কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড: বিশাল লোকসানের দুশ্চিন্তায় গার্মেন্ট মালিকরা, সরবরাহ চেইন বিপর্যয়ের শঙ্কা
চট্টগ্রামের তৈরি পোশাক কারখানা সেনটেক্স নীটওয়্যার লিমিটেড আমেরিকা ও কানাডায় রপ্তানির জন্য ২৯ হাজার পিস জ্যাকেট পাঠিয়েছিল বিএম কনটেইনার ডিপোতে। সাড়ে ৩ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য চালানটি জাহাজীকরণের জন্য বিএম কনটেইনার ডিপোতে অপেক্ষা করছিল।
৪ জুন রাতে কেমিক্যাল বিস্ফোরণে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় ডিপোতে থাকা কনটেইনার। এত টাকার পণ্যগুলোর ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন সেনটেক্স নীটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থানা পরিচালক একেএম মোহাম্মদ আলমগীর।
শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোটিতে আগুন লাগার ঘটনায় অন্তত ৪৯ জন নিহত ও দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। হতাহতদের মধ্যে আছেন পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীও। রোববার রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি আগুন।
এছাড়া পোশাকসহ বিভিন্ন রপ্তানি পণ্য বহনকারী বিপুলসংখ্যক কন্টেইনার আগুনে পুড়ে গেছে। এতে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন রপ্তানিকারকরা।
গার্মেন্ট মালিকরা ফ্রি অন বোর্ড (এফওবি) ভিত্তিতে পণ্য বিক্রি করেন। এই পদ্ধতিতে রপ্তানি পণ্য ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার এজেন্টের কাছে হস্তান্তর করার পর রপ্তানিকারকের দায়িত্ব শেষ হয়। এর পর পণ্য সরবরাহের খরচ, এবং সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি ক্রেতারা বহন করে।
জাহাজিকরণের আগেই পণ্য ডিপোতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এই পরিস্থিতিতে বিদেশী ক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্যের মুল্য পাওয়া যাবে কি না সেটি নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন গার্মেন্ট মালিকরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার এসোসিয়েশন, বাফা-র সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, 'রপ্তানি পণ্য বীমার আওতায় সুরক্ষিত থাকে। ফলে কোনো ক্ষতি হলে গার্মেন্ট মালিকরা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সরবরাহকারী, বীমা কোম্পানি এবং বিদেশী ক্রেতাকে ক্ষতিপূরণের জন্য আলোচনা করে একটা চুক্তিতে আসতে হবে।'
তিনি আরো বলেন, 'সামনে ঈদ। ঈদকেন্দ্রিক এমনিতেই রপ্তানি কার্গোর চাপ রয়েছে। এই ডিপোর প্রায় প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কনটেইনার ব্যবাহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাপ পড়বে।
'এই ডিপো ঠিক করতে যে পরিমাণ সময় ও অর্থ লাগবে, সেটি অনিশ্চিত। ইতোমধ্যে করোনা ও বিভিন্ন কারণে কনটেইনারের সংকট রয়েছে। এই ঘটনা অবশ্যই আমদানি এবং রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তবে সবচেয়ে বিরূপ প্রভাব পড়বে রপ্তানিতে।'
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ১১০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)।
পোশাক উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, 'চট্টগ্রামের ৮টি শিল্প গ্রুপের ১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে—কেডিএস গ্রুপ, এশিয়ান এপারেলস, ফোর এইচ গ্রুপ, প্যাসিফিক জিন্স, সেনটেক্স নীটওয়্যার, এ্যারো ফেব্রিক্স ও সি ব্লু। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো পুরোপুরি নিরূপণ করা হয়নি।'
চট্টগ্রাম চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সহসভাপতি এবং প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, 'এটি খুবই অপ্রতাশিত দুর্ঘটনা। আমাদের পণ্যগুলো ইউরোপ ও আমেরিকায় যাওয়ার কথা ছিল। তবে আমরা এখনো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে পারিনি। এই দুর্ঘটনা আমাদের রপ্তনির জন্য বড় ধরনের সেটব্যাক। এমনিতেই আমাদের রপ্তানি একটি চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাতে এই ঘটনা আমাদের রপ্তানিকে আরো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করবে।'
তিনি আরো বলেন, গার্মেন্টস কোম্পানিগুলো যেভাবে কমপ্লায়েন্স অনুসরণ করে, ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোগুলোকেও (আইসিডি) সেভাবে কমপ্লায়েন্স অনুসরণ করা উচিত।
ফোর এইচ অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিজিএমইএর পরিচালক মো. হাজান (জ্যাকি) বলেন, 'আমাদের রপ্তানি কনটেইনার ইউরোপ এবং আমেরিকায় উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডিপোতে রাখা হয়। যেখানে বিখ্যাত ব্র্যান্ড এইচএন্ডএম-এর পণ্য ছিলে। আমাদের কী পরিমাণ পণ্য পুড়ে গেছে, আদৌ এই পণ্য চালানে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা অনিশ্চিত। এই ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে উঠবে, তা নিয়ে আমরা চিন্তিত।'
বিকডার মহাসচিব রুহুল আমিন শিকদার বলেন, শনিবার রাতের আগুনে রপ্তানি পণ্য বোঝাই ৮০০ টিইইউ (টুয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট) কনটেইনার—মূলত আরএমজি পণ্য ও হিমায়িত খাবার—প্রায় ৫০০টি আমদানি করা পণ্য বোঝাই কনটেইনার এবং ৩ হাজার খালি কনটেইনার পুড়ে গেছে বলে জানা গেছে।
এশিয়ান এপারেলস লিমিটেডের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিফ আহমেদ সালাম বলেন, 'আমাদের ১ দশমিক ৬ মিলয়ন ডলারের পণ্য শনিবার ৭টি গাড়িতে করে বিএম কনটেইনার ডিপোতে পৌঁছায়, যেগুলো আমেরিকা যাওয়ার কথা ছিল। এখন এসব পণ্যের বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না।'
তিনি বলেন, 'গত ৩০ জুনও কিছু পণ্য ডিপোতে পাঠানো হয়। সেগুলো সম্পর্কেও কোনো তথ্য পাচ্ছি না। এসব পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে না পারলে আমরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হব। যদি ক্রেতা আবার এই পণ্য তৈরি করে দিতে বলে, এসব পণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহে বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।'
বাংলাদেশে ১৯টি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) বা অফ-ডক রয়েছে। এগুলো প্রায় শতভাগ রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডেল করে। এছাড়া চাল, গম, সরিষা, ছোলা, ডালের মতো খাদ্যপণ্যসহ ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্যও ডেলিভারির জন্য নিয়ে আসা হয় এসব ডিপোতে। এসব ডিপোর কনটেইনার ধারণ সক্ষমতা প্রায় ৭৭ হাজার টিইইউ'স কনটেইনার।
বাংলাদেশে ১৯টি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) রয়েছে। এগুলো প্রায় শতভাগ রপ্তানি পণ্য ব্যবস্থাপনা করে। এছাড়া ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্য—যেমন চাল, গম, সরিষা, ছোলা, ডালসহ আরও বেশকিছু পণ্য ডেলিভারির জন্য নিয়ে আসা হয় এসব ডিপোতে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বন্দর এলাকার বাইরে থেকেই পণ্য খালাস ও ডেলিভারির মাধ্যমে এই ডিপোগুলো মূলত চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করে।
এসব ডিপোর ধারণক্ষমতা ৭৬ হাজার ২৫৫ হাজার টিইইউ কনটেইনার। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের ধারণক্ষমতা ৪৯ হাজার ১৮ টিইইউ কনটেইনার।