রমজানের আগে ভোগ্যপণ্যের পর্যাপ্ত আমদানি
রমজানকে ঘিরে দেশে যেসব ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে সেসব পণ্যের আমদানি বেড়েছে। ফলে রোজায় ভোগ্যপণ্য সরবরাহে ঘাটতির আশঙ্কা নেই।
তবে আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং দর বেড়ে যাওয়ায় দেশিয় বাজারেও কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
দেশে ১৮ মার্চ পবিত্র শবে বরাতের পর রোজার নিত্যপণ্যের মূল বেচাকেনা শুরু হবে। সাধারণত রোজা উপলক্ষে যেসব পণ্য বেচাকেনা হয়, তা আমদানি হয় এর আগের দুই থেকে আড়াই মাসে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস এর তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ছোলা আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার টন, যা গত বছরের চেয়ে মাত্র দুই হাজার টন কম। যদিও চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এসেছে আরও প্রায় ২৮ হাজার টন ছোলা।
চলতি মার্চের প্রথম সপ্তাহে বন্দর থেকে খালাস হওয়া ছোলার গড় দাম পড়েছে প্রতি কেজি ৫৫ টাকা, যা আগের দুই মাসের তুলনায় কেজিপ্রতি মাত্র ১ টাকা বেশি। বাজারে এখন সাধারণ ছোলা বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭০ টাকায়। একটু ভালো ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা দরে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৭৫ টাকা।
গত বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এ বছর একই সময়ে সয়াবিন তেল, পামতেল, সয়াবীজ, গম, চিনি, মসুর ডাল ও পেঁয়াজের আমদানি বেড়েছে।
গতবারের তুলনায় এ বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে মসুর ডালের আমদানি ৫০ হাজার টন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার টন। সেই সঙ্গে বেড়েছে আমদানি মূল্যও। গত বছর খোসাসহ মসুর ডালের আমদানি মূল্য ছিল গড়ে কেজিপ্রতি ৪৯ টাকা। এবার কেজিপ্রতি ২৭ টাকা বেড়ে হয়েছে ৭৬ টাকা। অবশ্য মার্চে আসা নতুন চালানের আমদানি মূল্য আরও বেড়ে প্রতি কেজি গড়ে ৮০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
সব মিলিয়ে গত বছরের চেয়ে এ বছর মসুর ডালের গড় আমদানি মূল্য কেজিপ্রতি ৩২ টাকা বেড়েছে। খুচরা বাজারে বড় ও মাঝারি দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৯৫ থেকে ১১৫ টাকা দরে।
গত বছরের তুলনায় এ বছরের প্রথম দুই মাসে মটর ডালের আমদানি মূল্য ৭ টাকার মতো বেড়ে গড়ে কেজি ৩৭ টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিপরীতে বাজারে দাম ইতিমধ্যে ১০ টাকা বেড়েছে। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরে।
দেশে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৮৮ হাজার টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ লাখ ৬০ হাজার টন বেশি। অপরিশোধিত চিনির আমদানি মূল্য প্রতি কেজি গড়ে ১১ টাকা বেড়ে প্রায় ৩৯ টাকা দাঁড়িয়েছে। খুচরা বাজারে এখন চিনির দাম কেজি ৭৮ থেকে ৮০ টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ১০ থেকে ১৩ টাকা বেশি।
গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে সয়াবিন ও পাম তেল মিলিয়ে ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬০ হাজার টন বেশি। সয়াবিন তেল উৎপাদনের কাঁচামাল সয়াবীজও ৩৯ হাজার টন বেশি আমদানি হয়েছে।
এক বছরে খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে লিটারপ্রতি প্রায় ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা। আর বোতলের তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দুই মাসের হিসাবে গত বছরের তুলনায় পাম তেলের আমদানি মূল্য বেড়েছে লিটারপ্রতি ৩২ টাকা। বাজারে দাম বেড়েছে ৫০ টাকার বেশি। এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে লিটারপ্রতি ১৫৩ থেকে ১৬৫ টাকায়। এখন খোলা সয়াবিন ও পাম তেল পাওয়া যাচ্ছে না বলে বাজারদরের তালিকায় উল্লেখ করছে টিসিবি।
গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পেঁয়াজ আমদানিও দ্বিগুণ হয়েছে, পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৩ হাজার টন।
ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রমজান মাসের কেনাবেচা শুরু হলে আমদানিকারকরা বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়ে দাম বাড়িয়ে দেন। এবার যেহেতু রোজা উপলক্ষে পণ্য দেশে আসার পর বিশ্ববাজারে দাম আরও বেড়েছে, সেহেতু সেই সুযোগ নেওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ববাজার পরিস্থিতির কারণে মানুষের মধ্যে সরবরাহ ঘাটতির আতঙ্ক তৈরি হতে পারে।
খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী মেসার্স তৈয়বিয়্যা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সোলায়মান বাদশা বলেন, ছোলাসহ রমজানের সব পণ্যের র্পযাপ্ত আমদানি ও সরবরাহ রয়েছে। তবে বিশ্ববাজার থেকে পণ্য আমদানি হয়েছে আগের চেয়ে বেশি দামে। এরপরও বুকিং দর বৃদ্ধির অজুহাতে রমজানকে ঘিরে আমদানিকারকরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রোজায় আর যাতে দাম না বাড়ে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।
ভোগ্যপণ্যের বড় আমদানিকার প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের ডিরেক্টর অপারেশন তারিক আহমেদ বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন অর্থাৎ কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে যেসব পণ্য আমদানি হয়, সেগুলো বাদে রোজার পণ্যের সংকট হওয়ার কথা নয়।
"সরবরাহ সংকট না হলে পণ্যের দামেও অস্থিরতা থাকে না", বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, বিশ্ববাজারের কারণে দাম যা বাড়ার, তা ইতিমধ্যে বেড়ে গেছে। নতুন করে বাড়ার কারণ নেই।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বিশ্ববাজারে দাম বাড়তির দিকে থাকলে পণ্য ধরে রাখার প্রবণতা তৈরি হয়।
"সরকার প্রতিনিয়ত কোন পণ্যের মজুদ কেমন, সরবরাহ কেমন, আমদানি মূল্য কত—তা জানিয়ে দিতে পারে। এতে ভোক্তারা যেমন আতঙ্কের কেনাকাটা করবেন না, তেমনি ব্যবসায়ী পর্যায়েও ধরে রাখার প্রবণতা থাকবে না।
তিনি বলেন, স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ না করে সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই কিছু পণ্য আমদানি করতে পারে। এসব করা গেলে দাম নিয়ে শঙ্কা থাকবে না।