দেশে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ধারণার দ্বিগুণ!
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেশের ২.৪ শতাংশ মানুষ শারীরিক, মানসিক বা যে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার। এ হিসাবে দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ৪৭.৪২ লাখ যা, সমাজ সেবা অধিদপ্তরের জরিপে উঠে আসা সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ।
বুধবার পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত ন্যাশনাল সার্ভে অন পারসনস উইথ ডিজ্যাবিলিটিস (এনএসপিডি) ২০২১ এর জরিপে বলা হয়েছে, দেশের পুরুষদের ৩.২৯ শতাংশ এবং নারীদের ২.৩৪ শতাংশ কোনো না কোনভাবে প্রতিবন্ধী। এদের মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধীর সংখ্যাই বেশি।
জরিপের তথ্যে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে প্রতিবন্ধীরা আশঙ্কাজনক হারে পিছিয়ে আছে। জাতীয় পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় শতভাগ এনরোলমেন্ট হলেও প্রতিবন্ধী শিশুদের মাত্র ৪০.৫৫ শতাংশ স্কুলে যেতে পারছে। সারা দেশে বেকারত্বের হার মাত্র ৫ শতাংশের মধ্যে হলেও প্রতিবন্ধীদের মাত্র ২৭.২১ শতাংশ কোনো না কোনো অর্থনৈতিক কাজে যোগ দিতে পেরেছেন।
শিক্ষার সুযোগ বাড়িয়ে প্রতিবন্ধী লোকদের জনশক্তিতে রূপান্তর করে তাদেরকে অর্থনীতির মূল ধারায় নিয়ে আসার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি ও চিকিৎসার সুযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা।
৩৬ হাজার পরিবারে জরিপ চালিয়ে বিবিএস জানিয়েছে, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে গ্রামীণ এলাকার ২.৯২ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলের ২.৪৫ শতাংশের অন্তত একটি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
শতভাগ প্রতিবন্ধী মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনতে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। চলতি অর্থবছর ২০ লাখ ৮০ হাজার প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য জনপ্রতি ৭৫০ টাকা ভাতার বরাদ্দ রয়েছে। আগামী অর্থবছরে সুবিধাভোগীর সংখ্যা ২৩ লাখ ৬৫ হাজারে উন্নীত করে জনপ্রতি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৮৫০ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৬.৫০ শতাংশ এ পর্যন্ত যেকোনো ধরনের ভাতা বা সহায়তা পেয়েছেন। এই জরিপের আগের ছয় মাসে এই হার ৪২.৫০ শতাংশ।
তাদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ প্রতিবন্ধী ভাতা পেয়েছেন। জরিপের আগের ছয় মাসে এই ভাতা পেয়েছেন ৩০.৭ শতাংশ।
জরিপে আরো দেখা যায়, ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে ২৭.২১ শতাংশের কর্মসংস্থান হয়েছে। পুরুষদের মধ্যে এই হার ৪০.৩৯ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ৭.৩ শতাংশ। কর্মসংস্থানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শতাংশ শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেশি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ডা. ফাহমিদা খাতুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ডিজেবল মানুষকে লেবার মার্কেটে আনতে চাইলে সবার মত স্কিল ডেভলপ করতে হবে।
সীমাবদ্ধতাকে ট্রেনিং ও প্রাকটিসের মাধ্যমে জয় করতে তাদের প্রস্তুত করতে হবে। তাদের স্কুলে পড়ার হার কম হলেও প্রপার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তাদের অনেক কাজে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।"
"১০০ টাকা বাড়িয়ে এখন প্রতিবন্ধি ভাতা সাড়ে ৮৫০ করা হলেও সেটি কিন্তু অনেক কম। তাই তাদের কাজে সম্পৃক্ত করা জরুরি। এজন্য উদ্যোক্তাদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। ডিজেবল মানুষের স্কিল করা ও সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে সরকারকে কাজ করতে হবে," যোগ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনমিক্সের অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আবদুল হামিদ টিবিএসকে বলেছেন, "ডিজিএবল মানুষদের মধ্যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, মানসিক প্রতিবন্ধী বা যারা কাজ করতে একেবারে অক্ষম তাদের সরকারের ভাতার আওতায় আনতে হবে। তবে অন্য প্রতিবন্ধী যারা আছে তাদের ট্রেনিং দিয়ে ইনকাম জেনারেট এক্টিভিটির মধ্যে আনতে হবে। এছাড়া দেশের সব মানুষকে ইনসুরেন্সের আওতায় আনতে হবে, যাতে কেউ দুর্ঘটনার কারণে ডিজেবল হলে ইনসুরেন্স কাভারেজের আওতায় থাকতে পারে।"
জরিপে দেখা যায়, প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে ৪০.৫৫ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা এবং ২৪.৩৬ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। অন্যান্য বিভাগের তুলনায় সিলেট বিভাগে এই পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক, কারণ সিলেটের ৬৫.৩৯ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ করছে।
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বিভাগ এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে রয়েছে। এই বিভাগে ২৯.২৭ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবন্ধিদের মধ্যে সবাই জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী নয়। অনেকেই সড়ক দুর্ঘটনা বা ইনজুরির কারণে প্রতিবন্ধী।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন (নিটোর) এর পরিচালক অধ্যাপক ড. আবদুল গণি মোল্লা টিবিএসকে বলেছেন, "সড়ক দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়ার অনেকেরই হাত, পা কাঁটতে হয়, তারা তখন প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। আমাদের অর্থোপেডিক ডিপার্টমেন্টে ভর্তি রোগীদের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ থাকে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী।"
"দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে ১৮-৪৫ বছর বয়সী পুরুষের সংখ্যা বেশি। এই বয়সের পুরুষেরাই কর্মক্ষম। তাদের মধ্যে অনেকেই ডিজেবল হয়ে যায়। ডিজেবিলিটি পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝা, তাই প্রতিবন্ধীতা কমাতে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে," বলেন তিনি।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে, ১৮.৪৭ শতাংশ তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়ক ডিভাইস ব্যবহার করে। জরিপে আরো দেখা যায়, মাত্র ৯.৭১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রয়োজন অনুসারে বাড়িতে বিশেষ ধরনের স্যানিটেশন সুবিধা রয়েছে।
শহুরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা গ্রামীণ প্রতিবন্ধীদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি স্বাস্থ্যসেবা পান বলেও দেখা যায়।
এর আগে ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত সমাজসেবা অধিদপ্তরের চলমান 'প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ' এর ফলাফলে বলা হয়, গত বছরের ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ছিলো ২৪ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৩ জন।