স্থগিত টিসিবির পণ্য বিক্রি কার্যক্রম
কমদামের পণ্য কিনতে রাজধানীতে টিসিবির ট্রাকের পেছনে দৌড়াচ্ছেন ক্রেতারা- গত রমজানে এমন দৃশ্য অহরহই দেখা গেছে রাজধানীতে। এবারও এমন চিত্র ফুটে ওঠার আশঙ্কা থেকে সরকারের কয়েকজন নীতি-নির্ধারকের পরামর্শে শেষ মুহূর্তে মঙ্গলবার থেকে ঢাকায় খোলা ট্রাকে পণ্য বিক্রি স্থগিত করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বিক্রয় সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ তথ্য জানান। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের জন্য নির্ধারিত ১৪ লাখ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে ফ্যামিলি কার্ড বিতরণের পর আগামী জুন মাস থেকে সারাদেশের কার্ডধারীদের কম দামে সয়াবিন তেল, চিনি ও মসুর ডাল বিতরণ শুরু করবে সরকার।
গত রমজানের আগে সারাদেশে এক কোটি পরিবারের তালিকা করে ফ্যামিলি কার্ড করার উদ্যোগ নেয় সরকার। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও বরিশাল সিটি করপোরেশন বাদে সারাদেশে ৮৫ লাখ ৯০ হাজার ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ করা হয়েছে, যারা গত রমজানের আগে ও ঈদের আগে দুইবার করে ১১০ টাকা লিটার দরে সয়াবিন তেল এবং ৫৫ টাকা কেজি দরে চিনি ও মসুর ডাল পেয়েছেন।
বাণিজ্য সচিব জানান, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১১ লাখ এবং বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৩ লাখ পরিবারকে এই কার্ড দেওয়া হবে, যার তালিকা সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনগুলো করছে। তবে সয়াবিন তেলের বর্তমান দর অপরিবর্তিত থাকলে পণ্যটির দাম কিছুটা বাড়ানো হতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
সারাদেশের কার্ডধারীদের মাঝে এবং ঢাকায় খোলা ট্রাকে মঙ্গলবার থেকে ১১০ টাকা লিটার দরে সয়াবিন তেলসহ চিনি ও মসুর ডাল বিক্রির ঘোষণা দিয়েছিল টিসিবি। সোমবার রাতে তা স্থগিত করা হয়। এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও এ সময় কম দামে টিসিবির পণ্য বিক্রির ঘোষণা দিয়েছিলেন।
সোমবার সচিবালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় টিসিবির পণ্য বিক্রির সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে। আগামী মাস থেকে তা শুরু হবে।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, গত রমজানে রাজধানীতে টিসিবির ট্রাকের পিছনে ক্রেতাদের অনেক লম্বা লাইন দেখা গেছে। অনেক সময় পণ্য ফুরিয়ে যাওয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে অপেক্ষমান ক্রেতাদের পণ্য না দিয়েই টিসিবির ট্রাক স্থান ত্যাগ করেছে। ওই সময় অনেক ক্রেতাকে পণ্যের জন্য ট্রাকের পেছনে ছুটতে দেখা গেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ চিত্র প্রচার পেয়েছে।
ওই সময়কার তুলনায় বাজারে বর্তমানে ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে টিসিবির খোলা ট্রাকের পেছনে ক্রেতাদের লাইন আরও দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এবারও অনেক ক্রেতাকে পণ্য ছাড়া ফিরতে হতে পারে বলে মনে করছেন সরকারের কোনো কোনো নীতিনির্ধারক। এ প্রেক্ষাপটেই খোলা ট্রাকে টিসিবির পণ্য বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
আর ঢাকায় পণ্য বিক্রি না করে, সারাদেশের ফ্যামিলি কার্ডধারীদের মাঝে পণ্য বিতরণ করা হলে তা যৌক্তিক হবে না বিবেচনা করে সরকার মঙ্গলবার থেকে পণ্য বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ট্রাকে টিসিবির কোন পণ্য বিক্রি করা হবে না। এমনকি ফ্যামিলি কার্ডহোল্ডারদেরও ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে হবে না। বরং সারাদেশের টিসিবির ডিলারদের দোকান থেকে কার্ড হোল্ডাররা পণ্য নেবেন।
এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব বলেন, ইতোমধ্যে একটি অ্যাপস তৈরি করা হয়েছে, যা ব্যবহার করে নারায়ণগঞ্জ ও গোপালগঞ্জের কার্ড হোল্ডাররা টিসিবির পণ্য নিয়েছেন। জুন থেকে সব ডিলাররা এই অ্যাপস ব্যবহার করে তাদের দোকান থেকে পণ্য বিতরণ করবেন।
'প্রতিটি কার্ডে একটি কিউআর কোড রয়েছে, যা ডিলার তার মোবাইলে এই অ্যাপস থেকে স্ক্যান করে পণ্য সরবরাহ করবে। প্রত্যেক ডিলার কবে, কী পরিমাণ পণ্য উত্তোলন করছে এবং কতোটি কার্ডের বিপরীতে কি পরিমাণ পণ্য বিতরণ করছে, তা এই অ্যাপসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপডেট হবে', জানান তিনি।
এদিকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিজ নিজ এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ এবং পরীবাগ নিয়ে গঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান আসাদ টিবিএসকে বলেন, 'ঈদুল ফিতরের কয়েকদিন আগে আমরা তালিকা করার জন্য নির্দেশনা পেয়েছি। আমার এলাকায় বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের লোক কম। তবুও আমরা ৭০০ জনের তালিকা করে পাঠিয়েছি।'
তেজগাঁও থানাধীন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শামীম হাসান বলেন, 'আমরা সর্বস্তরের মানুষকে জানিয়েছি। যারা যোগাযোগ করেছে সেখান থেকে পাঁচ হাজার জনের তালিকা পাঠিয়ে দিয়েছি সিটি কর্পোরেশনে।'
তবে কার্ডের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি হলে সবাই পাবে কিনা এটা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে। তারা বলছেন, আগে লাইনে দাঁড়ালে কষ্ট হলেও পণ্য কেনা যেত। তাদের আশঙ্কা স্থানীয় কাউন্সিলরের পরিচিত লোকেরাই এ কার্ড পাবে।
হাজারীবাগ এলাকার বাসিন্দা মোহম্মদ আক্কাস শেখ বলেন, 'দুই দিন আগে শুনলাম কার্ডের মাধ্যমে বিক্রি হবে তাই স্থানীয় কাউন্সিলর অফিসে গিয়ে আমার মোবাইল নাম্বার ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দিয়ে এসেছি। এখন কার্ড পেলেই হয়। আমাদের তো কোন সুপারিশ নেই। এতদিন লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির পণ্য কিনেছি। এখন যারা প্রকৃত পাওয়ার যোগ্য তাদের বাছাই করে যেন দেয়া হয়। আমরা আশঙ্কা করছি, এটা কাউন্সিলরের পরিচিত লোকই বেশি পাবে।'
একই এলাকার নুরুন্নেসা বেগম বলেন, 'আমরা তো কোন খবরই পেলাম না। কিভাবে কার্ড সংগ্রহ করা যায় সেটাও জানি না। আগে কষ্ট হলেও লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কেনা যেত। এখন তো সেই সুযোগও থাকলো না।'
টিসিবি চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ আরিফুল হাসান টিবিএসকে বলেন, 'নিম্ন আয়ের মানুষকে কার্ডের মাধ্যমে এ পণ্য দেয়া। যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তারাই এ কার্ড পাবেন। যে ওয়ার্ডে নিম্ন আয়ের লোক বেশি সেখানে বেশি ও যে ওয়ার্ডে নিম্ন আয়ের লোক কম তাদের জন্য কম কার্ড দেয়া হবে।'
মোঃ আরিফুল হাসান বলেন, 'স্থানীয় ভোটার ছাড়াও এ কার্ড পাবে। তবে লক্ষ্য রাখা হবে একটি পরিবারে কেউ যেন ডাবল না পায়। কাউন্সিলর ও সিটি করপোরেশনের মাধ্যমেই এ কার্ড বিতরণ করা হবে। আমাদের পরবর্তীতে টিসিবির পণ্য কার্ডের বাইরে বিক্রি করার পরিকল্পনা নেই। কার্ডধারী না হলে বিক্রিতে শৃঙ্খলা থাকে না। দেখা যায় একজন প্রতিদিন নিচ্ছে, আবার এক পরিবার দুইবার নিচ্ছে এমনও হয়।'