কোক স্টুডিও বাংলা এবং তার যত গান
বাংলাদেশের একাধিক টিভি চ্যানেলে একাধিক সংগীতভিত্তিক আয়োজন ব্যর্থ বা গতানুগতিক হয়ে ওঠার পরে কোটি কোটি দর্শকের আশা-আকাঙ্ক্ষা, হতাশা-উদ্দীপনার দোলাচলের ভেতর দিয়ে আজ মাত্র দু-তিন মাস হয় আত্ম-প্রকাশ করেছে 'কোক স্টুডিও বাংলা।' বাউল গান 'আমি কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষেরে' ও রবীন্দ্রসংগীত 'একলা চলো রে'-র সাথে তিন-চার পঙ্ক্তি নাগরিক লিরিকস এবং একইসাথে দেশের নামী কিছু সংগীতশিল্পীর (সায়ান চৌধুরী অর্ণব, মমতাজ, পান্থ কানাই, বাপ্পা মজুমদার, নবাগত হাজং বা আদিবাসী গায়ক অনিমেষ রায়সহ অনেকেই) উপস্থিতিমূলক ভিডিওচিত্র সহযোগে আত্মপ্রকাশের গান 'একলা চলো রে' দিয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি 'কোক স্টুডিও বাংলা' আত্মপ্রকাশ করে। কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় লালনের বাউল আখড়া, শীত শেষের সরিষা ক্ষেত থেকে আমাদের প্রাণের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রেক্ষিতে দেশের নামী সংগীত তারকাদের এই ভিডিওচিত্র দেখে আমাদের প্রাণ ভরে উঠেছে। বেহালা, গিটার বা একতারা থেকে প্রতিদিনের বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের হারমোনিয়াম বা আমাদের দেশের নানা বাদ্যযন্ত্র প্রদর্শিত হয়েছে এই যাত্রা শুরুর দিনে। বাংলাদেশের বাইরেও পশ্চিমবঙ্গ-আসাম-ত্রিপুরা থেকে অসংখ্য দর্শক সাথে সাথেই কোক স্টুডিও বাংলার ইউটিউব চ্যানেলে শুভেচ্ছাবাণী জানান।
তবে সেই অর্থে কোক স্টুডিওর বৈভবে আন্তর্জাতিক শ্রোতা ও দর্শকমহল চমকে ওঠে ২৩ ফেব্রুয়ারি হাজং-বাংলা ভাষায় গীত দ্বৈত সংগীত 'নাসেক নাসেক' দিয়ে। ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে কোক স্টুডিও বাংলার প্রধান নির্বাহী সায়ান চৌধুরী অর্ণব ও তাঁর নেতৃত্বাধীন এই মিউজিক টিভি বাংলাদেশের প্রবল বা সংখ্যাগুরু জাতিসত্তা বাঙালি নয়, সংখ্যালঘু এক ভাষাগোষ্ঠী 'হাজং' সম্প্রদায়ের একটি গানের সাথে জনপ্রিয় বাংলা লোককবিতা ও গান 'দোল দোল দুলুনী/রাঙা মাথার চিরুণী'-ই এই মিউজিক টিভির প্রথম গান হিসেবে সম্প্রচার করেন। গায়ক ও সংগীতজ্ঞ অর্ণব এক আদিবাসী হাজং তরুণকে খাঁটি জহুরির মতো চিনতে পেরে এমন ব্রেক দিয়েছেন এবং প্রথম কিস্তিতেই এই তরুণ বাজিমাত করেছেন।
ময়মনসিংহের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের ছাত্র অনিমেষের মা-বাবাও গান করেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি দু-একবার হাজং এলাকায় যাওয়ার সুবাদে জানি যে ব্রিটিশবিরোধী টঙ্ক আন্দোলনের সময় হাজংরা কী প্রবলভাবে অত্যাচারিত হয়েছিল। কৃষকের ধানের অধিকারের পক্ষে লড়াই করার অপরাধে প্রথমে ব্রিটিশ ও পরে পাকিস্তান সরকারের সময় অসংখ্য হাজং হতাহত হন, অনেকেই চিরতরে দেশত্যাগ করেন। তবে এই বিপুল নিপীড়নের পরেও একই ভৌগোলিক এলাকায় বসবাসকারী গারোদের