‘এটা ইরাক অথবা আফগানিস্তান না: ইউক্রেন যুদ্ধ উন্মোচিত করেছে পশ্চিমা গণমাধ্যমের বর্ণবিদ্বেষ’
এটা কি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় নয় যে গত কয়েক বছর ধরে 'শ্বেতকায় বিশেষাধিকার'-এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠস্বরগুলো আজ সবচেয়ে বর্ণবাদী চেহারা উন্মোচন করছে, বিশেষত: যখন আপনি তাদের পাদপ্রদীপের আলোর নিচে মেলে দেখছেন? আজ এই পাদপ্রদীপের আলোটি হলো ইউক্রেন যেখানে পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমের নির্লজ্জ ও অন্তর্নিহিত বর্ণবিদ্বেষ, ভাল বা নিরাপদ সময়ে যতই লুকানো থাক, আজ সবার সামনে এসেছে।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের এই বর্ণবিদ্বেষের দু'টো স্তর আছে- পূর্ব ইউরোপের প্রতি পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার সহজাত বর্ণবিদ্বেষ ও 'বাদামী বর্ণ' মানুষদের প্রতি ঢের বেশি নির্লজ্জ বর্ণবিদ্বেষ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কালো জীবন যখন মাত্রই বিবেচনার বিষয় হয়ে উঠেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের কালো জীবন, ক্কচিৎ কদাচিৎ বিবেচনার বিষয় হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে মনে করা যেতে পারে যে রুয়ান্ডায় গণহত্যার সময় পৃথিবী কতটুকু আদৌ পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং সত্যি বলতে কিছুই করেনি। দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধ যা পরে কিভু যুদ্ধ হিসেবেই বেশি পরিচিত হয়ে উঠলো বা কিভু যুদ্ধ নামেই যার রূপান্তর হলো, সেই যুদ্ধ থেকে আমরা খুব বেশি হলে কিছু মানবিক গল্প পেয়েছি। এই যুদ্ধ ছিল মূলত: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আফ্রিকীয় সংস্করণ, এবং এই যুদ্ধে বিভিন্ন দেশ যুদ্ধে জড়িত বিভিন্ন পক্ষকে সমর্থন দেওয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু এবং কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
সত্যি কথা বলুনতো, গুগল সার্চ না করে আপনারা ক'জন আসলে দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধ, ইতুরি যুদ্ধ এবং কিভু যুদ্ধ সম্পর্কে শুনেছেন বা জেনেছেন বা বলতে পারবেন? আমার ধারণা বলতে গেলে কেউই কিছু বলতে পারবেন না। একইভাবে সারা বিশ্বের 'বাদামি ত্বকে'র মানুষদের সম্পর্কে আমরা বলতে গেলে কোনো সহানুভূতি-ই দেখতে পাই না- সত্যি বলতে এই চলতি হ্যাশট্যাগের সময়ে একটি 'বাদামী জীবন'ও সাদা পৃথিবীর বিবেচনার বিষয় নয়।
ভেবে দেখুন যে কীভাবে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি, এমএসএনবিসি (আগে যে যে নামে বা রূপে পরিচিত ছিল) ইরাকের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত সব ভয়ানক নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করেছে যা কিনা ইরাকে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যুর কারণ হয়েছে। এর সঙ্কীর্ণতম চেহারা আমরা দেখতে পাই যখন উদারনৈতিক গণমাধ্যমের পছন্দের মানুষ এবং অযোগ্যতার জন্য কুখ্যাত ও স্মরণীয়ভাবে দূর্নীতিগ্রস্থ 'কূটনীতিক' ম্যাডেলিন অলব্রাইট- ক্লিন্টন প্রশাসনের ঘনিষ্ঠতম মিত্রদের সৃষ্ট এই রাজনীতিককে জিজ্ঞাসা করা হয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে তার মেয়াদকালে 'আমাদের দেশ কি ইরাকে মানবিক সাহায্য দিচ্ছে না- মৃত্যু?'
