স্বাধীনতার ৫০ বছর পর চার চাকার গাড়ি দেখেছে যে জনপদের মানুষ
গহিন হাওরের বুক ভেদ করে ছুটে চলছে দুটি চার চাকার গাড়ি। আর দু'পাশের গ্রাম-জনপদে দাঁড়িয়ে গাড়ি দুটির ছুটে চলার দৃশ্য দেখছেন হাজারো মানুষ।
ঘণ্টাখানেক পর গাড়িগুলো গিয়ে পৌঁছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ের সামনে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এলাকায় প্রথমবারের মতো গাড়ি দেখতে পেয়ে স্থানীয়দের চোখেমুখে অন্য রকমের এক আনন্দ। এই স্মৃতিকে ধরে রাখতে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন অনেকে। কেউ কেউ উঠে গিয়ে বসেন গাড়ির সিটেও।
সম্প্রতি (গত ১২ জানুয়ারি) নেত্রকোনার হাওরদ্বীপ খ্যাত খালিয়াজুরী উপজেলা সদরে এমন 'বিরল দৃশ্যের' সূচনা হয়। এই গাড়ি দুটির আগে আর কোনোদিন চার চাকার গাড়ি পৌঁছেনি ওই দুর্ভেদ্য উপজেলার সদরে। এমনকি এর পরেও যায়নি আর কোনো গাড়ি। হাওরের দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থাই এর কারণ।
জানা গেছে, ফাইজার কোম্পানিতে তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা বহন করতে হয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) গাড়িতে করে। মূলত এই অঞ্চলে টিকা বহন করে এনেছে গাড়ি দুটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খালিয়াজুরীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এএইচএম আরিফুল ইসলাম বলেন, "গাড়ি পৌঁছানোর রাস্তা না থাকায় স্বাস্থ্য বিভাগ খালিয়াজুরীর টিকা কার্যক্রম পাশ্ববর্তী মদন উপজেলায় স্থানান্তর করতে চেয়েছিল। কিন্তু এখানকার বাসিন্দারা মদনে গিয়ে টিকা গ্রহণ করতে অমত প্রকাশ করেন। তাই আমরা এটিকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। তাতে সফলও হয়েছি।"
ইউএনও বলেন, জেলা সদর থেকে গাড়ি দুটি প্রথমে মদন উপজেলার উচিতপুর পর্যন্ত আনা হয়। এরপর উচিতপুর থেকে সাবমার্জিবল সড়কের (ডুবন্ত সড়ক) ওপর দিয়ে চালিয়ে আনা হয় খালিয়াজুরীর রসুলপুরে অবস্থিত ধনু নদীর ঘাট পর্যন্ত। পরে একটি ফেরিনৌকা দিয়ে ধনু নদী পার করে আবার সাবমার্জিবল সড়ক দিয়ে উপজেলা সদরে আনা হয়।
তিনি আরও জানান, ধনু নদীতে গাড়ি পারাপারের ফেরি না থাকায় কিশোরগঞ্জ থেকে ১৫ হাজার টাকায় একটি স্টিলের তৈরি প্রশস্ত নৌকা ভাড়া করে আনতে হয়েছে। তাছাড়া নৌকায় গাড়ি ওঠানোর জন্য নদীর দুই পাড়ে এসকেভেটরের সাহায্যে বানাতে হয়েছে এ্যাপ্রোচ ঘাট।
"ইউএনও ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নামে বরাদ্দ হওয়া ওই গাড়ি দুটিকে বর্ষার আগেই আবারও একই কায়দায় জেলা সদরে পাঠিয়ে দিতে হবে। কারণ, তখন সাবমার্জিবল সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যাবে। গাড়ি চালানোর মতো আর কোন রাস্তা থাকবে না," যোগ করেন তিনি।
জানা গেছে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও খালিয়াজুরী উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা এমনই করুণ। জেলার ১০ উপজেলার মধ্যে খালিয়াজুরীই একমাত্র উপজেলা যা আজও সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
এই দুর্গম জনপদ বছরের অন্তত ছয়মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে। তখন গহিন হাওরের বুকে দ্বীপের মতো ভাসে একেকটি গ্রাম। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে, এমনকি এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতেও যেতে হয় নৌকা দিয়ে। আর বাকি ছয়মাস শুষ্ক মৌসুম বিরাজ করলেও বেশিরভাগ রাস্তা চলতে হয় পায়ে হেঁটে।