মতো তারা গণহারে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়নি যা মূলত তাদের সুগভীর সাংস্কৃতিক শেকড়ের প্রকাশ। তারই বিস্ফোরণ ঘটালেন অনিমেষ তাঁর গানে। গ্রামের মোড়ল বছরের শুরুতে ধান রোপনের দিনে গাঁয়ের 'চিংড়া-গাবুর-বুড়া-বুড়ি' বা শিশু-যুবক-যুবতী-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাইকে ধান রোপণের কাজে ডাকেন। তাদের অর্থকড়ি না দিতে পারলেও একবেলা ভরপেট খাইয়ে দেন। হাজং ভাষায় এ জাতীয় গানকে বলে 'কর্ম সংগীত'। শ্রমের ভারকে লাঘব করতে গানের সাথে সাথে যে কাজ করা হয়, সেটাই 'কর্ম সংগীত'। হাজং এলাকায় ঘোরার সময় দেখেছি 'প্যাক লাগানো' বা 'কাদা লাগানো'র গান, 'লতা টানা গান'-জাতীয় নানা রকম নারী-পুরুষের মিলিত শ্রমসংগীত তাদের ভেতর আজও কৌম স্তরে বিরাজ করে। অনিমেষ তাঁর জনপদের ঠিক এই গানগুলোই তুলে আনতে চেয়েছেন। জন্মসূত্রে বিশুদ্ধ বাঙালি হলে অনিমেষ রায় নামের এই হাজং যুবক এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত গতিশীলতার সাথে স্টেজ কাঁপানো নাচ ও গান উপহার দিতে পারতেন কি না আমি জানি না। ওঁর আদিবাসী সজীবতা এতই ছোঁয়াচে যে আমি দেখলাম পাকিস্তানি-ভারতীয়-মার্কিনি-ইতালীয় সবাই সেই ছোঁয়াচে রোগে সংক্রমিত হচ্ছে। আদিবাসী গানের সাথে বাংলা গানের ফিউশন (পান্থ কানাইও যথেষ্ট ভাল গেয়েছেন) এবং লোকজ ও পশ্চিমা—উভয় ধাঁচের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার, বিশাল এক যন্ত্রীদল...সব মিলিয়ে মন কাড়া আয়োজন।
এই বাংলায় শাহ আব্দুল করিম রাধার হয়ে 'কুঞ্জ সাজানোর গান' রচনা করেন আবার কবিয়াল রমেশ শীলও বাবা মাওলানার জন্য পয়ারে ছন্দ বাঁধেন। আবহমান বাংলার লোকগানের এই মিলনমুখী ভক্তির আধ্যত্মিক দিক 'কোক স্টুডিও বাংলা' সযতনে দর্শক-শ্রোতাকে নিবেদন করছে।
তারপর এলো দ্বিতীয় গান। 'প্রার্থনা'। ১ এপ্রিল বা রোজার মাস শুরু হবার ঠিক দুদিন আগে এই গান খ্যাতনামা গায়িকা মমতাজের গলায় 'আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই' ও মিজান রহমানের গলায় কবিয়াল রমেশ শীলের রচিত 'এ ভুবনে নাই যার তুলনা/নূরের পুতুলা বাবা মাওলানা'র যুগলবন্দী বা ফিউশন। চৈত্রের অবসানে বৈশাখ আসার প্রারম্ভে যখন গোটা বাংলার প্রকৃতি সূর্যের রুদ্র উত্তাপে পিপাসায় খাঁ খাঁ করে, বাংলার কৃষক হাহাকার করে এতটুকু ছায়া, মেঘ বা পানির জন্য, এ সেই সময়ের গান। এই বাংলায় শাহ আব্দুল করিম রাধার হয়ে 'কুঞ্জ সাজানোর গান' রচনা করেন আবার কবিয়াল রমেশ শীলও বাবা মাওলানার জন্য পয়ারে ছন্দ বাঁধেন। আবহমান বাংলার লোকগানের এই মিলনমুখী ভক্তির আধ্যত্মিক দিক 'কোক স্টুডিও বাংলা' সযতনে দর্শক-শ্রোতাকে নিবেদন করছে। মিজান রহমান তাঁর অংশে উচ্চগ্রামে অনায়াস গলার কাজ ও দরদমথিত আকুতিতে সবাইকে পাগল করলেও মমতাজ তাঁর নিজের প্রতি সুবিচার করেননি বলে বহু হতাশ বাংলাদেশি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সংগীত খেলাধুলা ও অভিনয় বা নৃত্যের মতো অতটা বয়সনির্ভর না হলেও বয়স এখানে একটি বিষয় বটে। তবে আমার মনে হচ্ছে বয়স নয়...