গণতন্ত্র নিপাত যাক! প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘজীবী হোক!
রোববার পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকারের হঠকারী সিদ্ধান্ত হয়তো বিরোধী দলগুলোর ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা রুখে দিয়েছে। কিন্তু একইসাথে পাকিস্তানকে আরেকবার সাংবিধানিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। সংসদে সরকার আর বিরোধীপক্ষের মধ্যে সংলাপ ও যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বিকল করে দেওয়ার সংকেতও এই সিদ্ধান্ত।
সেইসঙ্গে রাজনীতিতে বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা বাড়ার ইঙ্গিত এটি। যেখানে সংসদীয় প্রক্রিয়ার ভার পড়েছে সুপ্রিম কোর্টের ওপর। আদালত হয়তো রায় দিতে পারেন, অনুচ্ছেদ ৯৫ প্রয়োগ করা উচিৎ ছিল। অথবা এও রায় দিতে পারেন, অনাস্থা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ডেপুটি স্পিকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ সংসদ ভেঙে দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সুয়োমোটো নোটিশ গ্রহণ করে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট। আদলতের নির্দেশের অবমাননা হচ্ছে মনে করলে কেউ অভিযোগ দায়ের না করলেও 'সুয়ো মোটো প্রসিডিং' শুরু করা যায়।
স্পিকারের অনুচ্ছেদ ৫ ব্যবহার করে সংসদে তোলা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের সাংবিধানিক দিক বিচারে পাকিস্তানের অ্যাটর্নি জেনারেলকে আহ্বান জানিয়েছেন আদালত। স্পিকারের এই ক্ষমতা আছে কিনা তা নির্ধারণ করা হবে সামনে।
'সবাই বিশ্বাসঘাতক'
পাকিস্তানের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫ এ রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আনুগত্যের কথা বলা আছে।
স্পিকার ও সংসদের সদস্যদের দায়িত্ব ও ক্ষমতার কথাও বলা আছে। এরমধ্যে আছে কোনো প্রস্তাবে ভোট দেওয়ার ক্ষমতাও।
স্পিকার যদি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে চান, সাংবিধানিক আদেশ অনুসরণ করে কাউন্সিলের প্রকাশিত তথ্য নিয়ে সংলাপ চালাতে পারতেন। সংসদের সব সদস্য এ বিষয় ও সরকারের উদ্বেগ নিয়ে অবগত আছে তা নিশ্চিত করতে পারতেন তিনি।
কিন্তু, বিপক্ষে যুক্তি যাই হোক, বিরোধী দলীয় সদস্যদের সাংবিধানিক অধিকার আছে ভোট দেওয়ার। গতকাল দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করেছেন স্পিকার। অনুচ্ছেদ ৫(২) ভঙ্গ হয়েছে এতে।
স্পিকার অনাস্থা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেওয়ার সময় তিনি এক প্রকার ঘোষণাই দিয়ে দেন এর কারণ বিদেশি ষড়যন্ত্র।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, অনাস্থা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পুরো প্রক্রিয়াই জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের তথ্যের ওপর নির্ভর করে নেওয়া হয়েছে। কাউন্সিলের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমনকি অনাস্থা ভোটের ব্যাপারেও কিছু বলা নেই। শুধু বলা আছে, যোগাযোগে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তাতে দেখা গেছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে বিদেশি শক্তি।
বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিয়ে ইমরান খানকে এক সেশন ডাকতে বলা হয়েছিল যেখানে সব আইনপ্রণেতাদের নিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু সেই সেশন আর ডাকা হয়নি।
এছাড়াও, যে উপায়ে এ পুরো প্রক্রিয়াটি এগিয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। নতুন নিয়োগ পাওয়া ফেডারেল আইনমন্ত্রী দাঁড়িয়ে সরাসরি রায় চাইলেন, আগে থেকে লিখে আনা চিঠি পড়ে শোনালেন ডেপুটি স্পিকার। অবস্থাদৃষ্ট দেখে মনে হয় স্পিকার আর ডেপুটি স্পিকার যেন সরকারের ইচ্ছারই প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
স্পিকার কার পক্ষে?
ভুলে গেলে চলবে না, স্পিকারের হতে হয় নির্দলীয়। তিনি ক্ষমতাসীনদের নয়, আইনসভার প্রতিনিধি। তার দায়িত্ব ছিল এ নিয়ে সাংসদরা যাতে সংলাপে অংশ নিয়ে ভোট দিতে পারেন তা নিশ্চিত করা।
১৯৮৯ সালেও এমন একটি ঘটনা ঘটে। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা ভোটে তারই পরামর্শে সংসদ ভেঙে দেন গভর্নর। এরপর বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার পর ভোটগ্রহণ করা উচিৎ ছিল মর্মে রায় দেন আদালত।
একইভাবে, ২০১৭ সালে ইমরান খান বনাম মিয়ান নেওয়াজ শরীফের পানামা কেসে ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, স্পিকারের কিছু রায় ন্যায়সঙ্গত হতে পারে, আর স্পিকারের সিদ্ধান্ত আইনীভাবে ভুল হলে আদালত তা সংশোধনে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
এক্ষেত্রে সংবিধান যেমন আছে সেভাবে প্রয়োগ করাই সুপ্রিম কোর্টের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ব্যতিক্রম কোনো ব্যাখ্যা হাজির করা অনুচিত হবে, এরফলে সংবিধানের ব্যাখ্যা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। এর আগেও এমন ব্যক্তিক্রমী নজির স্থাপনের কারণে সুপ্রিম কোর্টের পরম্পরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সামনে কী অপেক্ষা করছে?
সংবিধান অনুযায়ী, সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরও অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীকে তার পদে থাকার বিশেষ ক্ষমতা দিতে পারেন প্রেসিডেন্ট।
২২৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী নির্ধারণে প্রেসিডেন্ট, বিরোধী দলীয় নেতারা ও প্রধানমন্ত্রী তিন দিন সময় পাবেন। ব্যর্থ হলে স্পিকার আট সদস্যের কমিটি গঠন করবেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতা দুজন করে নামের প্রস্তাব রাখবেন।
এরপর কমিটি তিন দিন সময় পাবে, কমিটিও ব্যর্থ হলে নামগুলো পাকিস্তানের নির্বাচনের কমিশনের কাছে পাঠানো হবে, কমিশনকে পরবর্তী দুইদিনের মধ্যে সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
ক্ষমতা পরিবর্তনের সময়ের মধ্যে একজন প্রধানমন্ত্রী হয়তো দুই সপ্তাহের জন্য দায়িত্ব পাবেন।
কিন্তু, সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ডেপুটি স্পিকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে বিরোধী দলগুলো। তারা বিষয়টিকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই দেখছেন। একারণে তারা হয়তো অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী নির্ধারণে অংশ নেবেন না।
এরফলে সাংবিধানিক জটিলতা দেখা দেবে, সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ করতে হবে।
এখন পর্যন্ত সবার চোখ সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের সুয়োমোটো প্রসিডিংয়ের দিকে। তারা যেই সিদ্ধান্তই জানাক, ডেপুটি স্পিকারের গতকালের কান্ডের আঁচ থেকে যাবে অন্তত আরও কয়েক মাস।
এই সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সংবিধান, তবে প্রধানমন্ত্রী তো থাকছেন!
- পাকিস্তান ভিত্তিক ইংরেজি দৈনিক ডনের সম্পাদকীয় থেকে অনূদিত