এক নজরে জনরোষের মুখে পড়া শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে পরিবার
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর স্মরণকালের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয়ে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। সাধারণ জনগণের রোষের মুখে পড়েছে দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজাপাকসে পরিবার।
এর আগে বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে হাজার হাজার মানুষ তার বাড়ির সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন। সংঘর্ষে অন্তত একজন আহত হন। বিক্ষোভকারী ও সাংবাদিকসহ গ্রেপ্তার করা হয় ৪৫ জনকে।
বিগত কয়েক দশক ধরে দেশটির রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আছে এই পরিবারের সদস্যরা। তাদের একটি সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল তৈরি করেছে বার্তাসংস্থা এএফপি। এই সদস্যরা হলেন—শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে, তার তিন ভাই গোতাবায়া, বাসিল ও চামাল রাজাপাকসে এবং মাহিন্দা রাজাপাকসের বড় ছেলে নামাল রাজাপাকসে।
প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা: মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত
দেশটির ৭৬ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে তাদের দলনেতা। ২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। এরপর ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি।
৩ বছর আগে তাকে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন তার ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহালা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে জনপ্রিয় তিনি। ২০০৯ সালে মে'তে শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহীদের দমনে তার ভূমিকাই এই জনপ্রিয়তার কারণ। তার সামরিক অভিযান শুরুর মাধ্যমে সূত্রপাত হয় দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধের।
জাতিসংঘের হিসাবমতে, এই গৃহযুদ্ধ শেষ হয় ৪০ হাজার নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা দিয়ে। যুদ্ধের শেষদিকে 'নো ফায়ার জোন' এলাকায় দেশটির সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষণে প্রায় ৪০ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়।
নিহতের এই সংখ্যা অস্বীকার করেন তিনি। এই নৃশংসতার অভিযোগের আন্তর্জাতিক তদন্ত চালানো প্রত্যাখ্যান করেন। দেশের অভ্যন্তরীণ তদন্তের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত বা বিচার প্রক্রিয়াও ব্যর্থ হয়।
তার শাসনামলেই চীনের সাথে শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক দৃঢ় হয়। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চীন থেকে ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নিলেও প্রায় সব প্রকল্পে দেখা গেছে সীমাহীন দুর্নীতি।
সমালোচকদের মতে, গৃহযুদ্ধের পর দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও তামিল ভাষাভাষি গোষ্ঠীর মধ্যকার বৈরিতা অবসানে তিনি কিছুই করেননি। যুদ্ধে নিহত বিদ্রোহীদের স্মরণে রাষ্ট্রীয় বাধা আছে, এখন পর্যন্ত কোণঠাসা এই জনগোষ্ঠী।
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া: দ্য টার্মিনেটর
মাহিন্দা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তার প্রধান লেফটেন্যান্ট ছিলেন গোতাবায়া। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালীন নিজের পদ ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার করেন দেশটির সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের ওপর।
প্রতিপক্ষের মানুষকে গুম করতে 'ডেথ স্কোয়াড' গঠনের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে, সাদা ভ্যানে করে তুলে নিয়ে অসংখ্য মানুষকে গুম করেছে এই স্কোয়াড। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
দ্রুত মেজাজ হারানোর কারণে তার নিজের পরিবারের সদস্যরাই তাকে ডাকে 'দ্য টার্মিনেটর' (বিধ্বংসী) নামে।
শ্রীলঙ্কার ঋণ শোধ করতে বিদেশি মুদ্রার অভাব পূরণ করতে বেশ কিছু খাতের আমদানি বন্ধ করে দেয়, এরপর দেখা দেয় নিত্যপণ্যের চরম সংকট।
২০১৯ সালে ইস্টার সানডে বোমা হামলা দেশটির সম্ভাবনাময় পর্যটন খাতের ওপর বড়সড় আঘাত হানে। এরপর আঘাত হানে কোভিড-১৯ মহামারি।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছরের বাজেট ঘাটতি, অযৌক্তিক কর কর্তনসহ রাজাপাকসে পরিবারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এজন্য দায়ী।
অর্থমন্ত্রী বাসিল: মি. টেন পার্সেন্ট
মাহিন্দা ও গোতাবায়ার ছোটভাই বাসিল রাজাপাকসে বর্তমানে শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রী।
বিভিন্ন সরকারি চুক্তি থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এজন্য বিবিসি'র এক সাক্ষাৎকারে তাকে প্রথমবার 'মি. টেন পার্সেন্ট' ডাকা হয়।
এসব ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তদন্ত হলে কিছু প্রমাণ হয়নি। গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়।
মন্ত্রী চামাল: দ্য বডিগার্ড
মাহিন্দা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন জাতীয় পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন চামাল রাজাপাকসে। জাহাজ ও বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী তিনি।
বর্তমানে সরকারের সেচ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তিনি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েও গোতাবায়ার পর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী এই চামাল।
কর্মজীবনে আগে পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। বিশ্বের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী সিরিমাভো বন্দরনায়েকের ব্যক্তিগত বডিগার্ড হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি।
মন্ত্রী নামাল: রাজাপাকসে পরিবারের উত্তরসূরী
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দার বড় ছেলে ৩৫ বছর বয়সী নামালকেই রাজাপাকসে পরিবারের উত্তরসূরী মনে করা হয়। পেশায় আইনজীবী তিনি। শোনা যায়, নামালকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট হিসেবে তৈরি করছে মাহিন্দা।
২০১০ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে সংসদে জনপ্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে দেশটির যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী তিনি।
তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ আসে, সবই অস্বীকার করেন তিনি।
- সূত্র: এএফপি