কোক স্টুডিওর এই দূর্দান্ত আধুনিক পুঁজিবাদী প্রকৃতির স্টেজ, সবার জন্য একটি বিশেষ টোনের সাজপোশাক, বিপুল যন্ত্রীদল বা সামগ্রিক পরিবেশ একদম বাংলার মেঠো জীবন থেকে উঠে আসা মমতাজের গলার যে প্রাণময় বন্যতাই তার সম্পদ, সেই বন্যতার স্বতঃস্ফূর্ততাকে কোথাও যেন থামিয়ে দিতে পেরেছে। শিল্পী কি যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ বোধ করতে পারেননি? তিনি কি আড়ষ্ট বোধ করেছেন? তাঁর মৌলিক মমতাজত্ব মধ্যবিত্তের চিক্কন মসৃণতায় নয়, পঞ্চকবির গান শোনা ও শেখা মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়ের ভীরু পবিত্রতার অনুশীলন নয়—মমতাজ বড্ড লোকজ, বড্ড আদিম, শরীরী ও কখনো কখনো grotesque—সেটাই তাঁর আগুন ও সৌন্দর্য। সেটা কি কোক স্টুডিওর ক্যাপিটালিস্ট, চর্চিত সাংগীতিক আবহে আড়ষ্ট হয়ে গেছে? মমতাজের সঙ্গী গায়ক অবশ্য দুর্দান্ত গেয়েছেন।
তৃতীয় গান 'বাগিচায় বুলবুলি তুই' গানটি নিয়ে বলতে গেলে সবাই যদিও রীতু রাজকে অনেক বেশি প্রশংসা করেছেন। অবশ্যই এই তরুণ গায়ক খুবই রেওয়াজ করা ও সাধা গলায় নজরুল গীতির খেয়ালাঙ্গের নানা জটিল সুর অনায়াসে ও খুব সাবলীলভাবে উপস্থাপনা করেছেন এবং যদিও অনেকেই গায়িকা নন্দিতার অংশটিতে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, আমি ঝেড়ে কাশি...আমার কিন্তু নন্দিতার অংশটিই ভালো লেগেছে। কেন? শুনুন...আজ দেড়শো বছরের উপর বাংলা পঞ্চকবির গান সেই রবীন্দ্রসংগীতে কণিকা থেকে নজরুল গীতিতে ফিরোজা বেগমের মত রথী-মহীরথীরা তো করেই চলেছেন, কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর সাংগীতিক ভুবনে জায়গা করতে হলে শুধুই রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদাঙ্গ বা নজরুলের খেয়ালাঙ্গ দিয়েই আমরা ভুবন জয় করতে পারব, তা নয়। তাঁদের বিশুদ্ধ সুর সৃষ্টি থাকবে—সেটা আমরা, বাঙালিরা, আমাদের রোজকার জীবনে তো করবই। কিন্তু বহির্পৃথিবীর সংগীত দুনিয়ায় সাড়া ফেলতে হলে একটু ফিউশন লাগবে। আবার আমাদের অনেক লোকসংগীত বা আদিবাসী গানের রিদম হয়তো বহির্পৃথিবীর হালফিলের গানের রিদমের সাথে এমনিতেই সাযুজ্যপূর্ণ। কিন্তু নজরুলের গজল যখন আমেরিকা বা ইতালীর কোনো দর্শক দেখবেন (প্রবাসী বাঙালি নয় কিন্তু) তখন সামান্য ফিউশন লাগবে। এই ফিউশন অংশটুকুই নন্দিতা গেয়েছেন এবং তাঁকে মানিয়ে গেছে। আরো বিস্মিত হয়েছি যখন কোক স্টুডিও বাংলার এক নিয়মিত দর্শক ও আলোচক, ইতালীয় সংগীতশিল্পী গিভান্নি নজরুলের গজলে স্প্যানিশ সুরের প্রভাব লক্ষ করেছেন বলে ইউটিউবে জানালেন। কে জানে কবে কোন স্পেনের মুর সাম্রারাজ্যের হাত ধরে সংগীতের আন্তঃহাদেশীয় ভ্রমণে তাদের কোনো সুর আরব-পারস্য হয়ে ভারত উপমহাদেশের গজলেও প্রবেশ করেছে কি না!
