আসন্ন বাজেটে বাড়বে বৈদেশিক নির্ভরতা
আগামী বাজেটে আয় ও ব্যয়ের ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। সাধারণত বাজেট ঘাটতির বড় অংশই আসে ব্যাংক খাতসহ অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন উৎস থেকে গৃহীত ঋণের মাধ্যমে। ফলে, নতুন অর্থবছরের বাজেটে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে চলেছে।
মহামারি চলাকালে বিদেশি সাহায্যকারী দেশ ও সংস্থা থেকে ঋণ হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ আসায় সরকার নীতিমালা পরিবর্তনের কথা ভাবছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট সংক্রান্ত খসড়া নথিপত্রের সূত্রানুসারে, বৈদেশিক উৎস থেকে বরাদ্দের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে সরকার।
বর্তমানে ব্যাংক খাতে তারল্যের পরিমাণ বেশি। বাজেটে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নির্ভরতা কমানোর ফলে সহজ শর্তে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে উপকৃত হবেন বেসরকারি খাতের ঋণ গ্রহীতারা। অন্যদিকে, আমানতের সুদ হার কমতে থাকায় ক্ষুদ্র আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
মার্চে ব্যাংক খাতে তারল্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে, ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মার্চ মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি মাত্র ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
মহামারির বছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়। ফলে, সরকারি বন্ড এবং বিলের সুদহারও নেমে আসে।
সরকারের চাহিদা কম থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কয়েক মাস যাবৎ দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি বিলের নিলাম স্থগিত রেখেছে।
মহামারিকালীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিদেশি ঋণ ও অনুদান পাওয়ায় বৈদেশিক তহবিলের পরিমাণ ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৭৬ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা করছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা খসড়া বাজেট অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় এই হার ৬ দশমিক ২ শতাংশ কম।
অর্থাৎ, ৯ শতাংশ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছে সরকার।
নতুন বাজেটে সরকার ব্যাংকিং খাতের ঋণ নির্ভরতা কমিয়ে বিদেশি উৎসের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি করতে চলেছে। অর্থাৎ, চলতি অর্থবছরের পরিকল্পনা থেকে আগামী বাজেটের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বিপরীত হতে চলেছে।
এর আগে সরকার ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনে।
নতুন বাজেটে বৈদেশিক অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৭ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় এই হার ৩৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি।
মহামারিকে কেন্দ্র করে এ বছর বৈদেশিক ঋণ প্রবাহ ইতোমধ্যেই উচ্চ পর্যায়ে থাকায় সরকার বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা আরও বৃদ্ধি করবে বলে খসড়া বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে।
বৈদেশিক তহবিলের প্রবাহ ইতোমধ্যেই ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। মহামারি ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার বিভিন্ন বিদেশি উৎস থেকে অতিরিক্ত সহায়তা পাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়।
বিদেশি অর্থায়নের মাধ্যমে আসন্ন বাজেটে জিডিপির ২ দশমিক ৮ শতাংশ ঘাটতি পূরণ হবে।
নতুন বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ হবে আনুমানিক ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। খসড়া বাজেট অনুযায়ী, সংশোধিত চলতি বাজেটের তুলনায় নতুন অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ হবে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকার ব্যাংকিং খাতের ঋণ থেকে নির্ভরতা কমিয়ে দিলে ব্যাংক খাতে তারল্য বজায় থাকবে।
তিনি আরও বলেন, মহামারির সংকটকালে অনিশ্চয়তায় ব্যাংক খাতে তারল্যের প্রয়োজন আছে। আর তাই সরকার ঋণ কম নিলে তা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে করেন তিনি।
বর্তমানে বেসরকারি খাতের ঋণ চাহিদা কম থাকলেও, ব্যবসায়িক আস্থার পুনরুদ্ধারে তা যেকোনো সময় বাড়তে পারে।
এছাড়া, আমদানি বৃদ্ধি পেলে এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসলে তারল্য খুব দ্রুত কমবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মাহবুবুর রহমান আরও জানান, সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ কম নিলে বেসরকারি ঋণগ্রহীতারা স্বল্পসুদে ঋণ লাভের মাধ্যমে উপকৃত হবে।
বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংক ৭ শতাংশ সুদহারে ঋণ দিচ্ছে। সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ হারের তুলনায় এই হার অনেক কম।
তবে, ক্ষুদ্র আমানতকারী যারা ব্যাংকে আমানত থেকে লোকসান গুনছেন, তারা এই সময়কালে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গতবছর এক অঙ্কের সুদহার নির্ধারণের পরই ব্যাংকগুলো সরকারি ট্রেজারি বিল এবং বন্ডে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে। দীর্ঘমেয়াদি বিল এবং বন্ড থেকে আয় ৯ শতাংশের উপর থাকায় ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার পরিবর্তে ঝুঁকি-মুক্ত বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকে। ব্যাংক খাত থেকে সরকারের গৃহীত অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বৃদ্ধি পায় বিল এবং বন্ডের সুদ হার।
তবে, এ বছর পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে। সরকার ট্রেজারি বিল এবং ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ কমিয়ে দেওয়ায় সুদহারও কমে যায়।
বর্তমানে অনেক ব্যাংক ৫ শতাংশের কাছাকাছি হারে ঋণ প্রদান করছে।
সরকারের চাহিদা কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে দীর্ঘমেয়াদী ট্রেজারি বিল এবং বন্ডের নিলাম স্থগিত রেখেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেটা অনুসারে, গত বছর ৬ শতাংশ সুদহার থেকে এ বছর স্বল্পমেয়াদী ট্রেজারি বিল এবং বন্ডের সুদহার ১ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে।
বেসরকারি খাতে ঋণ চাহিদা নিম্ন পর্যায়ে থাকাকালে নতুন বাজেটে সরকার ব্যাংক খাত থেকে অর্থ উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দেওয়ায় সরকারি বন্ড এবং বিলের সুদহার আরও কমবে বলে মন্তব্য করেন যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও মির্জা ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, সরকারি বন্ড এবং বিলের নিম্ন সুদহারের কারণে ব্যাংকের মুনাফা অর্জন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা, ব্যাংকগুলো তাদের বিধিবদ্ধ তরল স্থিতি বা এসএলআর অংশ থেকে এসব বিনিয়োগ খাতে বিনিয়োগ করে থাকে।
এসএলআর হলো একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ডিপোজিট বা আমানতের ন্যূনতম অংশ যা নগদ রূপে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে সংরক্ষণ করতে হয়।
বর্তমানে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের অবস্থা নেতিবাচক, অর্থাৎ, ব্যাংক থেকে সরকার কোনো ঋণ নিচ্ছে না বরং আগের ঋণ পরিশোধ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সরকারি ঋণ পর্যালোচনা সংক্রান্ত প্রতিবেদনের বক্তব্য অনুযায়ী, "বিশেষত সঞ্চয় পত্রের মতো ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ কমেছে।"
আসন্ন বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৮ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে চলেছে। চলতি অর্থবছরের তুলনায় এই হার ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি।