মাদলে খাওয়াদাওয়া ও কেনাকাটা: টাঙ্গাইল শাড়ি, লাল বিরোই, লাল বিন্নি, বাঁশফুল…
ঐতিহ্যের ছন্দে আধুনিকতাকে উপস্থাপন করার লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল মাদল গ্রুপের। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে নিজেদের বাড়ির একটা ফ্লোরে দেশীয় শাড়ি, বই আর ভেজালমুক্ত শস্যসামগ্রী নিয়ে মাসুমা খাতুন শাম্মী শুরু করেছিলেন এক নতুন স্বপ্নের। ৫০ হাজার টাকার মতো প্রাথমিক পুঁজি নিয়ে শুরু করা সেই মাদলে এখন প্রতি মাসে কর্মীদের বেতনই দেওয়া হয় নয় লাখ টাকার উপর।
ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালের পেছনে পশ্চিম পান্থপথে শেখ রাসেল স্কয়ারে মাদলের বাড়ি। নিচ তলায় মাদল খাবার ঘর আর মাদল শস্যভাণ্ডার। দুই তলায় আছে মাদলের লাইফস্টাইল সামগ্রীর আউটলেট। দেশ-বিদেশের পরিচিত নানা অঙ্গনের তারকা ব্যক্তিত্বের মাদলে সমাগম হয় প্রায়ই। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে শুরু হয়ে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ব্যস্ততা লেগেই থাকে বাড়িতে। অথচ সাত বছর আগে মাদলের প্রধান উদ্যোক্তা মাসুমা খাতুন শাম্মীর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না ব্যবসার।
মাদল গ্রুপের শুরু
শাশুড়ির অদম্য উৎসাহে মাসুমা শুরু করেছিলেন নতুন কিছু করার পরিকল্পনা। মাদল শুরু করার আগে কী করতেন- এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুমা খাতুন শাম্মী বলেন, "অনেক কিছুই করতাম। দর্শনশাস্ত্রে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে গতানুগতিক কোনো চাকরিতে ঢোকা হয়নি। যৌথ পরিবারের সব কিছু সামলানোর পাশাপাশি নিজের আর ননদের বাচ্চাদের দেখা-শোনা আর লালন-পালনের সব দায়িত্ব ছিল আমার কাঁধে। চাকরি বা ব্যবসা না করায় আমার কাজের ভার কোনো অংশে তখন কম ছিল না।"
"তবু অনেকদিন যাবতই শাশুড়ি ঠেলছিলেন সংসারের বাইরে কিছু একটা করতে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলতেন ছেলেরা যখন বড় হয়ে যাবে তখন খুব একা বোধ হবে। নিজেকে সঙ্গ দেবার জন্য তাই আগে থেকেই নতুন কোনো কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়া দরকার। ব্যবসা শুরু করার বুদ্ধিও শাশুড়িরই ছিল।"
টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী দেশী তাঁতের শাড়ি, প্রাকৃতিক শস্য আর বই নিয়ে যাত্রা শুরু করার পরপরই বেশ ভালো সাড়া পেতে থাকেন মানুষের কাছ থেকে। শুরু থেকেই মাদলের উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় ঐতিহ্যকে সহজলভ্য করে তোলা আর সাধারণ মানুষের কাছে ভেজালমুক্ত শস্য সরবরাহ করা। সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে মাসুমাকে সহায়তা করত তার পুরো পরিবার। সাথে নিয়োগ করেছিলেন একজন কর্মী।
মাসুমার স্বামী প্রখ্যাত সাংবাদিক মেহেদি মাসুদ দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতার সাথে। কর্মব্যস্ততায় তিনি খুব একটা সময় দিতে পারতেন না সংসারে । মাসুমা জানান, প্রথমে মাদলের ব্যাপারে খুব একটা সায় ছিল না মেহেদির। পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া ব্যবসা শুরু করার ঝুঁকি নেয়াটা তিনি মানতে পারছিলেন না। কিন্তু মাদলের পথচলা শুরু হওয়ার পর থেকে মেহেদিও উৎসাহ যুগিয়েছেন সবসময়। ২০২০ সাল থেকে দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনের ইতি টেনে মেহেদি মাসুদ স্থায়ীভাবে মাদলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন।
