‘আমদানি মূল্যস্ফীতি’ মোকাবিলায় ৮টি চ্যালেঞ্জিং কাজ নির্ধারণ বাজেটে
মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা সামলানো, উৎপাদনমুখী উন্নয়নকাজ অব্যাহত রাখা এবং জীবিকা রক্ষার জন্য 'আমদানি মূল্যস্ফীতি'কে অর্থনীতির মূল কালপ্রিট হিসেবে চিহ্নিত করে অর্থ মন্ত্রণালয় জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন অর্থবছরে করার জন্য আটটি চ্যালেঞ্জিং কাজের তালিকা প্রস্তুত করেছে।
বাজেট প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানেন, এমন অর্থ কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সম্পূর্ণ ধাক্কা যেন ভোক্তাদের কাঁধে না চাপে, সেজন্য নতুন বাজেটের অন্যতম অগ্রাধিকার হবে জ্বালানি, গ্যাস ও সারের বাড়তি ভর্তুকির জন্য অর্থ সংগ্রহ করা এবং সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানো।
সরকারের কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার জন্য আমদানি কমানো, কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প পিছিয়ে দেওয়া ও সুদের হার ৯ শতাংশের মধ্যে রাখা। এছাড়া বাজেট ঘাটতি কমাতে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগকে সহায়তা দেওয়াও করণীয় তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'সরকার এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় খুব কৌশলী হবে। তবে মূল কৌশল হবে বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ চাহিদা অক্ষুণ্ন রেখে সরবরাহ বাড়ানো। সেজন্য পরিচালন বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি ক্রয়, নতুন ভবন নির্মাণসহ বিলাসিতা ও কম গুরুত্বপূর্ণ খরচগুলো কমিয়ে উৎপাদনমুখী কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।'
আমদানি ব্যয় যেন যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা যায়, সেজন্য দেশীয়ভাবে উৎপাদিত বিলাসদ্রব্য ও পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করা হবে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা। পাশাপাশি কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বাড়াবে, এমন প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। প্রয়োজনে এসব প্রকল্পে বাড়তি বরাদ্দও দেওয়া হবে। এছাড়া বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখবে বলেও জানান অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা।
অর্থবছরের শুরুতেই জ্বালানি জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম পরিকল্পনা সরকারের নেই বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ কারণে এই তিন খাতে ভর্তুকি বাড়তে চলেছে।
তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হলে এবং দেশ দুটির আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য স্বাভাবিক না হলে তখন সরকার ভর্তুকি কমিয়ে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
তারা আশঙ্কা করছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার কয়েক দফা অবমূল্যায়নের ফলে দেশের প্রধান ভোগ্যপণ্যসমূহেরর দাম আরও বাড়তে পারে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের নয়টি 'কৌশলগত পণ্য'—জ্বালানি তেল, এলএনজি, গম, রাসায়নিক সার, পাম তেল, সয়াবিন তেল, কয়লা, ভুট্টা ও চালের দাম বেড়েছে।
চলতি বছর এই পণ্যগুলো গত বছরের সমপরিমাণ আমদানি করা হলেও এগুলো আমদানি করতে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ৮.২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে শুধু মূল্যবৃদ্ধির কারণে। সরকারি তথ্য বলছে, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার জন্য এই অতিরিক্ত আমদানি ব্যয়ই দায়ী।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ১১৩ ডলারের বেশি হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বেড়েছে অন্তত ১২ গুণ। আন্তর্জাতিক বাজারে চলতি বছরের এপ্রিলে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ, আর ইউরিয়া সারের দাম বেড়েছে তিন গুণ।
এছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সয়াবিন তেলের দাম ৪০ শতাংশ, গমের দাম ৮০ শতাংশ এবং চিনির দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে। শিল্প কাঁচামাল ও পরিবহন খরচও অনেক বেড়ে গেছে।
সরকারি হিসাবে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তবে বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলোর হিসাবে মূল্যস্ফীতির হার অন্তত ১২ শতাংশ।
এই পরিস্থিতিতে ফেডারেশন অভ বাংলাদেশ চেম্বার্স অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) ও বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম না বাড়াতে সরকারের কাছে আবেদন করেছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি শিল্প উৎপাদনও ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
এ অবস্থায় অর্থ মন্ত্রণালয় সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবছে। এছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী উৎপাদনমুখী প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়িয়ে জনগণের আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও ভাবছে মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে করোনা মহামারির সময় ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হবে।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও টিবিএসকে বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই প্রেক্ষাপটে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকারি ভর্তুকি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা ধরা হয়েছে ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশ।