‘আমরা সোভিয়েত যুগে ফিরে যাচ্ছি’: পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার জেরে রাশিয়ায় নিত্যপণ্যের দোকানে দীর্ঘ লাইন
সোভিয়েত ইউনিয়নের যখন ছিল তখন লোকজনকে দোকান থেকে খাবার কেনার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হতো। অবশ্য সব খাবারের জন্য নয়, বরং কিছু নির্দিষ্ট খাবারের জন্যই এ লাইনগুলো তৈরি হতো।
এসব 'বিরল' খাবারের মধ্যে ছিল- সসেজ, পনির, তাজা মাংস ও ফলমূল ইত্যাদি। দোকানিদের সাথে ভালো খাতির থাকলে এ খাবারগুলো পাওয়া সহজ হতো মানুষের জন্য।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। এরপর তৈরি হয় রাশিয়াসহ ১৫টি দেশ। সোভিয়েত যুগকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যায় ওই অঞ্চলের মানুষেরা।
কিন্তু আজ এত বছর পর, রাশিয়ায় আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু কিছু দৃশ্যপট তৈরি হচ্ছে পুনরায়। রাশিয়ার রাস্তায় এখন দেখা যাচ্ছে খাবার ও নিত্যপণ্যের দোকানের সামনে দীর্ঘ লাইন। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পরে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে- বর্তমানে এ পরিস্থিতির মুখোমুখি রাশিয়ান জনগণ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে 'ঐতিহাসিক রাশিয়া'র সমাপ্তি হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সোভিয়েতের সমাপ্তিকে '২০ শতকের সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয়' হিসেবে উল্লেখ করে পুতিন বলেছেন, তিন দশক আগের সেই সোভিয়েত পতন এখনো দেশটির বেশিরভাগ নাগরিকের কাছে ট্র্যাজেডি হিসেবে স্থায়ী হয়ে আছে।
আজ আবার পুতিনের কারণেই সোভিয়েত যুগের স্বাদ পাচ্ছে রাশিয়ার জনগণ। দোকানের তাকগুলো থেকে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য অনেক আগেই উধাও হয়েছে। গত মার্চ মাস থেকেই রাশিয়ান মুদি দোকানগুলোয় চিনি ও বাজরার চালানে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
গত সপ্তাহে ওমস্কের গভর্নর নিত্যপণ্য কেনার জন্য স্থানীয়ভাবে বিশেষ বাজারের ঘোষণা দেন। এরপর সেখানে কয়েকশ মানুষ জড়ো হয়। 'কোথায় চিনি কিনতে পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে মানুষ একে-অপরকে গোপনে জানাচ্ছে। এটা ভাবাই যায় না,' আক্ষেপ আর বিস্ময় প্রকাশ করলেন ভিক্তর নাজরভ।
নাজারভ জানান, তার দাদীমা তাকে গত সপ্তাহে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিশেষ বাজারে গিয়ে বেশি করে চিনি কিনে আনতে। 'ব্যাপারটা একই সাথে হাস্যকর ও কষ্টের। এক মাস আগেও আমাদের সব ঠিকঠাক ছিল। আর এখন মনে হচ্ছে, আমরা ১৯৯০-এর দশকে পৌঁছে গিয়েছি আবার, মনে হচ্ছে জিনিসপত্র মার্কেট থেকে একেবারেই হারিয়ে যাবে।' দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করে পাঁচ কেজির একটি বস্তা কিনতে পেরেছিলেন নাজারভ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া অনেক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে চিনির জন্য মানুষ মারামারি করছে। সরকারি কর্মকর্তাদের ভাষায় এ সংকট কৃত্রিমভাবে তৈরি।
তবে এ দৃশ্যপট কেবল রাশিয়ার জন্য ধাক্কার শুরু। দেশটির আর্থনীতি ব্যাপক পরিসরে ছোট হয়ে যাওয়া, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, এবং বাকি বিশ্ব থেকে নজিরবিহীনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া- সবমিলিয়ে এ বছর পুরোটাই কঠিন যাবে রুশ জনতার।
ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স-এর উপ-প্রধান অর্থনীতিবিদ, রাশিয়ার অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ এলিনা রিবাকোভা বলেন, 'আমার মনে হয় আমরা ক্রমান্বয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ফেরত যাচ্ছি।' তার দৃষ্টিতে, রাশিয়ার সরকারের ওপর এই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা চলমান থাকবে। 'এটাকে আমি সাময়িক আঘাত হিসেবে দেখছি না। আমরা খুব শিগগিরই উন্মুক্ত অর্থনীতিতে ফিরে যাচ্ছি না। কেবল রাশিয়ার সরকার পরিবর্তন হলেই- এমন কিছু হবে।'
ইউক্রেনে রুশ সেনাদের অভিযানের পর থেকেই রাশিয়ার বড় বড় শহরের দোকানগুলোতে নিত্যপণ্যের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া, আমদানিকৃত পণ্য যেমন ডিটারজেন্ট, পোশাক, টুথপেস্টের দামও আকাশ ছুঁয়েছে।
সাধারণ জিনিসপত্রের দাম বাড়ার পেছনে দুইটি কারণ দেখাচ্ছে রুশ সরকার। এক, আতঙ্কিত মানুষের অন্ধের মতো পণ্য কেনা, ও দুই ফাটকাবাজদের দৌরাত্ম্য। জনগণের উদ্দেশ্যে রাখা এক বক্তৃতায় রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ভিক্টোরিয়া আব্রামশেঙ্কো বলেছেন, ২০২০ সাল থেকে আমরা চিনি ও বাজরায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই আতঙ্কিত হয়ে এসব পণ্য কিনে ঘরে জড়ো করার কোনো প্রয়োজন নেই।
তবে আরেকটি দুশ্চিন্তার ব্যাপার হলো, রাশিয়ায় এখন ওষুধের দোকানগুলোয় ইনসুলিনসহ আরও অনেক ঔষধ পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু জরিপের তথ্যমতে, রুশ ডাক্তারেরা ৮০টির বেশি ওষুধের সংকটে আছেন। অনেক পশ্চিমা ঔষধ কোম্পানি জানিয়েছে, তারা রাশিয়ায় প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ বন্ধ করবে না। আর সেটাকে মনে করিয়ে দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আবারও জনগণের অতিরিক্ত ওষুধ কেনাকে দায়ি করছেন রাশিয়ার সরকারি কর্মকর্তারা।
রিবাকোভা বলছেন, এ বছর রাশিয়ার মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ২০ শতাংশ ছোঁবে। সাধারণ রুশ নাগরিকের জন্য তার মানে দাঁড়াবে 'দারিদ্র্য ও দুর্দশা।'
'মানুষজনের কোনো সঞ্চয় নেই, আগেও তারা বিশেষ কিছু জমাতে পারেনি। আর এখন তারা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবে। তাদের সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধের সেবাটুকুও থাকবে না,' বলেন রিবাকোভা।
রাশিয়ার অর্থনীতি বিষয়ে আরেকজন বিশেষজ্ঞ নাতালিয়া জুবারেভিশের মতে, বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে রুবলের অস্থিরতা ও সরবরাহ সরবরাহ শৃঙ্খলের ব্যর্থতারও দায় রয়েছে।
আইকিয়া ও ম্যাকোনাল্ড-এর মতো বৃহৎ বিদেশি কোম্পানিগুলো সাময়িকভাবে রাশিয়ার বাজার ত্যাগ করায় কয়েক হাজার রুশ কর্মী সরাসরি প্রভাবিত হয়েছেন বা চাকরি হারিয়েছেন। এর পাশাপাশি, স্থানীয় কারখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরও উৎপাদন থমকে গেছে।
দীর্ঘকালীন পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সামগ্রিক অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে। অনেক পণ্য তৈরি করতেই পশ্চিমা কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। এর ফলে খাদ্যপণ্য তৈরি থেকে আকাশপথে ভ্রমণ- সবকিছুতেই অসুবিধার মুখোমুখি হতে পারে রাশিয়া।
রিবাকোভা মনে করেন, আজ থেকে কয়েক বছর পরে পশ্চিমা পণ্যের বিকল্প পণ্য তৈরি করতে পারা রাশিয়ার পক্ষে অসম্ভব হবে না। যদিও এতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, কারা তৈরি করবে এসব বিকল্প পণ্য!
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান