এক জাপানির গলফ ক্লাবের টানেই যেভাবে দেশে শুরু হলো লেন্সের উৎপাদন
স্ক্যানার মেশিনের জন্য বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ইপসন। এই মেশিনের ব্যবহৃত লেন্স তৈরি হয় চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি কারখানায়। শুধু উৎপাদন হয়, এমন নয়। এশিয়া অঞ্চলের সরবরাহকৃত ইপসন ব্র্যান্ডের শতভাগ স্ক্যানারের লেন্স তৈরি হয় এখানে।
তিন দশক ধরেই চট্টগ্রামের জাপানি বিনিয়োগকৃত সানকো অপটিকাল কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড বিভিন্ন ধরণের লেন্স উৎপাদন করে আসছে।
শুরুতে ফটোকপিয়ার ও অ্যানালগ ক্যামেরার লেন্স তৈরি করতো প্রতিষ্ঠানটি। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতিতে লেন্সের ব্যবহার বাড়তে থাকে।
ইপসন ছাড়াও ফুজিফিল্মের সিসিটিভি ক্যামেরার লেন্স, রিকোর ফটোকপিয়ার লেন্স, কেনকোর স্পটস্কোপ লেন্স, অলিম্পাসের মেডিকেলসংক্রান্ত বিভিন্ন যন্ত্রপাতির লেন্স, টপকনের সার্ভিলেন্স লেন্স, ভিটিএস টেকনোলজির ফ্যাক্টরির মেশিনারিজে ব্যবহৃত লেন্সও তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি। বছরে ১০ লাখ লেন্স রপ্তানিও করছে প্রতিষ্ঠানটি। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, চীনে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব লেন্স। যদিও বছরে ১৫ লাখ লেন্স উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
গলফ ক্লাবের টানে লেন্স কারখানা
১৯৯০ সালের দিকে জাপানে শ্রমের মূল্য বেড়ে যায়। শ্রমিক সংকটও দেয়া হয়। তখন কনিকা ক্যামেরার লেন্স তৈরি করতো জাপানি নাগরিক কেনচি অ্যাবেসাওয়ার প্রতিষ্ঠান সানকো কোম্পানি লিমিটেড। শ্রমের মূল্যের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় থাকতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। প্রতিষ্ঠানটির হেড অফিসে কয়েকজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পার্টটাইম চাকরি করতেন। কাজের প্রতি তাদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ ছিলেন কেনচি। তখন তিনি বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করলেন।
কনিকার একজন প্রতিনিধিসহ কেনচি চট্টগ্রামে আসলেন ইপিজেড পরিদর্শনের জন্য। তিনি গলফ খেলতে অনেক পছন্দ করতেন। তাই এখানে এসে তিনি প্রথমে খুঁজতে থাকেন গলফ ক্লাব আছে কিনা। সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি গলফ ক্লাবে খেলতে খেলতে এখানেই কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করলেন।
১৯৯০ সালে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটির (বেপজা) রেজিস্ট্রেশন নেয় সানকো অপটিকাল বাংলাদেশে লিমিটেড। তখন পাঁচজন প্রকৌশলীকে জাপানে নিয়ে প্রায় ১৪ মাস হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ১৯৯২ সালের জুন মাসে ইপিজেডের একটি ভবন ভাড়া নিয়ে উৎপাদন শুরু করে। এরপর আস্তে আস্তে উৎপাদনের পরিধি বাড়াতে থাকে কারখানাটি। শুরুতে মাত্র পাঁচ প্রকৌশলী এবং ১৪ জন শ্রমিক ছিল। বর্তমানে ৭ প্রকৌশলীসহ প্রায় ৯০০ শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন কারখানাটিতে। পরে ১৯৯৫ সালে ইপিজেডের ৩টি প্লট বরাদ্দ নিয়ে বড় পরিসরে কারখানা স্থাপন করা হয়।