কোক স্টুডিও বাংলার চতুর্থ গান 'ভবের পাগল' বাংলা র্যাপের এক দুর্দান্ত প্রকাশ! লালন ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা তথা প্রধান গায়িকা নিগার সুমি ও জালালী সেটের এই যুগলবন্দীতে কপালে টিপ অথচ পশ্চিমা পোশাকে, সহজ নাচের ছন্দে সুমি গেয়েছেন 'খাজার প্রেমে পাগল হইয়া/ঘুরি আমি আজমীর গিয়া রে'। তবে এই গানের মূল অংশ জালালী সেটের করা ভয়ানক গতির বাংলা র্যাপ। বাংলা র্যাপ এত দ্রুতগতির ও সাবলীল হতে পারে, এটা 'ভবের পাগল' না দেখলে আমার জানা হতো না।
হাজং গান, লোকজ প্রার্থনাসংগীত থেকে নজরুলগীতি হয়ে ভাওয়াইয়া...মুগ্ধতার সীমা থাকছে না। এবং সবচেয়ে বড় বিষয় বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে এই গান রিলিজড...ভাওয়াইয়ার বাণীতেও যে 'চান্দের' কথা আছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যত সীমাবদ্ধতা থাকুক, কোক স্টুডিও বাংলা এখন পর্যন্ত সব জাতিসত্তা বা সব ধর্মের অনুষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছে।
এবার আসি অর্ণব ও রিপন কুমার সরকার বা বগা তালেবের, যৌথ তথা কোক স্টুডিও বাংলার শেষতম পরিবেশনা 'চিলতে রোদ—ও কি একবার আসিয়া' ফিউশন প্রসঙ্গে। ফেসবুকে গত রাতে দেখি এক লেখক অর্ণবকে গুলি করতে চেয়েছেন। কোক স্টুডিও বাংলার নতুনতম গানটির জন্য। সবসময় তো অত আপডেটেড থাকা হয় না। তা সাথে সাথে অন্তর্জালে খুঁজে পেয়ে গেলাম অর্ণবের 'চিলতে রোদ' ও আব্বাস উদ্দীনের সুবিখ্যাত, মরমী ভাওয়াইয়া গানটির যুগলবন্দি। কিন্ত এই গান দেখে অর্ণবকে গুলি করতে ইচ্ছে হলো কেন? ওই 'বাগিচায় বুলবুলি' গানের সময় নজরুলের গানের শুদ্ধতা নষ্ট হচ্ছে বলে কেউ রাগ করছিলেন? দেখুন, পোশাকে যেমন কনট্রাস্ট বলে একটা বিষয় থাকে...সাদা সালোয়ারের সাথে সাদা ওড়না আবার হয়তো নীল কামিজ...সংগীতে কনট্রাস্ট বলুন বা ফিউশন বলুন...সে তো অভিনব ও সুন্দর। আমার তো মন ভরে গেল। অর্ণবের সাথে 'ও কি একবার আসিয়া'র সেই আবহমান ভাওয়াইয়া গানের ধুয়া ধরে রিপনের অসম্ভব উচ্চতায় বাঁধা গলা, গানের শুরুতে এস্রাজ এবং পরে সানাইয়ের অসামান্য ব্যবহার...দুই পাকিস্তানি ইউটিউবারের একজন দেখলাম কাঁদলেন। ভাষা, জাতিগত অহম সবকিছু ছাপিয়ে বাংলা গান সারা পৃথিবীর মানুষকে কাঁদাচ্ছে, হাসাচ্ছে...এর কি কোনো তুলনা আছে বা হয়?
