সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার আশা ফিকে হচ্ছে
বিতর্কিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) ডেসটিনির মতো গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করে যুবক ও ইউনিপে টু ইউ নামের দুইটি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার আশা ফিকে হচ্ছে দিন দিন।
যুবকের কাছে প্রতারিত গ্রাহকরা পাবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা আর ইউনিপে টু ইউ এর কাছে পাবে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা।
যুবকের অর্থ উদ্ধার ও পরিচালনার জন্য সরকার এখন পর্যন্ত প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারেনি। আর ইউনিপে টু ইউ-এর টাকা ফেরত দিতে আদালতের রায় থাকলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
১৯৯৪ সালে কার্যক্রম শুরু করে যুবক; ২০০৬ সালে আবার বন্ধও হয়ে যায়।
অন্যদিকে ইউনিপে টু ইউ-এর সূচনা ২০০৯ সালে। কিন্তু দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১১ সালে ইউনিপে টু ইউ'র কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে মামলা করে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুবক-এ একজন প্রশাসক নিয়োগের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেলেও, দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ঐকমত্যের অভাবে এখন পর্যন্ত তার নির্দেশনা কার্যকর হয়নি।
যুবকের সাড়ে তিন লাখ বিনিয়োগকারীর কেউই তাদের বিনিয়োগকৃত আড়াই হাজার কোটি টাকার এক পয়সাও ফেরত পাননি।
অন্যদিকে, ২০১৯ সালে ঢাকার একটি আদালত দুদকের মামলার রায়ে ইউনিপে টু ইউ-এর প্রতারিত বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরতের ব্যবস্থা করার জন্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। টাকা ফেরত দিতে আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। প্রতারিত গ্রাহকরা মাসের পর মাস সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও কোনো আশ্বাস মিলছেনা।
দায়িত্বটা আসলে কার
আবু মোহাম্মদ সাঈদকে চেয়ারম্যান এবং হোসেন আল মাসুমকে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়ে ১৯৯৪ সালে যুবক তার কার্যক্রম শুরু করে। সরকারি নিবন্ধনহীন কোম্পানিটির ছিল আরও ৪০ জন পরিচালক।
পরে ১৯৯৭ সালে সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের অধীনে কোম্পানিটি নিবন্ধিত হয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই যুবক উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত নিতে শুরু করে। সদস্যপ্রতি ন্যূনতম ৫০০ টাকা মাসিক আমানতের প্রলোভন থেকে শুরু করে বার্ষিক এক লাখ টাকা জমার বিপরীতে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয়।
আবাসন প্রকল্পের প্লটের প্রতিশ্রুতি দিয়েও টাকা আদায় করে কোম্পানিটি।
২০০৬ সালে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানোর অভিযোগে বন্ধ হওয়ার আগে, যুবক লোকজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা আড়াই হাজার কোটি টাকা দিয়ে অন্তত ২০ ধরনের ব্যবসা শুরু করেছিল।
অথচ এখনও যুবক-এ প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। অর্থ নাকি বাণিজ্য- এ দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে সেটিই এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারেনি সরকারের এই দুই মন্ত্রণালয়।
যেহেতু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে যুবক সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের সরকারি নিবন্ধন পেয়েছে, ফলে অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে প্রশাসক নিয়োগের দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরই।
অন্যদিকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য হল, যুবক অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রমে জড়িত ছিল, সুতরাং অর্থ মন্ত্রণালয়েরই উচিত যুবক-এ প্রশাসক নিয়োগ করা।
আদালতের নির্দেশনা যথেষ্ট নয়?
কোম্পানি আইনের অধীনে নিবন্ধিত ইউনিপে টু ইউ ২০০৯ সালের অক্টোবরে তার কার্যক্রম শুরু করে। মাত্র ১৩ মাসের মতো এটি তার জালিয়াতি কার্যক্রম চালাতে সক্ষম হয়েছিল। তবু সে সময়ের মধ্যেই কোম্পানিটি তার বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের ব্যবসা করার কথা বলে ইউনিপে কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগের টাকা নিত। তারা বলেছিল, এতে প্রতি মাসে গড়ে কোম্পানিটির যে লাভ হবে, তা থেকে দশ মাসে বিনিয়োগের দ্বিগুণ টাকা বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্টে জমা হবে।
অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করে ইউনিপে টু ইউ। নিয়ম অনুযায়ী, কেউ বিনিয়োগ করতে চাইলে অনলাইনে তাদের ওয়েবসাইটে একটি বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে হতো। ওই অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য এককালীন অফেরতযোগ্য ৪২ হাজার টাকা ফি দেওয়ার নিয়ম ছিল। একজন বিনিয়োগকারীর আনলিমিটেড অ্যাকাউন্ট খোলারও নিয়ম ছিল। তবে একটি অ্যাকাউন্টে সর্ব্বোচ্চ ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা যেত।
বিনিয়োগকারীরা জানান, প্রায় সকল বিনিয়োগকারী একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। কিছু বিনিয়োগকারী শতাধিক অ্যাকাউন্টও খুলেছিলেন বলে জানা গেছে।
বিনিয়োগ সংগ্রহের জন্য রাজধানীসহ দেশের চার মহানগরীতে কয়েক হাজার এজেন্ট নিয়োগ দিয়েছিল ইউনিপে। এমএলএম পদ্ধতিতে বিনিয়োগকারী সংগ্রহকারী ওই এজেন্টরাও একটা বড় অংশের কমিশন পেতেন।
দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১১ সালে ইউনিপে টু ইউ এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে মামলা করে।
মামলার এজাহার অনুযায়ী, ইউনিপে কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগকারীদের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। আরও আড়াই হাজার কোটি টাকা দেশের অভ্যন্তরেই রয়েছে বলে এতে বলা হয়।
২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ইউনিপে টু ইউ-য়ের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ মোট ছয়জন কর্মকর্তাকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। সাথে ২,৭০২ কোটি টাকার অর্থদণ্ডও প্রদান করা হয়।
প্রতারণার শিকার বিনিয়োগকারীদের এই অর্থ ফেরত দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সহ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন আদালত।
এছাড়াও বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে এবং ইউনিপে টু ইউ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তা বিতরণ করতে সরকারকে বলেন আদালত।