খালিয়াজুরী সদর থেকে মদনের উচিতপুর পর্যন্ত একটি সাবমার্জিবল সড়ক আছে, যা দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে জেলা সদরে যাতায়াত করা যায়। কিন্তু রসুলপুর এলাকায় ধনু নদীতে কোন সেতু বা ফেরি না থাকায় এই সড়ক দিয়ে কোন ভারি যানবাহন চলতে পারে না। নদীর ঘাট পর্যন্ত কিছু অটোরিক্সা চলে। এছাড়া খালিয়াজুরী উপজেলার অভ্যন্তরের ছয়টি ইউনিয়নে যাতায়াত করার জন্যও কোন উঁচু সড়ক নেই। দু-তিনটি সাবমার্জিবল সড়কে শুষ্ক মৌসুমে পায়ে হেঁটে অথবা অটোরিক্সায় যাতায়াত করতে হয়। ভারি মালামাল পরিবহন করতে গিয়ে পোহাতে হয় নানান বিড়ম্বনা। খরচ করতে হয় দ্বিগুন থেকে তিনগুন।
খালিয়াজুরী সদরের পুরানহাটি গ্রামের তরুণ মহসিন মিয়া বলেন, "খালিয়াজুরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও দেশের যে কোন উপজেলার চেয়ে অনেক দুর্গম। ২০১৭ সালের মে মাসে অকালবন্যার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন খালিয়াজুরী উপজেলা সফর করেন- তখন তার (প্রধানমন্ত্রীর)গাড়িও এখানে আনা সম্ভব হয়নি। তিনি হেলিকপ্টারে করে আসেন।"
তবে স্থানীয়রা মনে করেন, একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনার ছকে আনলেই খালিয়াজুরীকে সম্পূর্ণ বদলে দেওয়া যায়। এমনকি কাজে লাগানো যায় এখনকার ধান ও হাওরের মৎস্যসম্পদকে ঘিরে সৃষ্ট অপার সম্ভাবনাকেও।
খালিয়াজুরী উপজেলা নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক স্বাগত সরকার শুভ বলেন, খালিয়াজুরীতে মদন ও মোহনগঞ্জ উপজেলার দুদিক দিয়ে দুটি রাস্তা ঢুকেছে। মোহনগঞ্জ থেকে শুরু হওয়া উঁচু রাস্তাটি শেষ হয়েছে খালিয়াজুরীর বোয়ালী বাজারে গিয়ে। আর মদনের উচিতপুর থেকে শুরু হওয়া সাবমার্জিবল রাস্তাটি শেষ হয়েছে রসুলপুর ঘাটে গিয়ে। তাই বোয়ালী বা উচিতপুর থেকে খালিয়াজুরী সদর পর্যন্ত একটি উঁচু সড়ক নির্মাণ করলেই জেলা সদরের সঙ্গে খালিয়াজুরীর স্থায়ী যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। এমনকি রাস্তাটি সম্প্রসারণ করা যাবে খালিয়াজুরীর শেষ প্রান্তে অবস্থিত কৃষ্ণপুর বাজার পর্যন্তও।
তা করা গেলে শুধু জেলা সদরের সঙ্গে না, পাশ্ববর্তী সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার সঙ্গেও নেত্রকোনা সদরের সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। আর এর মধ্য দিয়ে বদলে যাবে গোটা হাওর এলাকার যোগাযোগ চিত্র। তবে এ জন্যে অবশ্য রসুলপুরে ধনু নদীতে এবং কৃষ্ণপুরে সুরমা নদীতে দুটি বড় সেতু বা ফেরির ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া সড়কের মাঝে নির্মাণ করতে হবে বেশ কিছু কালভার্ট ও স্লুইজগেট, যাতে হাওরের পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকে।
খালিয়াজুরীর কৃষ্ণপুর সরকারি কলেজের শিক্ষক ইকবাল হাসান বলেন, "শুধুমাত্র যোগাযোগের অব্যবস্থার কারণে এখানকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি- সবকিছু পিছিয়ে আছে। সড়কের অভাবে হাওরের শিক্ষার্থীরা বর্ষাকালে স্কুল-কলেজে আসতে পারে না। নিয়মিত ক্লাস করতে পারে না। কেউ গুরুতরভাবে অসুস্থ হলে তাকে সহজে জেলা সদরের হাসপাতালে বা ময়মনসিংহ মেডিকেলে নেওয়া সম্ভব হয় না।
"যোগাযোগের অব্যবস্থাপনার কারণে চিকিৎসক-কর্মচারীরাও থাকতে চান না এখানে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন করে চিকিৎসক সাপ্তাহিক ভিত্তিতে পালাক্রমে ডিউটি করেন। অনেক সরকারি কর্মচারী মাসের বেশিরভাগ সময় গড় হাজির থাকেন। জেলার বড় কর্তারাও এসব জানেন, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা পদক্ষেপ নিতে আসেন না," বলেন তিনি।