উৎপাদন শুরুর প্রথম মাসে ৫ হাজার লেন্স রপ্তানি করেছিল সানকো অপটিকাল বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। অ্যানালগ ক্যামেরার চল উঠে যাওয়ায় কিছুটা বিপাকে পড়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে প্রযুক্তির স্রোতে লেন্সের বহুমাত্রিক ব্যবহারের দিকে নজর রেখেছিল সানকো। ২০০০ সালের পর থেকে ক্যামেরার লেন্সের চাহিদা কমলেও মেডিকেলের যন্ত্রপাতি, সিসিটিভি, অটোমেশন যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতির চাহিদা বাড়তে থাকে। এসবের প্রত্যেকটিকে লেন্সের ব্যবহার রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার মোস্তফা জামাল মানিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অটোমেটেড সব ধরণের মেশিনেই এখন লেন্সের ব্যবহার হয়। ২০০৪-০৫ সালের দিকে অন্যান্য মেশিনের লেন্স উৎপাদনের দিকে নজর দিতে থাকি আমরা। ফটোকপি মেশিন, স্ক্যানার, সিসিটিভি, কারখানার অটোমেটেড মেশিন, ফ্যাক্স মেশিন, কনভার্টার, মেডিকেল ইনস্ট্রুমেন্ট, প্রজেক্টর, রাইফেলের জন্যও লেন্স উৎপাদন করে থাকি।"
বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটির (বেপজা) তথ্যমতে, সানকো অপটিকাল কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড ৪০ দশমিক ৭৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১১১ দশমিক ৫৩৩ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৫ সালে ৭ দশমিক ৩৩১ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে। এরপর অ্যানালগ ক্যামেরার চাহিদা কমার প্রভাব পড়ে প্রতিষ্ঠানটিতে। ২০১০ সালে রপ্তানি আয় নেমে আসে ৪ দশমিক ৯১৮ মিলিয়ন ডলারে। এরপর মহামারির বছর ছাড়া রপ্তানি আয় বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে ৫ দশমিক ৫৮৯ মিলিয়ন ডলার, ২০১৯ সালে ৫ দশমিক ৬৪০ মিলিয়ন ডলার, ২০২০ সালে ৪ দশমিক ৮৩৯ মিলিয়ন ডলার আয় হয়। ২০২১ সালে আবার তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৫৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় আসে ৪৪ দশমিক ৭৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৫ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৭ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৯ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন ডলার এবং চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে ২৭ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়।
মোস্তফা জামাল মানিক জানান, প্রতিষ্ঠানটি তাদের কাঁচামাল মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, চীন ও জাপান থেকে আমদানি করে থাকে। তিনি বলেন, "সব ধরণের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সে অনুসারে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। কারণ আমাদের চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। আমাদের এখানে শুধু লেন্স তৈরি করা হয়। এগুলো ফিটিং এবং অ্যাসেম্বেল করে অন্যান্য কোম্পানি। দশমিক ৫ ডলার থেকে শুরু করে ২ ডলার মূল্যের লেন্স আমরা রপ্তানি করে থাকি।"
সানকো ছাড়াও চট্টগ্রাম ইপিজেডের জাপানি প্রতিষ্ঠান সিবিসি অপট্রনিকস বাংলাদেশ লিমিটেড এবং ঢাকা ইপিজেডে অবস্থিত তাইওয়ানি প্রতিষ্ঠান ইয়াং অপটিকস বাংলাদেশ লিমিটেড রপ্তানিমুখী এই পণ্যটি উৎপাদন করছে। সিবিসি অপট্রনিকস মূলত সানকো থেকে লেন্স নিয়ে অ্যাসেম্বেলের পর তা রপ্তানি করে। আর ইয়াং অপটিকসও সিবিসি থেকে লেন্স নিয়ে অ্যাসেম্বেলের পর আবার রপ্তানি করে। প্রতিষ্ঠান দুটি মূলত সিসিটিভি ক্যামেরা এবং প্রজেক্টরের লেন্স উৎপাদন করে আসছে।