দার্শনিক দুগিনের চোখ দিয়ে পুতিন বিশ্বকে দেখেন!
পূর্ব ও পশ্চিমের সংঘাত—ভূরাজনীতির আলোচনায় স্পর্শকাতর তদুপরি সংবেদনশীল এ তত্ত্বকে পুতিন হাজির করেছেন ইউক্রেন যুদ্ধের প্রামাণ্য যুক্তি হিসেবে—যাকে তিনি বলছেন 'সভ্যতার সংঘাত'। ইতিহাসে পূর্ব ও পশ্চিম দুই দুটি রোমান সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। পুতিনের কাছে তৃতীয় রোম তার রাজধানী মস্কো; রোমক ও বাইজান্টাইন (পূর্ব রোমান) সাম্রাজ্যের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বাহক তথা উত্তরসূরি। একইসঙ্গে, ইউরোপের একক আধিপত্যের বিরোধীতার কেন্দ্র—এতোটা শক্তিশালী (এবং কতৃত্ববাদী) যে উদার আধুনিকাতাবাদ, বহু-সাংস্কৃতিকতা ও প্রগতিশীল মূল্যবোধের সৃষ্ট হুমকি মোকাবিলা করতে পারে অবলীলায়।
এই দৃষ্টিভঙ্গির আতসকাঁচে স্বাধীন ইউক্রেনের ধারণা- দুর্বৃত্ত পশ্চিমা 'সেকুলার কর্তৃপক্ষের' তৈরি এক অলীক কল্পনা মাত্র। রুশ প্রেসিডেন্টের স্থির বিশ্বাস- ইউক্রেন ও রাশিয়া এক 'আত্মিক বন্ধনে বাঁধা' এবং তা শুধু অভিন্ন অর্থোডক্স খ্রিষ্টধর্মের কারণেই নয়; বরং উভয় জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষরা এসেছে 'প্রাচীন রুশ' নামক কিয়েভকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ফেডারেশন থেকে।
পুতিনের ভাবনার জগতে 'আত্মিক বন্ধনের' এই ধারণা রহস্যময় উৎসের ইঙ্গিত দেয়। পশ্চিমাদের দাবি, পুতিন সাম্রাজ্যবাদী। যদিও নিজেদের ব্যাপারে তারা একথা বলতে নারাজ। তাদের মতে, পুতিন নিজের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে প্রাচীনপন্থী স্থিতিশীলতার শক্তি এবং উদারনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী শত্রুর সাথে এক পৌরাণিক মহাসমর হিসেবে ভাবছেন।
রুশ প্রেসিডেন্টের এই রহস্যময় চিন্তার জগতকে বুঝতে হলে—জানতে হবে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পেছনে তার মৌলিক চিন্তাকে— এবং আমাদের অবশ্যই পুতিনের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী কট্টর ডানপন্থী লেখক ও দার্শনিক আলেক্সান্ডার দুগিনকে জানতে ও বুঝতে হবে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রায়শই দুগিনকে 'পুতিনের রাসপুতিন' বা 'পুতিনের মস্তিস্ক' বলেও আখ্যা দেয় এবং তা অতিরঞ্জনও নয়। ওয়াশিংটনের কলামিস্ট ডেভিড ভন ড্রেহলের ভাষায়, তিনিই পুতিনের ইউক্রেন কৌশলের প্রকৃত লেখক।
অথচ রুশ সরকারে কোনো আনুষ্ঠানিক পদাধিকারী নন দুগিন। রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও দার্শনিকের পাশাপাশি তিনি একজন শিক্ষাবিদ এবং পুতিন ও রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের গোঁড়া সমর্থক জারগ্রাড টিভি চ্যানেলের সাবেক প্রধান সম্পাদক।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা আলোচনা না করার বিষয়ে অত্যন্ত সাবধানী তিনি। তার এমন বাচনশৈলী ও আড়ম্বরপূর্ণ ভাষা অনেক দিন আগেই ক্রেমলিন রপ্ত করেছে।
ছোট্ট একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল দখলের দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিল রাশিয়ার। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে এই অঞ্চলকে 'নভো রুশিয়া' বা নতুন রাশিয়া বলে অভিহিত করে দুগিন। এরপরই ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় রাশিয়া। এসময় রাষ্ট্রীয় প্রপাগান্ডায় ইউক্রেনের উপদ্বীপটির দখলকে বৈধতা দিতে 'নভো রুশিয়া' সম্বোধনটির বহুল ব্যবহার হয়েছে। দুগিনের লেখনীর একনিষ্ঠ পাঠকমাত্রই তার চিন্তাচেতনার প্রতিধ্বনি শুনেছেন, ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর আগে ও পরে দেওয়া পুতিনের সাম্প্রতিককালের বক্তৃতায়। এ সুর এতটাই স্পষ্ট যা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না।
২.
