রেমিটেন্স আয়ের ১৪ শতাংশ খরচ হচ্ছে অভিবাসন প্রক্রিয়ায়
২০১৭ সালে কর্মী ভিসা নিয়ে সৌদি আরব যান তাজউদ্দিন তারেক। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা ফেনীতে তার পরিবারকে অর্থ পাঠানো শুরু করার আগে অভিবাসনের জন্য তাকে ব্যয় করতে হয় সাড়ে ৭ লাখ টাকা। পাঁচ বছর ধরে এই টাকা শোধ করেন তারেক।
কিন্তু সরকার নির্ধারিত ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকায় তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে যেতে পারলে, মাসিক ৩৫ হাজার টাকা বেতনে সেখানে যাওয়ার খরচ মেটাতে তারেকের পাঁচ মাসের বেশি সময় লাগত না।
তারেক ফোনে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, উচ্চ অভিবাসন খরচের পিছনে প্রধান কারণ ছিল - মধ্যস্থতাকারী (দালাল), নিয়োগকারী সংস্থা এবং ভ্রমণ নথি প্রক্রিয়াকরণ - অভিবাসন প্রক্রিয়াটি স্বদেশে কমপক্ষে তিনটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছিল।
৩১ বছরের তারেকের মতোই কাহিনি ৬ লাখ ১৭ হাজার বাংলাদেশির, যাদেরকে গত বছর ২৯০ কোটি ডলারের বেশি ব্যয় করে বিদেশে যেতে হয়। সে তুলনায় ২০২১ সালে প্রবাসী আয় এসেছে ২২.০৭ বিলিয়ন ডলার।
স্থানীয় গবেষণা ফার্ম ডেটাসেন্সের একটি অনুমান অনুসারে, প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাড়িতে যে পরিমাণ অর্থ পাঠান, তার ১৪ শতাংশ যায় অভিবাসন ব্যয় মেটাতে।
বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, গন্তব্য এবং স্বদেশ উভয় স্থানে অভিবাসন প্রক্রিয়ার অন্যান্য লুকানো খরচ আমলে নিলে রেমিট্যান্স সুবিধার উপর নেতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি হবে।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি রেমিট্যান্স প্রবাহের পূর্ণ সুবিধা ভোগ করতে চায়, তাহলে দ্বিপাক্ষিক শ্রম অভিবাসন ব্যবস্থা চালুর কোনো বিকল্প নেই। সরকার-টু-সরকার ব্যবস্থা মধ্যস্বত্বভোগীদের দূর করে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনের খরচ বহুলাংশে কমিয়ে দেবে, যা এখন পাকিস্তানের পরে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে আরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, সরকারি খাতের মধ্যস্থতা – যেমন মালয়েশিয়ার এবং এখন দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে বাংলাদেশের সরকার-টু-সরকার চুক্তি– খরচ কমিয়ে জনশক্তি রপ্তানি বাজারকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে পারে, যেখানে জবাবদিহিতা ও যথাযথ নজরদারির অভাব রয়েছে।
২০১৭ সালে সরকার জনশক্তি বাজারকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসাবে প্রধান প্রধান গন্তব্যের অভিবাসন খরচ নির্ধারণ করে। তারপরে ২০২০ সালে হানা দেয় মহামারি, এসময় অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক তাদের কর্মসংস্থান হারায় এবং অন্যরা আয় সংকটের মুখোমুখি হয়। এসব কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে নতুন অভিবাসনকারীর সংখ্যাও ছিল কম।
মহামারির প্রকোপ হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে, ২০২১ সালের শেষদিকে বৈদেশিক শ্রমবাজারে চাকরির সুযোগ নতুন করে ফিরে আসে। কিন্তু অভিবাসন খরচ এখনও অভিবাসীদের জন্য একটি বোঝা হিসাবে রয়ে গেছে, কারণ কিছু রুটে বিমান ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ এবং তিনগুণ বেড়েছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী মহামারিকালে তাদের আয় হারানোয় প্রকৃত অভিবাসন ব্যয় আনুমানিক পরিমাণের চেয়ে বেশিই হবে।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, "আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় ৬৮ শতাংশ প্রত্যাবর্তনকারী অভিবাসী উপযুক্ত মজুরি পাননি। ৩৯ শতাংশ মহামারির মধ্যে হ্রাসকৃত মজুরি পেয়েছেন। গড়ে একজন প্রত্যাবর্তনকারী অভিবাসী কর্মক্ষেত্রে মজুরি এবং অন্যান্য সুবিধাদি বাবদ ১ লাখ ৭৯ হাজার টাকারও বেশি হারান।এছাড়াও, ১৯ শতাংশ নতুন কর্মী তখন বিদেশের কর্মসংস্থানে যেতে পারেননি।"
স্থানীয় জনবল নিয়োগের খাতকে সম্পূর্ণরূপে একটি "আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবসা" উল্লেখ করে তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, অভিবাসন খরচ কমাতে নিয়োগকারী বা জনশক্তি রিক্রুটারদের অবশ্যই নির্দেশনার আওতায় আনতে হবে।
"প্রায়শই নিয়োগকারীরা অভিবাসীদের কাছ থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নেয়। এক্ষেত্রে জবাবদিহিতার ন্যূনতম একটি স্তর থাকা উচিত"- উল্লেখ করেন তিনি।
তবে রামরুর গত বছরের গবেষণায় দেখা গেছে যে, বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় নেওয়া হলে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অভিবাসনের খরচ কিছুটা কমেছে।
গবেষণাটি আরও জানাচ্ছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২০ সালে নারী শ্রমিকদের অভিবাসন খরচ ১৮ শতাংশ এবং পুরুষদের ৭ শতাংশ কমেছে।
তাসনিম সিদ্দিকী টিবিএসকে বলেন, "পরিসংখ্যানগুলি আমরা ঘনিষ্ঠভাবে দেখলে আমরা বুঝতে পারব যে, গত ১০ বছরে নিয়োগের চার্জ ব্যাপকভাবে বাড়েনি।"
ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া
প্রবাসীদের জন্য বিদেশের কর্মসংস্থান বাজারে অভিবাসন খরচের বড় অংশই হলো- গন্তব্যে অবৈধ 'ভিসা বাণিজ্য' এবং বৈধ আইনি ওয়ার্ক পারমিট (ইকামা) সংগ্রহের ব্যয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে তাদেরকে মধ্যস্বত্বভোগী আর রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে পাসপোর্ট, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, মেডিকেল খরচ এবং অন্যান্য সরকারি ফি বাবদ উচ্চ সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। এতে পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। কোভিড-১৯ মহামারির পর বেড়ে যাওয়া বিমানভাড়াও এখন অভিবাসন খরচ বৃদ্ধির নতুন উৎস হয়ে উঠেছে।
রামরুর একটি গবেষণা অনুসারে নিয়োগের খরচ লিঙ্গ, গন্তব্যের দেশ এবং ভিসার ধরনের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন হয়।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলি যুক্তি দেয়, তারা সাধারণত ৩০০-৫০০ ডলার সার্ভিস চার্জ হিসাবে নেয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত না হওয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীরা (দালাল) বেশি টাকা নেয়।
তাদের দাবি, মধ্যস্বত্বভোগীদের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলে একজন অভিবাসী ২ থেকে আড়াই লাখ টাকায় সৌদি আরব যেতে পারেন। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়া বিদেশে যাওয়া খুবই বিরল ঘটনা।
কাগজপত্রের জন্য টাকার লেনদেন
বিদেশ যেতে ইচ্ছুক অভিবাসীদের অনেককেই ভ্রমণের নথি প্রস্তুত করতে বাড়ির আশেপাশের দালালকে টাকা দিতে হয়।
একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক টিপু সুলতান টিবিএসকে বলেন, সরকার নির্ধারিত রেট মাত্র ৫০০ টাকা হলেও পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়।"
তিনি বলেন, উপসাগরীয় দেশগুলোতে অভিবাসীদের জন্য সরকার মনোনীত চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। কেন্দ্রগুলো জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও দালালেরা এর চেয়ে বেশি নেয়।
এই রিক্রুটার আরও বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোতে পাসপোর্ট ও চিকিৎসা ছাড়পত্রের খরচ বাংলাদেশের তুলনায় কম।