ধন্যবাদ কোক স্টুডিও বাংলা ও ধন্যবাদ এর পরিচালকের আসনে অর্ণবকে।
হাজং গান, লোকজ প্রার্থনাসংগীত থেকে নজরুলগীতি হয়ে ভাওয়াইয়া...মুগ্ধতার সীমা থাকছে না। এবং সবচেয়ে বড় বিষয় বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে এই গান রিলিজড...ভাওয়াইয়ার বাণীতেও যে 'চান্দের' কথা আছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যত সীমাবদ্ধতা থাকুক, কোক স্টুডিও বাংলা এখন পর্যন্ত সব জাতিসত্তা বা সব ধর্মের অনুষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছে।
অর্ণবের গলায় এই যুগলবন্দীর নাগরিক লিরিকের অংশ হলো:
রেতের বেলায় একলা এখন
জিরোচ্ছে সব শহরতলি
চোখ দুটো খুব পড়ছে মনে
এই কথাটা কেমনে বলি!!?
আর রিপন তাঁর অসামান্য কন্ঠে গাইলেন ভাওয়াইয়ার ততোধিক অবিস্মরণীয় পদ:
ওকি একবার আসিয়া
সোনার চান্দ মোর যাও দেখিয়া রে
ও দিয়া ও দিয়া যান রে বন্ধু
ডারা না হোন পার
ওরে থাউক মন তোর
দিবার থুবার দেখায় পাওয়া ভার রে..
কোড়া কান্দে কুড়ি কান্দে
কান্দে বালি হাঁস
ওরে ডাহুকি কান্দনে ও মুই ছাড়নু ভাইয়ার দ্যাশ রে..
আইলত ফোটে আইল কাশিয়া
দোলাত ফোটে হোলা
ওরে বাপ-মায়ে বেচেয়া খাইছে সোয়ামি পাগেলা রে
লোকে যেমন ময়নারে পোষে পিঞ্জিরাত ভরিয়া
ওরে ওই মতন নারীর যৌবন রাকিছং বান্দিয়া রে...
তবে অর্ণবদের এই ফিউশনে অবশ্য ভাওয়াইয়াটির শেষ পাঁচ পঙ্ক্তি বাদ দেয়া হয়েছে। কোক স্টুডিও বাংলার সর্বশেষ গান নিয়ে ইতোমধ্যে তর্ক শুরু হয়েছে। মূল প্রশ্ন: ফিউশন ঠিক কি বেঠিক।
'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' পড়তে গিয়েই দেখছি তরুণ শেখ মুজিব (তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু হননি) একবার একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে পরিচিত হলেন যুবক আব্বাস উদ্দিনের সাথে। ফেরার পথে তরুণ মুজিব আরেক তরুণ আব্বাস উদ্দিনকে অনুরোধ করছেন যেন আরো বেশি বেশি বাংলা গান ও বিশেষত বাংলার হারাতে থাকা লোকসংগীত রচনা, সংগ্রহ করেন এবং গেয়ে গেয়ে তার বিস্তার ঘটান। মনে রাখতে হবে যে তখন আমরা পাক শাসনাধীন। এটা সম্ভবত ১৯৫০-৫১ সালের কথা। তখনো বাংলাদেশে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন হয়নি। তবে, ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসে জিন্নাহর 'ওনলি উর্দূ উইল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গোয়েজ'-এর প্রতিবাদে স্কুলের বাচ্চা ছেলেরাও ততদিনে জেল খেটেছে। লোকসংগীত শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের কথা শৈশব থেকেই শুনেছি। আমরা অবশ্য আমাদের ছোটবেলায় ওনার মেয়ে ফেরদৌসী রহমানের 'এসো, গান শিখি' নামে শিশুদের সাথে গান শেখার আসর দেখেছি বিটিভিতে। ওনার ছেলে মোস্তফা জামান আব্বাসির লোকসংগীত নিয়ে ধারাবাহিক অনুষ্ঠানও দেখেছি টিভিতে। বড় হতে হতে শুনেছি রাজনৈতিক ভাবে ওমারা বিএনপি সমর্থক (সত্য-মিথ্যা জানি না)। পরে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ কার কেমন হয়েছে, তা সঠিক না জানলেও পাক শাসনের শুরুর সেই সময়ে কিন্ত বাংলার গায়ক বা বাংলার তরুণ রাজনীতিবিদ সবাই বাংলা গানের কথা ভাবছেন, বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে চাইছেন।
