
ইতালির সুদূর দক্ষিণে এটি অবস্থিত। দর্শনীয় এবং আর্কষণীয় স্থাপত্য থাকায় এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন পরিত্যক্ত শহরগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছে।
১৯৬০-এর দশকে পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য মাটি খুড়লে সেখানে ভূমিধসের সৃষ্টি হয়। ফলে বাসিন্দাদের অনেকেই স্থানটি ছেড়ে চলে যায়। ১৯৮০ সালে ইরপিনিয়া ভূমিকম্পের প্রেক্ষিতে ক্র্যাকো সম্পূর্ণ নির্জন হয়ে পড়ে।
তারপর থেকে ভূতের শহরটি কেবল হাজার হাজার পর্যটকদেরই আকর্ষণ করেনি, এটি একটি জনপ্রিয় স্থানও হয়ে উঠেছে শুটিংয়ের জন্য। ২০০৮ সালে জেমস বন্ডের 'কোয়ান্টাম অব সোলেস'-এর মতো চলচ্চিত্রের শুটিং এখানে হয়েছে।
কোলমানস্কোপ, নামিবিয়া
মরুভূমির রাজ্য নামিবিয়ার কোলমানস্কোপ যেন এক জনশূন্য ভূতুড়ে শহর।
জাকারিয়াস লেওয়ালা নামক স্থানীয় এক কর্মী ১৯০৮ সালে এখানে হীরা আবিষ্কার করার পর শহরে মানুষের বসবাস বাড়তে থাকে।
অনেকগুলো ভবন বালিতে অর্ধ-নিমজ্জিত থাকার কারণে ভূতুড়ে শহর হিসেবে এর গুঞ্জন উঠে। ১৯৫৬ সালে ধীরেধীরে পরিত্যক্ত হয়ে যায় শহরটি। কালক্রমে গোটা শহরটিকে গিলে ফেলে মরুভূমি।
যদিও এখনও মরুভূমির মাঝেই সেই শহরের কিছু বাড়ির নান্দনিক সব সাজসজ্জা দেখতে পাওয়া যায়। পর্যটকরা এখানে দেখতে আসে কিভাবে একটা গোটা শহর মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।
গ্র্যান্ড-বাসাম, আইভরি কোস্ট
গ্র্যান্ড-বাসাম শহরটি আইভরি উপকূলের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে আবিদজান শহরের কাছাকাছি অবস্থিত।
এখনও মানুষজন এই শহরে বাস করছে, কিন্তু এখানের অনেকগুলো বিল্ডিং বছরের পর বছর ধরে খালি পড়ে আছে। গ্র্যান্ড-বাসমের ইতিহাস ফরাসিদের চেয়ে অনেক বেশি আগের।
১৫ শতক থেকে এখানে লোকে বসবাস করত বলে মনে করা হয়।
রুবি, অ্যারিজোনা
মেক্সিকো সীমান্তের খুব কাছেই এই শহরটি অবস্থিত। গত শতাব্দীর প্রথম দিকে রুবি একটি খনির শহর ছিল।
সেখানে সোনা, রৌপ্য, দস্তা এবং তামা ব্যাপক হারে উত্তোলিত হতো। ১৯২০ এর দশকের প্রথম দিকে এখানে খনি কারখানায় দুটি খুনের ঘটনা ঘটে।
খনিটি ১৯৪০ সালে বন্ধ হয়ে যায় এবং পরের বছর নাগাদ শহরটি বেশিরভাগই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। রুবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি প্রসিদ্ধ ভূতের শহরগুলোর মধ্যে একটি।
ব্যাঙ্কহেড, কানাডা
ব্যাঙ্কহেড কানাডার রকি পর্বতমালায় অবস্থিত। রাজকীয় ব্যানফ ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত হওয়ায় অনেক দৃষ্টিনন্দন পাহাড় দেখতে পাওয়া যায়। এখানে একটি কয়লার খনি ছিল যেখানে প্রায় ১০০০ জন লোক কাজ করতো।
১৯২২ সালে শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে খনিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে এর অনেক কাজ এবং ভবন সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। তারপর থেকে শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
বোডি, ক্যালিফোর্নিয়া
উনিশ শতকের গোড়ায় ক্যালিফোর্নিয়ার বোডিতে সোনার খনির খোঁজ মেলে। সেই সময় লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে এই শহর। লোকেরা তাদের ভাগ্য গড়তে নেভাদা সীমান্তের কাছে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া শহরে ছুটে আসে।
ছোট্ট সুন্দর এই শহরটিতে একসময় ৫০০০-৭০০০ নাগরিক বসবাস করত। অন্যান্য শহর প্রাধান্য পাওয়ার পর বিশ শতকের শেষের দিকে শহরটির গড়িমা কমতে শুরু করে।
১৯২০ সালে এর জনসংখ্যা মাত্র ১২০-এ নেমে আসে। নির্জন শহরের সুসংরক্ষিত বিল্ডিংগুলো আজ ওয়াইল্ড ওয়েস্ট পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
ভরকুটা, রাশিয়া
ভরকুটা রাশিয়ার উত্তর মেরুঅঞ্চল। কয়লার খনির জন্য এই শহরটি এক সময় প্রাণকেন্দ্র ছিল।
১৯৩০-১৯৬০ দশকে খনিটি কারাবন্দীদের দ্বারা খনন করা হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে খনি শ্রমিকরা উচ্চ বেতনের জন্য নৃশংস এই জায়গায় কাজের শুরু করেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যখন খনির কাজ বন্ধ হয়ে যায়, তখন স্থানীয়রা চলে যায়। এভাবেই জায়গাটি বরফে ঢাকা নিস্তব্ধ, পরিত্যক্ত শহর হয়ে উঠে।
- সূত্র- সিএনএন