আলুর বাড়তি উৎপাদনই এখন গলার কাঁটা!
- কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে ১৮ টাকার আলু বিক্রি হচ্ছে ৮-৯ টাকায়
- আলুর উৎপাদন ২০২১ সালে ১ কোটি ১০ লাখ টন, যেখানে ২০২০ এ ছিল ৯০ লাখ টন
- ২০২০ সালে ত্রাণে বাড়তি আলু ব্যবহার হলেও এবার সে পরিস্থিতি নেই, বরং উৎপাদন বেড়েছে
- সারা বছর আলুর চাহিদা ৮৫-৯০ লাখ টন
- চাহিদার তুলনায় আলুর ব্যবহার কম হওয়ায় ২০ লাখ টন আলু নষ্ট হওয়ার শঙ্কা, যা কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ের বর্তমান দামেও প্রায় ২০০০ কোটি টাকা
- রেশনিং কার্যক্রম, ওএমএস ও ত্রাণে আলু বিতরণের দাবি
- আলুতে ভর্তুকি ও কোল্ড স্টোরেজের ঋণ পুনঃতফসিলের দাবি করছে এসোসিয়েশন
ঠিক এক বছর আগে সরবরাহ কম থাকায় এক কেজি আলুর দাম বেড়ে ৫০ টাকায় পৌছে, এবার একই সময়ে সরবরাহ বেশি থাকায় খুচরা বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। বাড়তি উৎপাদন ও চাহিদা কমে যাওয়ায় কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে আলু বিক্রি করে খরচের অর্ধেক দামও উঠছে না। বাড়তি উৎপাদনই এখন ব্যবসায়ীদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শনিবার বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ এসোসিয়েশন আয়োজিত 'আলুর বর্তমান পরিস্থিতি এবং হিমাগার শিল্পের সমস্যাবলী' শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি করা হয়। এ সময় লিখিত বক্তব্য প্রদান করেন এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মো. মোশারফ হোসেন।
এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে এসোসিয়েশনের ত্রাণ ও রেশনিং কার্যক্রমে আলুর ব্যবহার নিশ্চিত ও আলুতে ভর্তুকি দাবি করেছে। কাবিখা, ভিজিএফ, ভিজিডি এবং ওএমএসের পাশাপাশি জাতীয়ভাবে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, ভিডিপি, এতিমখানা, জেলখানা সহ বিভিন্ন স্থানে আলু বিতরণের দাবি করেছে এসোসিয়েশন। একই সঙ্গে রপ্তানিতে নগদ সহায়তা বৃদ্ধি ও কোল্ড স্টোরেজের মালিকদের ঋণ পুনঃতফসিলের দাবিও করা হয়।
কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন দাবি করছে, ২০২০ সালে আলুর উৎপাদন হয়েছিল ৯০ লাখ টন। যেখানে ২০২১ সালে আলুর উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ১০ লাখ টন। দেশে আলুর চাহিদা রয়েছে ৮৫-৯০ লাখ টন।
সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, গত বছর করোনার মধ্যে বিভিন্ন ত্রাণকার্যে প্রচুর পরিমাণ আলু বিতরণ করা হয়। যে কারণে সরবরাহ লাইনে আলুর সংকট তৈরি হয় এবং দাম বাড়তে বাড়তে ৫০-৫৫ টাকায় পৌছে। এ সময় সরকার দুই দফায় আলুর দাম নির্ধারণ করে দেয় এবং টিসিবির মাধ্যমেও কম দামে আলু বিক্রি করে। অন্যদিকে অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে উৎপাদন কম হয়েছিল।
কিন্তু এ বছরের চিত্র পুরোটাই আলাদা। দুর্যোগ না থাকায় এবং গতবছরের আলুর দামের কারণে আলুর চাষ বেশি হয় এবং উৎপাদনও বেড়ে যায়। বছরের শুরুর দিকে লকডাউন হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ ছিল। যে কারণে স্বাভাবিক চাহিদার সমপরিমাণও ব্যবহার হয়নি। ফলে স্টোরেজে বাড়তি আলুর মজুদ তৈরি হয়েছে।
কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন বলছে, উদ্বৃত্ত আলুর পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে এবং কোল্ড স্টোরেজগুলোতে প্রায় ৪০ লাখ টন আলু সংরক্ষিত আছে। যা নভেম্বরের পর আর কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা যাবে না। স্টোরেজগুলোতে নতুন আলু বাজারে আসার আগে প্রায় ২০ লাখ টন আলু অবিক্রিত থেকে যাওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। এর প্রভাবে অবশ্য এখনই কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে ১৮ টাকার আলু ৮-৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ২০ লাখ টন আলু অবিক্রিত থাকলে বর্তমান দামেও প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হবে। যার প্রভাব পড়ছে কৃষক, কোল্ড স্টোরেজ মালিক ও পাইকারী ব্যবসায়ীরা।
তিনি বলেন, 'বর্তমানে কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে আলু বিক্রি হচ্ছে ৮-৯ টাকা কেজি দরে। অথচ মাঠপর্যায়ের ক্রয়মূল্য ১১ টাকা, বস্তা ও পরিবহন খরচ দেড় টাকা, ঘাটতি ১ টাকা, সংরক্ষণ ভাড়া ৪ টাকা, ব্যাংকের সুদ প্রতি কেজিতে ৫০ পয়সা মিলে মোট খরচ দাঁড়ায় ১৮ টাকা। এই হিসেবে এক বস্তায় (৭০ কেজি) কমপক্ষে ৫০০ টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে'।
তিনি বলেন, একদিকে কম দামে আলু বিক্রি ও আলু অবিক্রিত থাকার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ৩৭০টি হিমাগারে আলুগুলো সংরক্ষিত রয়েছে। যেগুলো অবিক্রিত থাকলে সবাই বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে এবং তারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না।
জানা গেছে, কোল্ড স্টোরেজে সাধারণত ৬-৯ মাস পর্যন্ত আলু সংরক্ষণ করা যায়। সে হিসেবে গত মৌসুমের আলুগুলো নভেম্বরের পর আর স্টোরেজে রাখা সম্ভব হবে না। নতুন আলু ডিসেম্বরে উঠতে শুরু করলেও মূলত ফেব্রুয়ারী মাস হচ্ছে আলুর ভরা মৌসুম।
কোল্ড স্টোরেজ এসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৫ হাজার মে. টন আলু রপ্তানি হয়েছে। যেখানে চলতি অর্থবছরে এখনো ৩০ হাজার মে. টনের কিছু বেশি আলু রপ্তানি হয়েছে।
অন্যদিকে কী পরিমাণ আলু প্রতি বছর প্রসেসিংয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে তার তথ্য এসোসিয়েশনের কাছে না থাকলেও অন্তত ৩০টি কোম্পানি এই আলু প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে চিপস সহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছে।
মো. মোশারফ হোসেন বলেন, 'আমাদের উৎপাদিত বেশিরভাগ আলুই ইন্ডাস্ট্রির ব্যবহার উপযোগী নয়। যে কারণে বাড়তি উৎপাদন হলেই আমাদেরকে বিপদে পড়তে হয়। এজন্য আমাদের আলুর জাত, কন্টাক্ট ফার্মিং ও প্রসেসিংয়ে গুরুত্ব বাড়াতে হবে।'