'ভিসা বাণিজ্যের' কোন আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা না থাকলেও গন্তব্য দেশগুলোতে রয়েছে এর ব্যাপক প্রচলন। কারণ কিছু এজেন্ট নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে ভিসা কিনে এবং অভিবাসন উৎস দেশগুলির নিয়োগকারী সংস্থার কাছে বিক্রি করে দেয়।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, তারা ভিসা বাণিজ্য করেন না। "আমরা মূলত নিয়োগকারী দেশগুলো থেকে চাহিদাপত্র নিয়ে আসি এবং এতে আমাদের খরচ হয়। কিন্তু এটির জন্য সর্বোচ্চ ৫০০ ডলার সীমা থাকা উচিত। আইনি কাঠামোর আওতায় না আনা পর্যন্ত এ বাজার সাশ্রয়ী হবে না।"
কিন্তু স্থানীয় একজন নিয়োগকারী বলেছেন যে, তাকে সৌদি নিয়োগকর্তাকে ভিসা প্রতি প্রায় ১২ হাজার টাকা "ভিসা প্রকিউরমেন্ট ফি" হিসাবে দিতে হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ জানিয়েছে, ২০১৬ সালে অবৈধভাবে কর্ম ভিসা কেনার জন্য ছয়টি প্রধান শ্রমিক নিয়োগকারী দেশে বাংলাদেশ থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাচার করা হয়েছে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, "৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ভিসা অবৈধভাবে কেনা হয়, যেখানে ভিসার আসলে কোনো খরচই নেই।"
অতিরিক্ত শ্রম সরবরাহও দায়ী
দক্ষিণ এশিয়া থেকে সর্বাধিক জনপ্রিয় গন্তব্যে শ্রম অভিবাসন খরচ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, যা বিদেশের চাকরিতে দরিদ্রদের প্রবেশাধিকারকে সীমিত করে এবং অভিবাসীদের উচ্চ ঋণের বোঝার মুখে ফেলে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের পর বাংলাদেশি শ্রমিকদের অভিবাসন ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ, নেপাল এবং পাকিস্তান থেকে অভিবাসনের গড় খরচ গন্তব্যস্থলে ৬-১২ মাসের মজুরির সমান।
বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা অবশ্য এ সময়কালকে আরও দীর্ঘ উল্লেখ করেছে।
২০২০ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ৪ লাখ ১৭ হাজার টাকা যোগাড় করতে বিদেশে একজন বাংলাদেশি অভিবাসীকে অন্তত ১৭.৬ মাস কাজ করতে হয়।
বিবিএসের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশি অভিবাসীরা সৌদি আরবের যেতে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত খরচের চেয়ে ২.৬ গুণ, মালয়েশিয়ার যেতে ২.৫ এবং সিঙ্গাপুরের জন্য ২.২ গুণ বেশি ব্যয় করেছে।
অতিরিক্ত শ্রম সরবরাহ অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশীদের জন্য উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ের একটি প্রধান কারণ উল্লেখ করে, বায়রার সাবেক নেতা শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, আমরা বছরে ৬-৭ লাখ লোককে সেবা দিতে পারি, কিন্তু বছরে প্রায় ৩০-৪০ লাখ অভিবাসন প্রত্যাশী আমাদের কাছে আসে।
"নেপালে শ্রম অভিবাসন খরচ আমাদের চেয়ে কম, কারণ সেখানে শ্রম সরবরাহও চাহিদার তুলনায় কম। নেপালি অভিবাসন প্রত্যাশীরা বিনামূল্যে ভিসা পান। তারা কখনও কখনও বিদেশে তাদের কর্মস্থলে যোগদানের জন্য নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে অর্থও পায়"- তিনি যোগ করেন।
"অন্যান্য দেশগুলি বড়জোর ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে একজন কর্মী পাঠাতে পারে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তাতে প্রায় ৪৫-৬০ দিন সময় লাগছে, যার ফলে ইতোমধ্যের উচ্চ খরচ আরও বেড়ে যায়" নোমান বলেন।
তিনি বলেন, দেশের এখন দক্ষ কর্মীদের অভিবাসনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত, কারণ বিদেশে দক্ষ লোক পাঠানোর খরচ 'খুব কম'।