শুরু থেকেই মাদলের ব্যবসায় নানামুখী দিক সংযোগ করার কারণ হিসেবে মেহেদি বলেন, "কোনো ঘরে যখন শুধু একটা দরজা থাকে তখন বাতাস শুধু একদিকে প্রবাহিত হয়। কিন্তু একটা ঘরে যদি সাথে কয়েকটি জানালা থাকলে সহজেই কয়েক দিক থেকে বাতাস যাতায়াত করতে পারে। যে কারণে ঘর সবসময় ঠাণ্ডা থাকে। ব্যবসার ক্ষেত্রেও একইভাবে ভেবেছি আমরা। আমাদের তাঁতবস্ত্র আছে, শস্য আছে, খাবার ঘর আছে। একদিকে যদি কখনো সমস্যা হয় তখন অন্য দিকগুলোর সাহায্যে ঘুরে দাঁড়ানো যাবে চাইলেই।"
মাদল শস্য ভাণ্ডার
"পাহাড় থেকে সমতল, সব যোগাবে মাদল," এই মন্ত্র নিয়ে কাজ করে মাদল শস্যভাণ্ডার। দেশের নানা জায়গা থেকে খুঁজে খুঁজে প্রাকৃতিক ও ভেজালমুক্ত শস্যসামগ্রী নিয়ে আসেন মাদলের উদ্যোক্তা মাসুমা ও মেহেদি।
মেহেদি বলেন, "আমরা কখনো আলাদা করে খাঁটি শব্দে জোর দেই না। কারণ স্বাভাবিক ভেজালমুক্ত খাবার মানেই খাঁটি। আমরা আমাদের শস্য ভাণ্ডারের শস্য নিজেরা বেছে সংগ্রহ করি যেন তা ভেজালমুক্ত থাকে। কেউ চাইলে যেকোনো সময় আমাদের হাবগুলো পরিদর্শন করতে পারে।"
মাদল শস্য ভাণ্ডারে পাওয়া যায় কাটারি, কাটারিভোগ, লাল বিরোই, ঢেকিছাঁটা লাল বিরোই, ঢেকিছাঁটা আউশ, লাল আমন, লাল বিন্নি, কালিজিরা, চিনিগুড়া, বাঁশফুলসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক ও বিষমুক্ত চাল।
"ক্ষতিকর কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার না করায় কিছুদিন সংরক্ষণের পরই আমাদের চালে পোকা হয় । তাই এক মাসের বেশি সময় আমাদের এখান থেকে নেয়া চাল ঘরে রাখতে না করি আমরা," বলেন মাসুমা।
নিজস্ব তত্ত্বাবধানে মেশিনের ঘানিতে ভাঙ্গানো সরিষার তেল মাদলের বেশ জনপ্রিয় পণ্য। এছাড়াও যবের ছাতু, বগুড়ার ঘরোয়া লাচ্ছা সেমাই, তালমিছরি, তিসির তেল, তিলের তেল, চিরতা, সূর্যমুখী বীজ, মিষ্টি কুমড়ার বীজ, শতমূল গুঁড়ার মতো দুর্লভ শস্য পণ্য পাওয়া যায় মাদলে।
বিশুদ্ধ খেজুরের গুড় তৈরির জন্য নাটোরে ৫১২টি খেজুর গাছ মাদলের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। পুরো শীতকাল জুড়ে সেসব গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে খেজুর গুড় সরবরাহ করেছে মাদল। বাছাইকৃত মশলা থেকে নিজেরা গুড় তৈরি করে বিক্রি করেন তারা।
কেরানিগঞ্জের আঁটি বাজার, দাড়িপাড়ায় মাদলের গরুর খামার আছে। নিজস্ব ২৪টি গরু থেকে দুধ সংগ্রহ করে প্রতিদিন তা মাদল শস্য ভাণ্ডার থেকে বিক্রি করা হয়। প্রয়োজন অনুসারে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় হোম ডেলিভারিও দিয়ে থাকেন তারা।
মাদল খাবার ঘর
২০১৮ সাল থেকে "ঘরের বাইরে ঘরের খাবার" স্লোগান নিয়ে শুরু হয় মাদল খাবার ঘরের। শখের বসে রেস্টুরেন্টে খেতে আসাদের জন্য নয়, বরং অনেকদিন যারা ঘরের খাবারের স্বাদ পান না তাদের জন্যই মাদলের এই আয়োজন। গতানুগতিক রেস্টুরেন্টের চেয়ে ভিন্ন, সাদাসিধে নানা পদ নিয়ে মাদল খাবার ঘর।
এখানে সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের খাবার পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন সব খাবার পাওয়া যায়। রেস্টুরেন্টের জাঁকজমক খাবারের বাইরে কাচকি মাছ, পালং শাক, করলা ভাজি, লাউয়ের খোসা ভাজি, লইট্টা শুঁটকি ভুনা, ডাল ভর্তা, পুঁইশাক দিয়ে চিংড়ি, আলুর দমের মতো খাঁটি বাঙালি খাবার মাদলের মেন্যুতে থাকে বরাবরই।
