'বিশ্বে প্রথম' মানবদেহে শূকরের হৃদপিণ্ড বসিয়েছিলেন ভারতের ধনীরাম!
সম্প্রতি এক মার্কিন নাগরিকের শরীরে শূকরের হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনের খবর এসেছে বিশ্ব মিডিয়ায়। দাবি করা হয়েছে, মানবদেহে শূকরের হৃদযন্ত্র বসানোর ঘটনা এটিই বিশ্বে প্রথম। তবে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকায় উঠে এসেছে ভিন্ন এক তথ্য।
পত্রিকাটি বলছে, বাল্টিমোরের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড স্কুল অফ মেডিসিনের সার্জন বার্টলে গ্রিফিথ'র অন্তত ২৫ বছর আগেই আসাম রাজ্যের গুয়াহাটির চিকিৎসক ধনীরাম বরুয়া মানবদেহে শূকরের হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার করেছিলেন। গ্লাসগো থেকে এফআরসিএস করা ধনীরাম যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই এ কাজ করায় ৪০ দিন জেলও খেটেছিলেন সে সময়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটির দাবি, পশুর হৃদপিণ্ড মানবদেহে প্রতিস্থাপনের মতো জটিল একটি কাজের জন্য মার্কিন চিকিৎসক বার্টলে গ্রিফিথ বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়ালেও, ১৯৯৭ সালে ধনীরামের তত্ত্বাবধানে অস্ত্রোপচারের সেই ঘটনা কেউ মনে রাখেনি। যেটি কিনা সত্যিই 'ইতিহাসে প্রথমবারের' মতো শূকরের হৃৎপিণ্ড মানবদেহে প্রতিস্থাপনের ঘটনা ছিল।
তবে যুক্তরাষ্ট্রে হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন ক্ষেত্রে সে দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ অনুমতি নেওয়াসহ দাতা শূকরের জিনকে মডিফাই করা হয়েছিল, যেন মানবদেহ তা প্রত্যাখ্যান না করে বা বিপরীত প্রক্রিয়া না হয়। কিন্তু ২৫ বছর আগে ধনীরাম এসব নিয়মের কোনোটিই মানেননি; পুরো অপারেশনটাই করেছিলেন গোপনে।
আনদবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে, ইংল্যান্ডের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস-এর সাবেক শিক্ষার্থী ধনীরাম গবেষণা করছিলেন কৃত্রিম হৃদযন্ত্র ও মানবদেহের অন্যান্য অঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়ে। ১৯৯৬ সালের দিকে তিনি ৩২ বছর বয়সী পূর্ণ শইকিয়া নামে এক ব্যাক্তির খোঁজ পান, যিনি ছিলেন ভ্যান্টিলেশনে; অর্থাৎ নিশ্চিত মৃত্যুর পথযাত্রী। শইকিয়ার পরিবারের অনুমতি নিয়েই ধনীরাম অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। হংকংয়ের হৃদযন্ত্র বিশেষজ্ঞ ও শল্য চিকিৎসক জোনাথান হো কেও তিনি ওই অস্ত্রোপচারে অংশ নিতে অনুরোধ জানান; রাজি হন জোনাথান।
১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি দীর্ঘ ১৫ ঘণ্টা গোপন অস্ত্রোপচারে শূকরের হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের অংশবিশেষ বসানো হয় পূর্ণ শইকিয়ার দেহে। কিন্তু শূকরের অঙ্গ প্রত্যাখ্যান করে শইকিয়ার শরীর। তার দেহে দেখা দেয়, 'হাইপার অ্যাকিউট রিজেকশন'। সাত দিনের মাথায় মৃত্যু হয় তার।
এ ঘটনা জানাজানি হলে একই মাসের ১০ তারিখ ধনীরাম ও জোনাথনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৪০ দিন জেল খেটে মুক্তি পান ধনীরাম। তবে ততদিনে তার হার্ট ইনস্টিটিউট ও রিসার্চ সেন্টার কে বা কারা পুড়িয়ে দিয়েছে। সেইসঙ্গে, পুরো এলাকায় তাকে 'উন্মাদ' বলেও প্রচার করা হয়েছে।
এরপরই আড়ালে চলে যান ধনীরাম। তবে, সোনাপুরে আবারও গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তুলেন তিনি। ২০০৯ সালে তার গবেষণাকেন্দ্রের পাশে একই পরিবারের দু'জনের কাটা মাথা পাওয়া যায়। এ ঘটনায় আবারও তাকে 'পাগল চিকিৎসক' বলে আখ্যা দিয়ে তার গবেষণাগারে হামলা চালায় গ্রামবাসী। গ্রামবাসীর ধারণা, নিষিদ্ধ কোনো গবেষণার স্বার্থে মানবদেহের অঙ্গ সংগ্রহেই এ কাজ করিয়েছেন ধনীরাম।
পরবর্তীতে, ২০১১ সালে তিনি এইডসের ওষুধ আবিষ্কারের দাবি করলেও, তার বিতর্কিত অতীতের জের ধরে সেই দাবি আমলে নেয়নি কেউ। ২০১৬ সালে স্ট্রকের পর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের কারণে এখন কথা বলতে পারেন না ধনীরম; বাকশক্তি লোপ পেয়েছে তার।
তবে, বিশ্বে সফলভাবে মানবদেহে শূকরের হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের খবরে ধনীরাম খুশি হয়েছেন বলে জানায় ভারতীয় গণমাধ্যমটি।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে মানবদেহে ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর অঙ্গ প্রতিস্থাপন নতুন কোনো ঘটনা নয়। গবেষণার স্বার্থে বিভিন্ন সময়ে কখনও বৈধ, আবার কখনও অবৈধ পন্থায় গোপনে মানবদেহে এ ধরনের অস্ত্রোপচার চালিয়েছেন গবেষকরা।
১৯২০-এর দশকে মার্কিন চিকিৎসক জন ব্রিঙ্কলির কথাই বলা যেতে পারে, যিনি মানুষের শরীরে ছাগলের অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপন করেছিলেন। এমনকি এক নারীর দেহে ছাগলের ডিম্বাশয়ও প্রতিস্থাপন করেছিলেন তিনি। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা সবাই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেও কিছু দিনের মধ্যেই নানান ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয় তাদের মধ্যে। কেউ কেউ ভয়ঙ্কর সংক্রমণে আক্রান্ত হন, আবার মারাও গিয়েছিলেন অনেকে।
শেষ পরিণতি খুব সুখের ছিলনা এই মার্কিন চিকিৎসকেরও। বিভিন্ন স্থানে তিনি এ ধরনের বিতর্কিত চিকিৎসা দিতে গিয়ে মোটামুটি সব জায়গায়ই ধরা খেয়েছেন। প্রতিবার ভুল চিকিৎসা খেসারত হিসেবে তার লাইসেন্স বাতিলসহ মোটা অংকের জরিমানা গুণতে হয়েছে। জনপ্রিয়তার শিখরে উঠে আবার মাটিতে পড়ে যাওয়ার এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে পরপর তিনবার স্ট্রোক করেন তিনি। ১৯৪২ সালে তার মৃত্যু হয়।