কিন্তু আজকের দুগিনের বেড়ে ওঠা কীভাবে? ১৯৬২ সালে উচ্চপদস্থ এক সোভিয়েত পরিবারে জন্ম তার। দুগিনের বাবা ছিলেন সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। চরম ডানপন্থী সংবাদপত্র 'ডেন'- এর একজন নিয়মিত লেখক হিসেবে ১৯৯০ এর দশকে রাশিয়ায় জাতীয় পর্যায়ে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে দুগিনের। ১৯৯১ সালে ডেন- এ প্রকাশিত হয় তার একটি সিরিজ ম্যানিফেস্টো। 'দ্য গ্রেট ওয়ার অব কন্টিনেন্টস' শীর্ষক ওই লেখনীতে তিনি রাশিয়াকে 'চিরন্তন রোম' হিসেবে তুলে ধরেন। তার ভবিষ্যৎ কামনায় উঠে আসে, এই সাম্রাজ্য কীভাবে পশ্চিমের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও বস্তুবাদী বৈরী সাম্রাজ্য তথা 'চিরন্তন কার্থেজ'- এর বিরুদ্ধে লড়বে।
১৯৯০ এর দশকের শুরুতে তিনি বিতর্কিত উপন্যাসিক এডুয়ার্ড লিমোনভের সাথে ন্যাশনাল বলশেভিক পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন দলের ভাবাদর্শে সমাজতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের নানান কাল্পনিক আদর্শের মেলবন্ধন ঘটে- এমন বিশ্লেষণ পশ্চিমা গণমাধ্যমের। তবে এটি হয়ে ওঠে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির এক সূতিকাগার। এমনকী দলীয় পতাকায় লাল পটভূমির ওপর আঁকা সাদা বৃত্তের মাঝে স্থান পায় একটি কালো রঙের কাস্তে। এই প্রতীকটি সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের, কিন্তু পুরো নকশা দেখতে অনেকটাই লাগে নাৎসি রাষ্ট্রের (থার্ড রাইখ) স্বস্তিকা আঁকা পতাকার মতো। দলের মূলমন্ত্র 'দা স্মের্ত' (নিশ্চিত মৃত্যু) নাৎসিদের সিগ হেইল স্লোগানের মতো হাত উঁচিয়ে পাঠ করতো অনুসারীরা।
আরও পড়ুন- আলেক্সান্ডার দুগিন: পুতিনের প্রিয় দার্শনিক, ইউক্রেন যুদ্ধের রূপকার!
১৯৯৭ সালে দুগিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই 'দ্য ফাউন্ডেশন্স অব জিওপলিটিক্স: দ্য জিওপলিটিক্যাল ফিউচার অভ রাশিয়া" প্রকাশিত হয়। এটি এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, সুপারশপের চেকআউট কাউন্টারে স্থান পেতে থাকে। পশ্চিমা বিশ্বকে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে- তারই ফর্মুলা বাৎলে দিয়েছিল ভূরাজনীতি নিয়ে লেখা এ বইটি। সেখানে গণমাধ্যম ও সংস্কৃতির কোমল শক্তির সাথে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানোকে পশ্চিমা সমাজে বিভাজন ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির উপায় হিসেবে তুলে ধরেন দুগিন। তিনি এসব সমাজের অন্তর্নিহিত বর্ণবাদী ও রাজনৈতিক উত্তেজনা উস্কে দেওয়ার পরামর্শ দেন। একইসঙ্গে, রাশিয়ার অভ্যন্তরে জাতীয়তাবাদ ও কর্তৃত্ববাদী শাসনকে সুসংহত করার পক্ষে বলেছেন। রাশিয়ার বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতির দিকে তাকালে- দুগিনের এ কৌশলের যেন স্পষ্ট প্রতিফলনই লক্ষ করা যায়।
