ঋণ খেলাপিদের জন্য তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক
২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত এক দশক ধরে সরকার চার রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংককে করদাতাদের অর্থ থেকে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার মূলধন সহায়তা প্রদান করে। বিশাল অঙ্কের এই অর্থ থেকে অনায়াসেই 'ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে' কিংবা 'কর্ণফুলী টানেলে'র মতো বৃহৎ প্রকল্পের তহবিল গঠন করা যেত। কিন্তু, দীর্ঘ সহায়তার পরও মূলধন ব্যবস্থার পুনর্গঠনে ব্যর্থ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসব বাণিজ্যিক ব্যাংক।
প্রতিবার ব্যাংকগুলোর ঘাটতি পূরণে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হলেও শেষ পর্যন্ত ফাঁক গলে তা প্রভাবশালী ঋণ খেলাপিদের ঝুলিতে গিয়ে পড়েছে। গুটিকয়েক এই বৃহৎ ঋণ খেলাপিরা জবাবদিহিতার তোয়াক্কা না করেই সম্পদ বৃদ্ধিতে ব্যাংকগুলোকে ব্যবহার করে আসছে।
জনসাধারণের অর্থ কীভাবে ধনী ও প্রভাবশালীরা ইচ্ছামতো ভোগ করতে পারে তার উজ্জ্বল উদাহরণ এখনকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গতিপ্রকৃতি।
২০১৯ সালে সরকার রাজস্ব থেকে চার রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে আর্থিক সহায়তা প্রদান বন্ধ করে দেওয়ার পর ব্যাংকগুলোতে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল ২০১৯ সালের মার্চে সরকারি কোষাগার থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে মূলধন সরবরাহ করা হবে না বলে জানিয়ে দেন। সেসময় সোনালী, জনতা, অগ্রণী এবং রূপালী ব্যাংকে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ এই চারটি ব্যাংকের সার্বিক মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলধন ঘাটতি পূরণের উপায় খুঁজে পেতে এ বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কমিটি গঠন সভায় চার ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা যোগদান করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ব্যাংকগুলোর আশঙ্কাজনক মূলধন ঘাটতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। আলোচনা সভার মূল বক্তব্য অনুসারে, তিনি কমিটিকে মূলধন ব্যবস্থা সংস্কারের পথ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন।
এছাড়া, তিনি ব্যাংকগুলোকে ক্রমান্বয়ে লোকসান থেকে বের হয়ে আসার পাশাপাশি অন্তত ১৫ শতাংশ হারে মুনাফা অর্জনের পরামর্শ প্রদান করেন।
বৈঠকে তিনি আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে ব্যাংকগুলোর গৃহীত কর্ম পরিকল্পনাও পর্যবেক্ষণ করেন।
তবে, অর্থ মন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি। বরং, ব্যাংকগুলোর দুর্দশা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সবথেকে বেশি ঘাটতি জনতা ব্যাংকে
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে কেলেঙ্কারিতে আলোচিত জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সবথেকে বেশি। ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে সৃষ্ট উচ্চ খেলাপি ঋণের ভারে ব্যাংকটি এখন বড় ধরনের লোকসান গুনছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ব্যাংকের নিট লোকসানের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৫৪ কোটি টাকা।
গভর্নরের সাথে বৈঠকে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সালাম আজাদ ব্যাংকের বিপুল লোকসানের জন্য দুই শীর্ষ ঋণ খেলাপি ক্রিসেন্ট এবং এননটেক্সকে দায়ী করেন।
সভার সারাংশ অনুসারে, আবদুস সালামের বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক এই দুই ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের পুনঃতফসিল বাতিল করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠান দুটির খেলাপি ঋণের প্রায় পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা।
মুনাফা দেখাতে ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনের বাধ্যবাধকতায় ছাড় আহ্বান করেছে।
২০১৯ সালে জনতা ব্যাংক ১২ হাজার কোটি টাকা লোকসান করে। কিন্তু, সে বছর ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে দশ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকার ডেফারেল সুবিধা বা প্রভিশন সংরক্ষণে বিশেষ ছাড় নিয়ে ২৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকার নিট মুনাফা প্রদর্শন করে।
তবে, আর্থিক সূচকগুলো নিম্নগামী হলেও ব্যাংকের অবস্থার সংশোধন হচ্ছে বলে দাবি করেন জনতা ব্যাংকের পরিচালক এবং অতিরিক্ত সচিব অজিত কুমার পাল।
পূর্ববর্তী ঘাটতির পরিণামে মূলধন সংকটের দেখা দিয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
ব্যাংকটি কোন আঙ্গিকে উন্নতি করছে সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি নির্দিষ্ট কোনো সূচকের কথা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হন। তবে, মহামারি বিবেচনায় ব্যাংকের কার্যক্রম যথেষ্ট ভালো বলে দাবি করেন তিনি।
ঘাটতি পূরণে সরকারের ১৮ হাজার কোটি টাকার সহায়তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অপর তিন ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক এবং রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল যথাক্রমে তিন হাজার ৬৩ কোটি টাকা, তিন হাজার কোটি টাকা এবং ৬৭১ কোটি টাকা।
তিনটি ব্যাংকের মধ্যে গতবছর কেবলমাত্র সোনালী ব্যাংক ৩৩৮ কোটি টাকার নিট মুনাফা অর্জন করে। অপর দুই ব্যাংক নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতি রেখে মুনাফা প্রদর্শন করে।
২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে মূলধন ঘাটতির জন্য এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। তবে, এর মধ্যে মাত্র ১৫১ কোটি টাকা ব্যবহৃত হয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সরকারকে বিনামূল্যে বিভিন্ন পরিষেবা দিয়ে থাকে। আর তাই, এই ব্যাংকগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান বন্ধ করা উচিত হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি জানান, বিনামূল্যে পরিষেবা দানের জন্য সরকারের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যথাযথ মূল্য প্রদান করা উচিত।
"রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে আর্থিক সহায়তার বিকল্প হিসেবে আমরা গভর্নরের কাছে সার্বভৌম গ্যারান্টি অনুমোদনের প্রস্তাব রেখেছি," বলেন তিনি।
সার্বভৌম গ্যারান্টিকে আমরা কীভাবে মূলধনে রূপান্তর করতে পারি, সে বিষয়ে বর্তমানে কমিটি কাজ করছে।
বড় ধরনের ঘাটতির মুখে থাকায় বিদেশি ব্যাংকগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণপত্র বা লেটার অব ক্রেডিট গ্রহণ করবে না। ফলে, ব্যাংগুলো সংকটে পড়বে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।