ফিউশন এমন জিনিস যে এটা সবার পছন্দ হবে না। শুধু সংগীত না, সাহিত্যেও যেমন সবাই...সবাই কেন...সত্যি বলতে আশি ভাগ পাঠক ফিউশন নিতে পারেন না। গানেও তাই দেখছি।
এখন এই 'বগার গান' বা ভাওয়াইয়া গানটি ছোটবেলা থেকে শুনেছি। বিটিভিতে ছোটবেলায় নীনা হামিদ নামে একজনকে গাইতে দেখতাম। বেশ উঁচু কণ্ঠের এক দরাজদিল গায়িকা। ছিলেন ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, দীপ্তি রাজবংশী বা রথীন্দ্রনাথ রায়ের মত ভাওয়াইয়া গায়কেরা। এত শুনেও কোনোদিন ভাওয়াইয়া গানের বাণী খুব আগ্রহী হয়ে শুনেছি বা প্রতিটি পঙ্ক্তি জানতে চেয়েছি এমন না। একটু লজ্জার সাথেই বলি: দেশে থাকে আমার একমাত্র যে ভাই, তার মেয়েটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলছাত্রী হয়েও ছায়ানটে গিয়ে রবীন্দ্র-নজরুল-লোকসংগীত সব শিখেও ও যে লোকসংগীত গাইতে বেশি ভালবাসে, সেটা ওর দূরবর্তী এক অভিভাবক হিসেবে আমার তত পছন্দ হয়নি।
'কোন গান তোর সবচেয়ে ভাল লাগে রে?'
শান্ত মেয়েটি মাথা দুলিয়ে, লাজুক হাসিতে বলে, 'ফোক সং।'
ছোট মানুষ তো, লোকগানের তালের ব্যঞ্জনা হয়তো ওর ভালো লাগে। ছোট মানুষ গানের সব অর্থ না বুঝেই খুব দরদ দিয়ে আর মাথা ঝাঁকিয়ে মাঝে মাঝে যখন ওদের বাসায় বসে লোকগান গায়, আমার গীতবিতানশাসিত কানে লোকগানের কোনো কোনো শব্দ অরুচিকর লাগে। অভিভাবক হিসেবে ভ্রাতুষ্পুত্রী যেন এখনই এসব 'অরুচিকর' শব্দের সাথে পরিচিত না হয়, সেই আশঙ্কায় ওর বাবা-মার সামনেই বলি, 'মামণি, তুমি রবীন্দ্রসংগীত গাও বেশি বেশি করে। এগুলি কি সব গাচ্ছিস বল তো?'
নজরুল গীতিও সে ভালোবাসে। সেখানেও আমার সতর্ক কান মাঝে মাঝে ভাবে, নজরুলের গানে প্রেম রবীন্দ্রগানের মতই নিয়ন্ত্রিত তো?
তা এই আমি গতকাল কোক স্টুডিওর ভাওয়াইয়া শুনে ইউটিউবে সার্চ করে পুরো গানটি তুললাম। অর্ণবরা পুরো গানটি ব্যবহার করেননি। যে পঙ্ক্তিগুলো ব্যবহার করেননি—আশা করি অর্ণব আমার মতই মধ্যবিত্ত রুচির জায়গা থেকে বাদ দেননি? আমার মধ্যবিত্ত রুচিতে একটু ঘাই খেল বটে, কিন্ত শেষ পঙ্ক্তির ওই কথাগুলো যে রংপুর-দিনাজপুর থেকে উঠে এসেছেন মধ্যবিত্ত নারীর পরম প্রতীক রোকেয়া ও তাঁর সেই সময়ের নারীবাদ...সেই সামন্ত-নন্দিনী, ইংরেজি শিক্ষিতা রোকেয়া তো বটেই, হালের তসলিমা থেকে শুরু করে অনেক নারীবাদীর থেকেও সাহসী লাগল বাংলার কোন গ্রামের নারীর আর্তি বা বিলাপ! বাংলা ভাষার শব্দ-সম্পদের কথা ভেবেও অবাক হতে হলো। যা আমাদের স্কুল-কলেজগুলোর পাঠ্যবই-নিয়ন্ত্রিত গদ্য-পদ্য থেকে অসম্ভব আলাদা!
