আন্তঃফসল চাষে বাড়ছে আখ ও পেঁয়াজ উৎপাদন
কিছুদিন আগেও জয়পুরহাটে লোকসানের কারণে দীর্ঘমেয়াদী ফসল আঁখের প্রতি অনীহা ছিল কৃষকদের। কিন্তু, পেঁয়াজ ও আঁখের আন্তঃফসল চাষ করতে পেরে কৃষকদের সেই মত পাল্টেছে। কৃষকরা এখন আঁখের সাথে চাষ করছেন পেঁয়াজ।
চিনিকলের আওতাভুক্ত জয়পুরহাট সদরের জয়পাবর্তীপুর গ্রামে ফসল হিসেবে আঁখ অনেক পুরোনো। চিকন, ধারালো, সবুজ আঁখের পাতার নিচে মাটি ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে বড় বড় পেঁয়াজ। এবারই প্রথম বারি-৪ জাতের পেঁয়াজ আঁখ খেতে যোগ করেছেন তারা।
কৃষকরা দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে জানান, পেঁয়াজের আকার ও ফলনও বেশ ভালো। আঁখের সাথে একই খরচে বাড়তি ফসল পেঁয়াজ এখন চাষীদের খুশির কারণ।
বাজার কমে গেলেও চলতি মৌসুমে ২৫ হাজার হেক্টর আঁখের খেত থেকে প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। এই সাথী ফসল থেকে এবার অন্তত ৬৮ কোটি টাকা বেশি আয় হবে বলে দাবি দেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্রের।
মসলা জাতীয় ফসলের গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের অর্থায়নে আঁখের জমিতে পেঁয়াজ চাষের এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্র।
জয়পুরহাটের তিন উপজেলায় মসলা গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভাবিত বারি-৪, ৫ ও ৬ জাতের পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। এ তিন উপজেলার ২ হাজার একর জমি থেকে পেঁয়াজের উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ হাজার মেট্রিক টন।
গবেষকেরা বলছেন, কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হলে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে পেঁয়াজের ঘাটতি পূরণ করেও উদ্বৃত্ত রপ্তানি করা সম্ভব।
সারা দেশে এক লাখ হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট বলছে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। এর সব মিলে এখন উৎপাদন হচ্ছে ৩০ হাজার মেট্রিক টন। ঘাটতি ৫ লাখ টন পেঁয়াজ এখন রপ্তানি নির্ভর।
এই রপ্তানি নির্ভরতা কমাতে গবেষণা ইন্সটিটিউট কৃষি জমিতে সাথী ফসল হিসেবে পেঁয়াজ উদ্বুদ্ধ করছেন।
জয়পুরহাটের ভাসদা গ্রামের শ্যামল চন্দ্র সরকার এবার ১৬ শতাংশ জমিতে আখের সাথে পেঁয়াজ চাষ করেছেন। এই চাষী জানান, আখ চাষে সাধারণত ১৬ মাস সময় লাগে। আগে এই পুরো সময় জমিতে শুধু আর কিছু রোপন করা হতো না।
কিন্তু এখন সময় পাল্টে গেছে। সরকারি প্রশিক্ষণ পেয়ে আখের জমিতে তিনি এবার বারী-৪ জাতের পেঁয়াজ, আলু ও কালাই (ডাল) চাষ করেছেন। ১৬ শতক জমিতে অতিরিক্ত ফসল হিসেবে ২০ মন পেঁয়াজ পেয়েছেন, যার বাজারমূল্য ১০ হাজার (প্রতি মণ ৫০০) টাকা।
একই জমিতে সাথী ফসলের ক্ষেত্রে হালকা পরিমাণ সার ও শ্রমিকের অতিরিক্ত খরচ লাগে জানিয়ে শ্যামল বলেন, আখের সাথে কোনো সাথী ফসলে সমস্যা হয় না। এটি আমাদের জন্য একটি সুখবর।
একই গ্রামের দেলোয়ার হোসেন গত ৩ বছর ধরে আঁখের সাথে মসলা-সবজিসহ ২৬ জাতের আবাদ করছেন। এবার পেঁয়াজ চাষেও সাফল্য পেয়েছেন।
সম্প্রতি তার আখের জমিতে দাঁড়িয়ে কথা হয়। জানান, এখন জমিতে শুধু আখ চাষ করলে লোকসান হয়। এ কারণে আখ চাষ বাদ দিয়েছিলেন। কিন্তু কৃষি গবেষণার কারিগড়ি প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর আখের জমিতে এখন পেঁয়াজ চাষ করছেন তিনি। প্রতি বিঘায় অন্তত ৪০ মন পেঁয়াজি উৎপাদন হবে বলে জানালেন।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের জ্যৈষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নুর আলম চৌধুরী বলেন, "আমরা পেঁয়াজের জাত নিয়ে গবেষণা করে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করেছি।"
"এখন আমরা বারী-৪, ৫ ও ৬ জাতের পেঁয়াজ সাথী ফসল হিসেবে চাষাবাদ হচ্ছে। এর মধ্যে বারী-৫ জাতের পেঁয়াজ গ্রীষ্মকালীন। মূলত দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি পূরণে উন্নত জাতের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এসব পেঁয়াজ দেশি জাতের চেয়ে এক থেকে দেড়গুণ বেশি উৎপাদিত হয়।"
কৃষকরা বলছেন, বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ শেষে আখের জমিতে এখন অনেকেই সাথী ফসল হিসেবে আলু, পেঁয়াজ, আদা-হলুদ চাষ করছেন। বারী-৪, ৫ জাতের পেঁয়াজ দেশী জাতের চেয়ে অনেক বেশি হয়। এতে তারা লাভবানও হচ্ছেন। তবে এবার পেঁয়াজের দম কম হওয়ার কারণে কৃষকদের মাঝে কিছুটা হতাশাও তৈরি হয়েছে।
দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি কমাতে মসলা জাতীয় ফসলের গবেষণা কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে মসলা জাতীয় ফসলের গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্প পরিচালক ড. শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, বাংলাদেশে পেঁয়াজের ঘাটতির বিষয়টি মাথায় নিয়ে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
গত দুই বছরে ১০ হাজার মেট্রিকটন পেঁয়াজের ঘাটতি পূরণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তবে পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীলতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় আমাদের কৃষকরা আবার পেঁয়াজ চাষের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, বলেন তিনি।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. দেবাশীষ সরকার বলেন, "বাংলাদেশে এখন আর জমি বাড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধি করেতে হবে। একই সাথে চিনিও আমাদের প্রয়োজন। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে সাথী ফসল চাষের সূচনা করেন।"