কনটেইনার ডিপোতে আগুন: মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়েছে পুরো চট্টগ্রাম
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আহত-নিহতদের নিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আসছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। মুহূর্তেই কিছু যুবক এগিয়ে গিয়ে তাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন বার্ন ইউনিটের দিকে। অন্যদিকে রোগীদের রক্ত দিতে চমেকের ব্লাড ব্যাংকের সামনা লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন আরেক দল যুবক। আবার কেউ আগুনে পোড়া রোগীদের হাতপাখা দিয়ে ক্রমাগত বাতাস করেই যাচ্ছিলেন। এরা কেউ কারও পরিচিত নন, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন হাসপাতালে, হয়ে উঠেছেন এক পরিবার।
অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতায় হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। চিকিৎসকদের প্রশাসক সিভিল সার্জন তখন ডাক দিলেন মানবিক সাহায্যের। রাত দুইটার পর থেকে একে একে হাসপাতালের দিকে ছুটতে থাকেন চিকিৎসকরা। শুধু যে চিকিৎসকরা ছুটেছেন, এমন নয়—বিভীষিকাময় এই রাতে এগিয়ে এসেছেন সর্বস্তরের মানুষ। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানুষের সেবায় কাজ করেছেন নারী-পুরুষ একসঙ্গে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুনে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিস্ফোরণের পর পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। হতাহতদের চাপ সামলাতে হিমশিম খেয়েছে প্রশাসন। রাত ১টার পর থেকে একে একে অগ্নিদ্গ্ধ রোগীরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে আসতে থাকেন। আহতদের চিকিৎসা দিতে বেগ পেতে হয়েছে প্রশাসনকে।
এতো রোগী হাসপাতালে আসবে, এর কোনো প্রস্তুতি ছিল না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। আর গভীর রাতে দেখা দেয় রক্তের সংকট। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ খবর ছড়িয়ে পড়তে রক্ত দিতে আগ্রহীরা ভিড় করতে থাকেন চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে। রক্তের গ্রুপ প্লে-কার্ডে লিখে ডাকলেই তরুণরা সাড়া দিচ্ছিলেন।
শুধু যে রক্ত দিয়ে সহায়তা করছিলেন, এমন নয়। আহত রোগীর জন্য কাপড়চোপড়, খাবার, পানি, ওষুধপত্র, হাতপাখা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এছাড়া প্রয়োজন অনুসারে অনেকে আর্থিক সহায়তার হাতও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সংগঠনের সদস্যরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে পড়েন মানবিক এই দুর্যোগ মোকাবিলায়। গভীর রাতে শহরের সব ওষুধের দোকান বন্ধ। তখন দেখা দেয় মূল সংকট। অধিক রোগী আসায় প্রয়োজনীয় ওষুধ-সংকটে পড়ে। তখন এগিয়ে আসে মেডিকেলের বিপরীতের হাসান ফার্মেসী নামের একটি দোকান। গভীর রাতে দোকান খুলে বিনামূল্যে ওষুধ দিতে থাকে কর্তৃপক্ষ।
গভীর রাতে রক্তের সংকটের কথা শুনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্টে এসে জড়ো হন। তখন তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। প্রয়োজনের তুলনায় কয়েকগুণ রক্তদাতা হাজির হয়েছিলেন।
চিকিৎসক সংকট দেখা দিলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা এবং ইস্টার্ন চিকিৎসকরা আন্তরিকভাবে সেবা দিয়েছেন।
রেড ক্রিসেন্ট, ব্র্যাক, মহামৃত্যুঞ্জয়ী ফাউন্ডেশন, রেইনবো ফাউন্ডেশন, বিদ্যানন্দ, গাউসিয়া কমিটি, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন, যুবলীগসহ ব্যক্তি পর্যায়েও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
রেইনবো ফাউন্ডেশনের উদ্যোক্তা সোহেল শিকদার বলেন, 'ঘটনার পর থেকে হতাহতের জন্য জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আমরা প্রস্তুত ছিলাম। যাদের সহায়তা প্রয়োজন, তারা আমাদের কাছ থেকে নিয়েছেন। আবার অনেকে সহায়তা নিয়ে আমাদের কাছে এসেছেন। আমরা এক ধরনের সেতু হিসেবে কাজ করেছি।'
এছাড়া নগরীর রাস্তায় থাকা অনেক রিকশা ও অটোরিকশা চালক রক্তদাতাদের হাসপাতালে পৌঁছে দেন বিনা ভাড়ায়। কাজির দেউরি মোড়ে রিকশাচালক মজনু মিয়া বলেন, 'হাসপাতালে শুধু মানুষ আর মানুষ। কয়েকজনের কাছ থেকে ভাড়া নিইনি। আগে মানুষ বাঁচুক, পরে টাকা পাওয়া যাবে।'
গাউসিয়া কমিটির মানবিক সেবা টিমের সদস্য এরশাদ কুতুবী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ঘটনাস্থলে উদ্ধার অভিযান, রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়াসহ বিভিন্ন মানবিক কাজে আমাদের এক হাজারের বেশি স্বেচ্ছাস্বেবী নিয়োজিত রয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, 'এমন দুর্যোগে আমরা সরকারি, বেসরকারি সকল সকল চিকিৎসককে আহ্বান জানিয়েছিলাম সেবা দিতে। তারা দ্রুত সাড়া দিয়েছিলেন। শুধু চিকিৎসক নন, চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ মানবিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন।'
শনিবার (০৪ জুন) রাতে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ৮ কর্মীসহ ৪৯ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে এ পর্যন্ত। এছাড়া দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।