ওরে বাপ-মায়ে বেচেয়া খাইছে সোয়ামি পাগেলা রে
লোকে যেমন ময়নারে পোষে পিঞ্জিরাত ভরিয়া
ওরে ওই মতন নারীর যৌবন রাকিছং বান্দিয়া রে
এই গানের তরুণী নারীটিকে কি বিয়ে করতে হয়েছে অপছন্দের কাউকে? বাবা-মা তাকে অর্থলোভে কি 'বেচে দিয়েছে' কোনো বৃদ্ধ বা প্রৌঢ়ের সাথে? আর তার আরাধ্য যুবককে সে একটিবার চোখের দেখা দেখতে চাইছে? তার যৌবন তবে চরিতার্থ নয় এই বৃদ্ধ বা প্রৌঢ়ের সাথে? খাঁচায় বন্দি ময়না পাখির মত যৌবনকে 'রাকিছং বান্ধিয়া রে'। এরই পাশে সেই একই রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের জমিদারকন্যা ও ইংরেজিশিক্ষিতা বেগম রোকেয়ার 'সুলতানাস ড্রিম' বা 'পদ্মরাগ'-এর মেয়েরা কথা বলে অনেক বেশি ধোপ-দুরস্ত বইয়ের ভাষায়। হয়তো ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই তারা শুধু 'কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া ছাড়িয়া দাও। নিজেদের অন্ন-বস্ত্র নিজেরাই উপার্জন করিয়া নিক' পর্যন্ত মুখ ফুটে বলতে পারে। নিরক্ষর নারীর মতো 'খাঁচায় পোরা ময়না পাখি'র মতো অচরিতার্থ যৌবনের কথা সেই শিক্ষিতা নারীরা বলতে পারে না। 'পদ্মরাগে'র জয়নব বরের প্রতি অভিমানে ও নারীর স্বাধিকার বোধ থেকে একা থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে পারে বটে, তবে যৌন স্বাধীণতার কথা তার ভাবাও মানা। সেই ধারাবাহিকতা আজও কি চলছে না বাংলাদেশে? অন্তত শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত নারীর ক্ষেত্রে? সুখী, বিবাহিতা জীবন ব্যতীত অন্য যেকোনো জীবনে তাকে শুধু সমাজের দশজনের কাছে নিজের শুচিতার পরীক্ষা দিয়ে চলতে হয়? অবিবাহিতা, বিবাহবিচ্ছিন্না বা বিধবা হিসেবে নিরন্তর শুচিতার পরীক্ষা দিতে হয়।
ফিউশন একদিনে সবাই নিতে পারবেন না। সাহিত্য বা সংগীতে যে বা যারাই ফিউশন করতে চাইবেন, তাকেই যথেষ্ট গালি শুনতে হবে। একদিনে আমরা পাস্তা বা স্প্যাগেটি খেতে ভালবাসিনি। তবে ধীরে ধীরে প্রতিদিনের ডাল-ভাতের সাথে এসব খাবারও ঠাঁই নিয়েছে। এত কিছুর পরও পরিবর্তন আসবেই।
আমি কি মূল প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে এখনো ধান ভানতে শিবের গীতই গাইছি? কেন অর্ণবের ফিউশনকে খারাপ না বলে বা কেন এটা ভালো, সেটার পক্ষেও যুক্তি না দিয়ে অন্য কথা বলছি? দেখুন, ফিউশন এমন জিনিস যে এটা সবার পছন্দ হবে না। শুধু সংগীত না, সাহিত্যেও যেমন সবাই...সবাই কেন...