তিনি আরও যোগ করেন, খলিয়াজুরী উপজেলায় অন্তত ৩০-৪০টি জলমহাল আছে। এ সব জলমহাল থেকে বিপুল পরিমাণ মাছ আহরণ করা হয়। এছাড়ার বর্ষার ভাসান পানি থেকেও প্রতিবছর শত শত মেট্রিক টন মাছ আহরণ করা হয়। নৌপথে এসব মাছ ঢাকা কিংবা অন্যান্য জেলায় সরবরাহ করতে গিয়ে ব্যাপক খরচ গুনতে হয়। অনেক সময় বৈরি আবহাওয়ায় পড়লে রাস্তায় মাছ পচে নষ্ট হয়। এসব কারণে ন্যায্য দামও পাননা জেলেরা।
খালিয়াজুরী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সুমন চক্রবর্তী বলেন, "বিপুল পরিমাণ বোরো ধান উৎপাদনের কারণে খালিয়াজুরীকে বলা হয় শস্যভাণ্ডার। কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থার অভাবে এখানকার বোরো চাষীরা কোনো সময়ই ধানের ন্যায্য দাম পান না। তারা বাড়িতে নৌকা নিয়ে আসা ফড়িয়াদের কাছে কমদামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন। উন্নত রাস্তাঘাট হলে তা করতে হতো না।"
সুমন আরও বলেন, "আমাদের পাশের উপজেলা মোহনগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত উড়াল সড়ক নির্মাণ হচ্ছে। এরই প্রকল্পটি একনেকের সভায় অনুমোদিতও হয়েছে। খালিয়াজুরীতেও এমন একটি সড়ক নির্মাণ করা যেতে পারে। এ ধরনের সড়ক হলে হাওরের বৈশিষ্ট্য বা জীববৈচিত্র্যের কোন ক্ষতি হবে না।"
খালিয়াজুরীর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবুর রহমান বলেন, "হাওরাঞ্চলে অবস্থিত এ উপজেলার প্রধান সমস্যা হচ্ছে সড়ক যোগাযোগ না থাকা। এখানকার ইউএনও, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও), সহকারি কমিশনার (ভূমি) এবং থানার জন্য কয়েকটি সরকারি গাড়ি বরাদ্দ থাকলেও রাস্তার অভাবে একটি গাড়িও চালানো সম্ভব হয় না। এই গাড়িগুলো জেলা সদরে বা পাশের উপজেলায় লক করে রাখা হয়। এমন অবস্থায় জরুরী প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা বা পুলিশ বাহিনীর ঘটনাস্থলে পৌঁছতে অনেক সময় লেগে যায়। আবার বর্ষায় বৈরি আবহাওয়া থাকলে যাওয়াই সম্ভব হয় না।"
খালিয়াজুরীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এএইচএম আরিফুল ইসলামও এসব সমস্যার কথা উল্লেখ করে বলেন, "জেলা সদরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলে এখানকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি-সবকিছুতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগবে। জীবনযাত্রা আধুনিক হবে। এমনকি হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দের্যকে ঘিরে এটি একটি পর্যটন এলাকায়ও পরিণত হবে।"
তিনি উল্লেখ করেন, হাওরের সৌন্দর্যর টানে এখানে প্রতিদিন বিপুল দর্শনার্থী আসেন। কিন্তু সড়ক না থাকায় তারা নানা ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নেত্রকোনা সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী হামিদুল ইসলাম বলেন, "মদনের উচিতপুর থেকে খালিয়াজুরী পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণের চিন্তা আমাদের মাথায় আছে। তবে এটি অলওয়েদার সড়ক হবে, নাকি উড়াল সড়ক হবে- আগে সেটির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে। এছাড়া আপাতত সাবমার্জিবল সড়কটিকে যানবাহন চলাচলের উপযোগী করে রাখতে ধনু নদীতে একটি ফেরি সার্ভিস চালুর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।"
গত ২৩ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত একটি প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আশা করা যাচ্ছে শীঘ্রই ফেরিটি চালু করা সম্ভব হবে।"
স্থানীয়রা জানান, খালিয়াজুরীতে অল ওয়েদার সড়ক নির্মাণ এবং ধনু নদীতে ফেরি সার্ভিস চালুর দাবিতে বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধনও করেছেন সেখানকার বাসিন্দারা।