বুদ্ধিজীবীতার সাথে রাজনীতির ময়দানে সরাসরি সম্পৃক্ততার মধ্যে এরপর থেকেই তিনি এক রকম ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছেন। ২০০২ সালে তিনি চরম ডানপন্থী ইউরেশিয়া পার্টি গঠন করেন। পুতিন প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাই সেসময় এ দল গঠনকে স্বাগত জানান। রাশিয়া বিশ্লেষক অ্যান্টন বারবাশিন ও হান্নাহ থোবার্ন ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে লেখা এক নিবন্ধে বিষয়টির উল্লেখ করেন। তারা আরও উল্লেখ করেন, দলটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সের্গেই গ্লাজিয়েভের সাথে। গ্লাজিয়েভ স্বদেশবাদী রাজনৈতিক জোট- রড্রিয়ার একজন জ্যেষ্ঠ নেতা এবং বর্তমানে পুতিনের 'ইউরেশিয়া একীভূতকরণ' বিষয়ক শীর্ষ পরামর্শক।
সোভিয়েত যুগ অবসান পরবর্তী আধুনিক রাশিয়ার বেশকিছু সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন দুগিন ও তার সমর্থকেরা। ২০০৮ সালে রাশিয়-জর্জিয়া যুদ্ধের আগে থেকেই যে অঞ্চলের দখল ঘিরে যুদ্ধের সূত্রপাত সেই ওশেটিয়ায় সক্রিয় প্রচারণা চালিয়েছেন দুগিন। ২০১৪ সালে তিনি ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্নতাকামীদের সাথেও কাজ করেছেন।
২০০৯ সালে তাকে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অনুষদের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের সম্মানীয় চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ইউক্রেনীয়দের গণহত্যার আহ্বান জানানোর কারণেই তাকে এই পদটি হারাতে হয় বলে গুঞ্জন রয়েছে, তবে সঠিক কারণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
রুশ টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক আলোচনায় আজ তিনি একজন অপরিহার্য বক্তা, পুতিনের অনুমোদন ছাড়া যা কখনোই হতো না।
দুগিনের লেখনী গভীরভাবে পড়লে, তার লক্ষ্যের বিষয়ে কোনো সংশয় থাকে না। তিনি সরাসরি একটি অমিত পরাক্রমশালী, কর্তৃত্ববাদী রুশ রাষ্ট্র চান। রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের তথাকথিত উদারপন্থী পশ্চিমা শত্রুদের সমূলে বিনাশ চান। ২০০৯ সালের দ্য ফাউন্ডেশন্স অব জিওপলিটিক্স গ্রন্থের পরবর্তী রচনা 'দ্য ফোর্থ পলিটিক্যাল থিওরি'তে দুগিন মতপ্রকাশ করেন, "সমসাময়ীক বিশ্বব্যবস্থাকে এখন 'মানবাধিকার, শ্রেণি-বিভাজন বিরোধী এবং রাজনৈতিক সঠিকত্ব নিয়ে নাক গলানো শক্তির প্রতিনিধি আটলান্টিক আমেরিকান ও ইউরোপীয়দের সাথে 'ইউরেশীয়' রুশ সংস্কৃতির সংঘাত হিসেবে ধরে নিয়ে বুঝতে হবে। রুশ সংস্কৃতি এখনও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, সে তুলনায় বহু আগেই নৈতিকতা হারিয়েছে পশ্চিমা সভ্যতা। তারা মানবজীবনের প্রাথমিক কিছু স্তম্ভ: ঈশ্বর, প্রথা, সমাজ, জাতি-পরিচয়, সাম্রাজ্য ও রাজ্যের ইতিহাসকে সম্মান দেখানো থেকে পথচ্যুত হয়েছে।"
দুগিনের রুশ সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার ভিশন কেবল রুশ সংস্কৃতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘিরে নয়, একইসঙ্গে তা ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তনের রূপকল্প। দুগিন অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাসী, প্রতিক্রিয়াশীল এবং প্রথাবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু তার ধারণার প্রথাবাদের শিকড় আরও প্রাচীন, যা তিনি রুশ জাতির ইতিহাসের নিরিখে প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। পূর্ব ও পশ্চিমা সভ্যতাগুলোর সংঘাত যেখানে অনিবার্য।
সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট অবলম্বনে