সত্যি বলতে আশি ভাগ পাঠক ফিউশন নিতে পারেন না। গানেও তাই দেখছি। সেটা 'বুলবুলি'র গানে যেমন হলো, তেমন এই ভাওয়াইয়াতেও। তবু ফিউশন হবেই। এটাই কালের বহমানতা। পুরাতনকে নবীনকৃত করা। আজ দেখুন পশ্চিমে 'মোনালিসা' থেকে ভ্যান গঘের 'স্টারি নাইট' বা নানা ছবিকেও উল্টে-পাল্টে দেয়া হচ্ছে। ভ্যান গঘ পথে হাঁটতে হাঁটতে পিছু ফিরে মোনালিসাকে দেখছেন বা এ-জাতীয় মজার মজার সব ছবি হচ্ছে। বিহারি ক্যাম্পে যখন ২০০৫-এ একটি ফিচারের কাজে যাই, আমাকে অবাক করে ১০০ ভাগ মুসলিম বিহারি ক্যাম্পের নেতারা বললেন 'উর্দু' আদৌ তাদের মাতৃভাষা নয়। আমাদের বাঙালি কানে আমরা যাকে উর্দু ভাবি, সেটা আসলে ভারতের বিহার অঞ্চলের মৈথিলী, ভোজপুরী ও ব্রজবুলি ডায়ালেক্ট। শুনে আমার আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা! ব্রজবুলি, মানে 'ভানু সিংহের পদাবলী'? বিদ্যাপতিদের সময় থেকে অনেক পরিবর্তনের বাঁক বয়ে জেনেভা ক্যাম্পের অটো পার্টসের দোকানের আজকের ওই বিহারি যুবকটির মৈথিলী বা ব্রজবুলি নিশ্চিত আলাদা। আজকের কবি ব্রজবুলি ভাষা ব্যবহার করে লিখতে চাইলেও সেটা রিমিক্স বা ফিউশন করেই লিখতে হবে। কোরআন বা তারও আগে ইমরুল কায়েসের কবিতার আরবি আর আজকের আরবি যেমন এক না। আজকের কোনো কবি অসীম স্পর্ধায় ইমরুল কায়েসের সময়ের আরবি বা অতীতের ব্রজবুলি খুব ভালোভাবে শিখে ব্যবহার করলেও হুবহু সেই অতীতের কাব্য ফটোকপি করে চালাতে পারবেন না। তাকে আজকের সময়ের সাথে মিলাতে হবে। 'ফুলমণি ও করুণার বিবরণ'-এ হ্যানা ক্যাথেরিনের গদ্যরীতি যেমন আমার কোনো একটি গল্পে ব্যবহারের আগ্রহ আছে। তবে সেটা আমার সময়ের ভাষার সাথে মিলিয়েই করতে হবে। তারপর নতুন প্রজন্মের আগ্রহ জাগানোর বিষয় তো আছেই। সর্বোপরি ফিউশন একদিনে সবাই নিতে পারবেন না। সাহিত্য বা সংগীতে যে বা যারাই ফিউশন করতে চাইবেন, তাকেই যথেষ্ট গালি শুনতে হবে। একদিনে আমরা পাস্তা বা স্প্যাগেটি খেতে ভালোবাসিনি। তবে ধীরে ধীরে প্রতিদিনের ডাল-ভাতের সাথে এসব খাবারও ঠাঁই নিয়েছে। এত কিছুর পরও পরিবর্তন আসবেই। ধীরে ধীরে পরিবর্তনই জয়ী হবে।
ওহ, কোক স্টুডিও বাংলাকে আরো ধন্যবাদ প্রতিটি গানের সাথে সুন্দর ইংরেজি সাবটাইটেল বা ভালো মানসম্পন্ন অনুবাদের জন্য। বুদ্ধ পূর্ণিমার চন্দ্রাহত রাতের সাথে ভাওয়াইয়া গানের পূর্ণিমা, গৌতম বুদ্ধের স্ত্রী-পুত্রের বেদনার সাথে উত্তর বাংলার কোনো বিরহিনী, গ্রাম্য নারীর আর্তি মিলিয়ে দেবার ফিউশন আমার অসামান্য মনে হলো। সর্বশেষ ইতালীয় গায়ক জিভান্নিকেও দেখলাম অর্ণব ও রিপনের ভিন্নমুখী দুই গানের সম্মিলনের জন্যই গানটি এমন অনবদ্য হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন।
বাংলা গান জয়ী হোক, অমরত্ব পাক। এই লেখাটাও লিখছি ১৯ মে—শিলচরের বা বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি থাকল।
- অদিতি ফাল্গুনী: কথাসাহিত্যিক, কবি, অনুবাদক