মাসুমা বলেন, "মাদলে কাউকে কাস্টমার বলি না আমরা, বলি গেস্ট। বাড়িতে মেহমান আসলে যেভাবে সমাদর করা হয় তাদের, সেভাবেই মাদল খাবার ঘরের গেস্টদের আপ্যায়ন করা হয়।"
নিয়মিত মাদলে খেতে আসেন ফারজানা। পেশায় একজন প্রকৌশলী তিনি। মাদলের বিশেষত্ব নিয়ে তিনি বলেন, "মাদলের সব খাবারই আমার প্রিয়। রেগুলার খেতে আসার পাশাপাশি বাসায়ও খাবার নিয়ে যাই এখান থেকে। মাদলের খাবার খেলে মনে হয় ঘরের রান্নাই খাচ্ছি। এখানের লুচি-আলুর দম আর শুক্রবার সকালের নেহারি আমার সবচেয়ে পছন্দের।"
মাদল খাবার ঘরের বড় অনুষঙ্গ পিঠা। শীতকালীন আকর্ষণ ভাপা পিঠা, দুধ চিতই পিঠা থেকে শুরু করে লবঙ্গ লতিকা, মালপোয়া, মুগপাকন, নারকেল পুলি, পাটিসাপটা ইত্যাদি মুখরোচক সব পিঠা পাওয়া যায় মাদল খাবার ঘরে।
ঘরোয়া বা প্রাতিষ্ঠানিক যেকোনো অনুষ্ঠানের জন্য যেকোনো খাবার ও পিঠা তৈরির দায়িত্ব নিয়ে থাকে মাদল। ঢাকা লিট ফেস্টে টানা তিন বছর দেশি-বিদেশি অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের জন্য খাবার পরিবেশন করেছে তারা।
মাদল খাবার ঘরের শুরুতে একজন বাবুর্চি নিয়োগ করেছিলেন মাসুমা। কিন্তু তার কাজ পছন্দ না হওয়ায় পরবর্তীতে মাসুমা নিজেই সব রান্না করা শুরু করেন। কয়েক মাসের মধ্যে নতুন বাবুর্চিদের ট্রেনিং দিয়ে নিজের মনমতো রান্না শেখান তিনি। তবে বিশেষ কিছু পদ রান্নার ভার এখনো মাসুমা নিজের হাতেই রাখেন।
করোনাকালীন লকডাউনে মাদল খাবার ঘর থেকে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সহায়তায় প্রতিদিন প্রায় হাজারখানেক অসহায় মানুষের খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখনও মাদলের সামনে থেকে কোনো ভিক্ষুক খাবার ছাড়া ফিরে যায় না।
বর্তমান অবস্থা
ব্যবসাকে সেবা বলে মনে করেন মাসুমা আর মাসুদ দুজনেই। তারা বলেন, "আমাদের রাসুল (সাঃ) এবং তানর স্ত্রীও ব্যবসা করতেন। ব্যবসাকে যখন শুধু ব্যবসা না ভেবে সহযোগিতা, সেবা আর এবাদতের মতো দেখা হয় তখন এর প্রসারও বেড়ে যায় অনেক। এই মানসিকতার জন্য আমাদের জিনিসও বিক্রি হয় প্রচুর। আমরা হয়তো এক কেজি চাল থেকে ১০ টাকা লাভ করতে পারিনা। কিন্তু একই সময়ে ১০ কেজি চাল বিক্রি করে ঠিকই ১০ টাকা লাভ উঠে যায়।"
মাদলের দেশি শাড়ির পাশাপাশি বাচ্চাদের জামা-কাপড়, দেশীয় পোশাক আর দেশীয় গয়নার চাহিদা অফলাইনের পাশাপাশি এখন অনলাইনেও জনপ্রিয় হচ্ছে।
"দূরদূরান্তে বসবাসকারী অনেকেই ফোন করে তাদের প্রিয়জনের জন্য খাবার, শস্য বা জমা-কাপড় পাঠানোর অনুরোধ করে আমাদের কাছে। অনুরোধ রেখে আমরা যখন তাদের প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোটাতে পারি তখন নিজের কাজে বেশ তৃপ্তি পাই," বলেন মাসুমা খাতুন শাম্মী।
আসন্ন রমজান উপলক্ষে বাজারে সব পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি থাকলেও মাদলের পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ী মাসুমা ও মেহেদি। সম্ভব হলে রোজায় বেশ কিছু পণ্যে ছাড় দেওয়ার চিন্তাও আছে তাদের।
শীঘ্রই ঢাকার কিছু এলাকায় মাদলের নতুন কয়েকটি শাখা খোলার পরিকল্পনা আছে মেহেদি মাসুদের। ভবিষ্যতে দেশের সব শহরে মাদলের শাখা পরিচালনা করার স্বপ্নও দেখেন তারা।