ঈদ উপলক্ষে এপ্রিলে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ মোবাইল লেনদেন
নতুন নতুন সেবার বিস্তার ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আত্মীয় স্বজনদের ঈদের কেনাকাটায় অতিরিক্ত টাকা পাঠানোর কারণে এপ্রিল মাসে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে (এমএফএস) এযাবৎকালের সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের এপ্রিলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের ৯৩,০৩২ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। যা গত মার্চ মাসের তুলনায় বেড়েছে ১৫,৭৩০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে এখানে ডাক বিভাগের সেবা 'নগদ'-এর তথ্য যুক্ত হয়নি। কারণ, সেবাটি এখনও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্সপ্রাপ্ত নয়। ডাক বিভাগের ২৫,০০০ কোটি টাকা যোগ হলে মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১২০ কোটি টাকার বেশি।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহর কিংবা গ্রাম, মুহূর্তের মধ্যে দেশের যেকোনো স্থানে টাকা পাঠানোর সুবিধার কারণে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। দিনদিন গ্রাহক সংখ্যা যেমন বাড়ছে, লেনদেনের পরিমাণও বাড়ছে। শ্রমিকদের বেতন-বোনাস, সরকারের সামাজিক সুরক্ষার বিভিন্ন ভাতা ও অনুদান যাচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। বিভিন্ন পরিষেবা যেমন- কেনাকাটার বিল, বেতন কিংবা টিউশন ফি পরিশোধ, মোবাইল ফোনের রিচার্জ সবই সম্ভব এমএফএস সেবার মাধ্যমে।
হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা ৬৩ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা লেনদেন করেন। চলতি বছরের এপ্রিলে লেনদেন বেড়েছে ২৯,৫৯১ কোটি টাকা, যা শতাংশ হিসেবে ৪৬.৬৪%।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে বিকাশ, রকেট, ইউক্যাশ, মাই ক্যাশ, শিওর ক্যাশসহ বিভিন্ন নামে ১৩টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। ২০২২ সালের মার্চ শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ১১ কোটি ৮৯ লাখ এর বেশি। এর মধ্যে শহরে গ্রাহক আছে ৫ কোটি ৩৫ লাখ; এছাড়া গ্রামে রয়েছে ৫ কোটি ৭৩ লাখ। এছাড়া নিবন্ধিতদের মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি ৪১ লাখ এবং নরী গ্রাহক ৪ কোটি ৬৩ লাখ।
এপ্রিলে মোট ৩৭ কোটির ওপর লেনদেনের মাধ্যমে লেনদন হয়েছে। আলোচিত মাসজুড়ে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবগুলোতে টাকা জমা পড়েছে (ক্যাশ ইন) ২৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। এ সময়ে তোলা হয়েছে (ক্যাশ আউট) ২৫ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে নগদের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে নগদের সেবা দিনদিন জনপ্রিয় হচ্ছে। গত মার্চে ২২ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে, এপ্রিলে এসে লেনদেন হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।
তিনি আরও বলেন, এপ্রিলে প্রায় প্রতিদিন গড়ে হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি লেনদেন হয়েছে কারণ এ মাস রোজার ঈদের পূর্বে ছিল। এছাড়া ডিজিটাল কেনাকাটায় গ্রাহকদের বিভিন্ন অফার দেয়া হয়েছে যার কারণে লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে।
বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, 'এপ্রিলে গত সকল সময়ের চেয়ে কেনাকাটা বেশি হয়েছে এর অন্যতম কারণ হলো রমজানের ঈদ। ঈদকে সামনে রেখে সবাই আত্মীয়-স্বজনের কাছে টাকা পাঠিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরণের কেনাকাটায় এমএফএস এর মাধ্যমে পেমেন্ট করেছে তাই লেনদেন বেড়েছে।'
তিনি আরও বলেন, কোভিড পরবর্তী দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি সচল থাকায় এখন লেনদেনের পরিমাণ বাড়ছে এছাড়া এ সেবার পরিধি আরও বিস্তৃত হচ্ছে। এ খাতে নিয়মিত উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, সৃজনশীল ও সময়োপযোগী নানা সেবা সংযোজন হচ্ছে। সাধারণের লেনদেন আরও সহজ, নিরাপদ, সময় ও খরচ সাশ্রয়ী হচ্ছে।
'সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশেষ করে সরকারি সব ধরনের ভাতা, উপবৃত্তি ও প্রণোদনা বিতরণে মোবাইল আর্থিক সেবা খাত ব্যবহারের সিদ্ধান্ত এ খাতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আরও বাড়িয়েছে।'
'সমাজের সব স্তরের গ্রাহকের মাঝে এমএফএস লেনদেনের অভ্যস্ততা তৈরি হচ্ছে এবং নির্ভরতাও বাড়ছে। গ্রাহকদের স্বতঃস্ফূর্ত এমএফএস ব্যবহার এবং করোনা-পরবর্তীতে সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরায় এপ্রিলে সর্বোচ্চ লেনদেনের পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে। মে মাসে এটি কিছুটা কম আসবে কারণ এ মাসের দুই তারিখে ঈদ হয়েছে, ফলে তার পরবর্তিতে কিছুটা লেনদেন কমেছে। তবে এখন যেভাবে মানুষ মোবাইল ব্যাংকিং ঝুঁকছে এ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে।'
এপ্রিলে এমএফএস মাধ্যমে ব্যক্তি হিসাব থেকে ব্যক্তি হিসাবে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে ২৬ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা বিতরণ হয়েছে দুই হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। বিভিন্ন সেবার বিল পরিশোধ করা হয়েছে ২,৬৬৮ কোটি টাকা।
সম্প্রতি মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের পরিমাণ বাড়াতে এর সীমা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে এমএফএস মাধ্যমে গ্রাহকরা দিনে এজেন্ট থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং ব্যাংক হিসাব বা কার্ড থেকে ৫০ হাজার টাকা জমা করতে পারবেন। আগে দৈনিক ৩০ হাজার টাকার বেশি জমা করা যেত না। কার্ড থেকে টাকা জমার সীমাও নির্দিষ্ট ছিল না। এখন একজন গ্রাহক আরেকজনকে মাসে দুই লাখ টাকা পাঠাতে পারবেন। আগে এ সীমা ছিল ৭৫ হাজার টাকা।
২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর মধ্য দিয়ে দেশে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসের যাত্রা শুরু হয়। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে বিকাশ। বর্তমানে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার সিংহভাগই বিকাশের দখলে। এরপর 'নগদ'-এর অবস্থান।