নাজি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বা বন্দী শিবিরের রক্ষীর মত তার উত্তর ছিল, 'সাদ্দাম হোসেনের চেয়ে ইরাকের মানুষের জন্য আমরা বেশি মমতা বোধ করে থাকি।' বর্তমানে তিনি একজন সেলিব্রিটি মিডিয়া আলোচক এবং তিনি নিজেই তার কোম্পানিটি পরিচালনা করেন যা মার্কিনী ব্যবসায় স্বজনপ্রীতিমূলক সংযোগ বিষয়ে তাঁর এই কোম্পানিটি কাজ করে।
পাশাপাশি তুলনা করুন আজ ইউক্রেনে বোমা হামলার প্রেক্ষিতে সারা বিশ্ব জুড়ে যে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দিচ্ছে তার মাত্রা বা পরিসরকে! ইউক্রেনে এখনো পর্যন্ত ২০০'র বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়নি- যা আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায় মার্কিনী আক্রমণ, দখল ও হামলায় সূচীত মৃত্যুর ভগ্নাংশও নয়। মনে রাখবেন যে এটা শুধুই নিরেট বর্ণবিদ্বেষ নয়- এটা একটি জটিল প্রপঞ্চও বটে যা 'যথেষ্ট শ্বেতকায় নয়' এমন মানুষদেরও অন্তর্ভুক্ত করে।
মনে রাখবেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী আইরিশ ক্যাথলিকদের শুরুতে 'আসলে শ্বেতকায় নয়' হিসেবে বিবেচনা করা হতো যতক্ষণ পর্যন্ত না ইতালীয় অভিবাসীদের ঢল সেদেশে শুরু হলো এবং ফলে আইরিশদের যেন এক ধরণের সম্মান বা সৌজন্যসূচক হিসেবেই 'সাদা' হিসেবে গণনা করা শুরু হলো। ইতালীয়দেরও আইরিশদের মত একই ভাগ্য সইতে হয়েছে যতদিন না ইহুদিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আক্রমণ শুরু করলো এবং শ্বেতকায় এ্যাংলো-স্যাক্সন প্রটেস্ট্যান্টদের সাথে টিকে থাকতে ইহুদিদের দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়েছে। 'দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস'-এর মালিক স্যুলজবার্জারস (যারা নিজেরাই ছিলেন ইহুদি) তাদের 'ইহুদি পরিচয়'কে ততটা সামনে আনতেন না এবং এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি হলোকাস্ট বা গণহত্যার অনেক সংবাদ তারা চেপে গেছেন- শুধুমাত্র 'টিকে থাকা'র জন্য।
১৯৬০ ও '৭০-এর দশক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের যে বহু-জাতিত্বমূলক প্রকৃতি দেখা দেয় তার প্রেক্ষিতেই ইহুদিদেরও ইতালীয় ও আইরিশদের মত সম্মান সূচক 'শ্বেতকায়' মর্যাদা দেওয়া হয়। ঘটনাক্রমে, 'সম্মানসূচক শ্বেতকায়' কোন বানানো শব্দ নয়- দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনকালে এটি ছিল একটি 'আইনী' শব্দ যা জাপানী, তাইওয়ানী এবং দক্ষিণ কোরীয় ব্যবসার সুযোগ বা অভিগম্যতা পাবার জন্য তৈরি করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যবহৃত এই আইনী পরিভাষাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে 'অবর্ণিত বাস্তবতা' হয়ে দাঁড়ায়।
অতীতে এই অবর্ণিত বাস্তবতা সব অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ান বা পূর্ব ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছে- পশ্চিমা এক দেশের এক প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি কিনা এখন ইউক্রেন বিষয়ে খুবই সোচ্চার, আজ থেকে নয় বছর আগে স্কচের গ্লাস হাতে আমাকে বলেছিলেন, 'রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুশ শুধুমাত্র দু'টো বিষয়ে ভাল- ভদকা ও পতিতা।' অবর্ণিত এই বাস্তবতার ধীর পরিবর্তন ইউক্রেন যুদ্ধে সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সার্বিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত ও বেআইনী পন্থায় বোমা ফেলা শুরু করেছিল, সেসময়কার 'টাইম' ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের সাথে আজ রাশিয়ার করা ইউক্রেনে একই মাপের বিধিবহির্ভূত ও বেআইনী বোমা হামলার তুলনা করুন। তবে এবার এই বর্ণবাদের ব্যপ্তি আরো বেড়েছে। বেড়েছে একারণে যে এবার প্রাথমিক অপরাধবোধের দায় যেন সব বামমনা সংগঠনের ঘাড়ে চেপেছে যারা কিনা সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতা বিষয়ে সর্বদাই উচ্চকণ্ঠ থাকে।
এ্যালান ম্যাকলিয়ড, একজন নিরপেক্ষ গণমাধ্যম বিশ্লেষক, সংবাদমাধ্যম থেকে নানা মন্তব্য সঙ্কলন করে একটি থ্রেডে নিয়ে এসেছেন: বিবিসিতে একজনকে কথা বলতে দেখানো হয় যিনি বলছিলেন যে তিনি কেন 'সোনালী চুল ও নীল চোখের শ্বেতাঙ্গদের বোমা হামলার শিকার হতে দেখে মানসিকভাবে এতটা বিপর্যস্ত বোধ করছেন। সিবিএস-এর এক প্রতিবেদক দাবি করেন যে তিনি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত বোধ করছেন যেহেতু 'এটা ইরাক বা আফগানিস্তান নয়...এটা তুলনামূলকভাবে সভ্য, তুলনামূলকভাবে ইউরোপীয় এক শহর।'
বিবিসি-র প্রাক্তন সাংবাদিক ও বর্তমানে আল জাজিরায় কর্মরত সাংবাদিক পিটার ডোব্বি বলেন, 'সবচেয়ে যেটা মনের উপর চাপ সৃষ্টিকারী সেটা হলো এদের দিকে তাকানো, এদের পোশাকের ধরণ। এরা সবাই স্বচ্ছল, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এরা স্পষ্টত: মধ্যপ্রাচ্য বা উত্তর আফ্রিকা থেকে পালানোর চেষ্টা করতে থাকা উদ্বাস্তুরা নয়। এরা যে কোন ইউরোপীয় পরিবারের মত দেখতে যারা তোমার পাশের বাসায় থাকে।'
সবচেয়ে বেশি বিষ্মিত করেছে অতিরিক্ত সোচ্চার এনবিসি, 'খুব মোটা দাগে বললে, এরা সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থী নয়, এরা ইউক্রেনের শরণার্থী...তারা খ্রিষ্টান, তারা শ্বেতকায়। তারা আমাদের সাথে খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ।'
তাহলে বুঝে দেখুন- খোলাখুলি ভাবে বর্ণনা করা হয়নি বলেই এ তো অসত্য নয়। ঘটনা হলো আপনার জীবনের আসলে কোন গুরুত্ব নেই। অতীতে পশ্চিমা গণমাধ্যমের উপর আক্রমণকে 'বর্ণবাদী' হিসেবে আখ্যায়িত করা হলে সেই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে এগুলো 'ডানপন্থী প্রচারণা।'
কাশ্মিরে ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ প্রত্যাহার করার সময় বিবিসির প্রাক্তন সাংবাদিক নিকোলা করিমের নির্লজ্জ এবং প্রদর্শনযোগ্য মিথ্যা ও গত বছর কোভিডে বিপুল মৃত্যুর সময় 'দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে' ভারতীয় শেষকৃত্যের রীতি অনুযায়ী চিতাদাহের ছবি যে অশ্রদ্ধার সাথে প্রকাশিত হয়, তা যেন বাস্তবিকই 'অধিকার লঙ্ঘনকারী' সাংবাদিকতার প্রতীক। কিন্তু যখন আপনি সবগুলো পশ্চিমা গণমাধ্যমে একটি নিয়মতান্ত্রিক বা বিধিবদ্ধ, সর্বব্যপী বর্ণবাদের প্রদর্শনী লক্ষ্য করেন, তখন একথাই আরো স্পষ্টত মনে হয় যে সবাই যেন এসব ঘটনা উপেক্ষা করতে চাচ্ছে বা বলতে চাচ্ছে যে এসব কখনো ঘটেনি।
লেখক: ভারতীয় 'ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো। লেখাটি সম্প্রতি ভারতের 'নিউজ এইটিন' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী