টানা লকডাউনে চোখে অন্ধকার পাইকারী পোশাক ব্যবসায়ীদের
পোশাক,জুতা, আসবাবসহ ফ্যাশনে দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি আর্থিক লেনদেন হয় ঈদ-উল-ফিতরে। ঈদের জন্য সারাবছর ধরে প্রস্তুতি নেয় এসব পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে জড়িত কয়েক লাখ উদ্যোক্তা। ব্যাপক প্রস্তুতির পর করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিঃস্ব করেছে এসব উদ্যোক্তাদের।
উৎপাদন ও পাইকারি বিক্রির পিক টাইমে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এবং লকডাউন আরোপ হওয়ায় ঈদের পুরো অর্থনীতিই হারিয়েছেন বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। টানা দুই বছর ব্যবসা হারানোর কারণে উৎপাদন ও বিপণনে জড়িত কয়েক লাখ উদ্যোক্তার পাশাপাশি সারাদেশের কয়েক লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরও ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন বিলীন হয়েছে বলে দাবি তাদের।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিআইয়ের সহ সভাপতি ছিদ্দিকুর রহমান দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
এফবিসিআইয়ের ২০১৮ সালে এক সমীক্ষা বলছে, রোজার ঈদকে কেন্দ্র করে এ দেশের অর্থনীতিতে দেড় লাখ কোটি টাকার লেনদেন হয়। শুধু পোশাকেই এক লাখ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। ঈদ বাজারের লেনদেনের বড় অংশই পোশাক-জুতা ও অন্যান্য ফ্যাশনের পাইকারি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে হয়। মূলত শবে বরাত থেকে ১৫ রোজার পর্যন্ত চলে এ লেনদেন।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও এফবিসিসিআই পরিচালক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলছেন, 'সারাদেশে অন্তত সাড়ে তিন লাখ পাইকারি দোকান রয়েছে। ঈদ উপলক্ষ্যে এসব দোকানে এক লাখ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। এর ওপর বিপুল পরিমাণ মানুষের জীবিকাও নির্ভর করে। লকডাউনের কারণে সবার স্বপ্নই শেষ'।
২০-২৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা ইসলামপুরে
ইসলামপুর অঙ্কুর ক্লথ সেন্টারের মালিক মিজানুর রহমান ৯০ সাল থেকে ব্যবসা করছেন। গত বছর করোনায় ৫০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে তার। এবার লোকসানের পরিমাণ আরো বাড়বে বলে জানান তিনি।
মিজানুর রহমান বলেন, 'গত বছরের ক্ষতি পোষাতে এবছর বিভিন্ন মানুষ থেকে ৫০ লাখ টাকা ধার করে পুনরায় বিনিয়োগ করেছি। লকডাউনের কারণে এখন মূলধন হারানোর পাশাপাশি ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় রয়েছি'।
দেশি-বিদেশি থান কাপড় থেকে শুরু করে থ্রিপিস, শাড়ি, লুঙ্গি, বাচ্চাদের পোশাক, বিছানার চাদর, পর্দার কাপড় ইত্যাদি পাওয়া যায় ইসলামপুরে। তা ছাড়া কাপড় তৈরির সব ধরনের সরঞ্জামও পাওয়া যায়। সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ব্যবসায়ী নেতারা জানান, বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় ইসলামপুরে, যার ৫০ শতাংশের কাছাকাছি হয় রোজার মাসে। দেশের থান কাপড়ের ৭০ শতাংশের পাইকারি বিক্রেতা তারা।
ইসলামপুর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সামসুল আলম সজল বলেন, 'শুধু ইসলামপুরে ছোট-বড়সব মিলে প্রায় ২০ হাজার ব্যবসায়ী ১১০টি মার্কেট রয়েছে। এই করোনায় সব ব্যবসায়ীই বড় লোকসানে। দেশের থান কাপড়ের ৭০ শতাংশ এবং বিদেশি থান কাপড়ের ৪০ শতাংশ চাহিদা এই বাজার পূরণ করে এই বাজার। কিন্তু এবার দেশের ১০ শতাংশ ও বিদেশি থান কাপড়ের ৫ শতাংশও বিক্রি হচ্ছে না'।
তিনি আর বলেন, 'সাধারণত শবে বরাতের পর ১৫ রোজার আগে সারাদেশের খুচরা ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছ থেকে কাপড় নিয়ে যান। লকডাউনের কারণে এবার আমরা সে সময়টি পাইনি। ফলে বিপুল ক্ষতির মুখে এখানকার সব ব্যবসায়ী'।
গত বছরের মতো এবারের ঈদেও ইসলামপুর ব্যবসায়ীদের ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা।
থমকে গেছে বাবুরহাটে হাজার কোটির বাজার
ইসলামপুরের মতোই নরসিংদীর বাবুরহাটের পাইকারি ব্যবসায়ীদেরও মাথায় হাত। ঈদের ব্যবসা ধরতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেও লোকসান গুনছেন প্রত্যেকে। কেউ কেউ সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে খোলার চেষ্টা করলেও ক্রেতা পাচ্ছেন না। কারণ, দূরপাল্লার গাড়ি বন্ধ থাকায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্রেতারা আসছেন না।
নরসিংদী সদর উপজেলার শেখেরচর-বাবুরহাটে শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রিপিস, শার্ট পিচ, প্যান্ট পিস, থান কাপড়, পাঞ্জাবির কাপড়, গামছা, বিছানার চাদরসহ প্রায় সব ধরনের দেশীয় কাপড় বিক্রির ছোট-বড় প্রায় ১০ হাজার দোকান রয়েছে। এই বাবুরহাটকে কেন্দ্র করে নরসিংদীজুড়ে গড়ে উঠেছে সহস্রাধিক টেক্সটাইল, ডায়িং, এমব্রয়ডারিসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ।
১৫ রোজার আগে দুই সপ্তাহ এখানে দৈনিক গড়ে ২০০-৩০০ কোটি টাকার কাপড় বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বাবুরহাট বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন বলেন, 'সারা বছর আমরা রোজার আগের ব্যবসার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকি। নতুন পণ্য বিক্রি আর গত মৌসুমের বকেয়া অর্থ উত্তোলন করি। শুরুটাও ভালো হয়েছিল। তবে নতুন বিধিনিষেধে সব শেষ।'
গতি হারিয়েছে কেরানীগঞ্জ
সারাদেশে বিক্রিত স্থানীয় পোশাকের ৭০-৮০ শতাংশের যোগান দেয় ঢাকার কেরানীগঞ্জসহ বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী এলাকার উৎপাদকরা। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পোশাক উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত কেরানীগঞ্জের ব্যবসায়ীদের মূল পরিকল্পনা থাকে রোজার ঈদকে ঘিরেই। উৎপাদিত পোশাকের ৭০ শতাংশ বিক্রি হয় ঈদ-উল- ফিতরে।
এখানকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদের সময় দুই মাসের ব্যবসায় সব পুষিয়ে একবছর চলার অবলম্বন পান তারা। করোনার কারণে গত বছর ব্যবসা না হওয়ায় কারখানা-শো রুমের ভাড়া, শ্রমিকদের বেতন, মেশিনারি ও কাঁচামাল ক্রয় ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে বিপাকে পড়েছেন তারা।
গত বছরের বিপদ কাটাতে এবার বেশি করে প্রস্তুতি নিয়েছেন। এবারো করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি ও সর্বশেষ লক ডাউনের কারণে বড় ক্ষতিতে পড়েছেন তারা।
কেরানীগঞ্জ জেলা পরিষদ মার্কেটে নিজের কারখানার জিন্সপ্যান্ট পাইকারি বিক্রি করেন গোলেনুর গার্মেন্টেসের মালিক মুক্তার দেওয়ান। ২০১৯ সালের ঈদে আড়াই কোটি টাকার জিন্স প্যান্ট বিক্রি করলেও গত বছর তা ছিল মাত্র ২৫ লাখ টাকা। এবার ঈদের জন্য ৩ কোটি টাকার পোশাক বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা তার।
মোক্তার দেওয়ান দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, 'লকডাউনের আগ পর্যন্ত ৫০ লাখ টাকার পোশাক বিক্রি করেছি। বাকী পণ্য গোডাউনে পড়ে আছে'।
তিনি বলেন, 'গত বছর ব্যাংক থেকে ঋণ ও মূলধন ভেঙ্গে শ্রমিকদের বেতন ও পরিবার চালিয়েছি। অনেক কষ্টে কারখানার ও শো-রুমের ভাড়া পরিশোধ করে এবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। এখন বেঁচে থাকার পথ দেখছি না'।
মোক্তার দেওয়ানের মতোই গতিহীন কারখানা ও বিক্রয় কেন্দ্রসহ এখানকার প্রায় ১০,০০০ ব্যবসায়ী ও ৫০০০ বেশি কারখানার কারখানার মালিকরা। এসব কারখানায় কর্মসংস্থান রয়েছে সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ মানুষের।
১৫ রোজার আগেই পাইকারি সেল শেষ হয় জানিয়ে কেরাণীগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী মুসলিম ঢালী বলছেন, 'সাধারণত শবে বরাত থেকে রমজানের মাঝামাঝি পর্যন্ত কেরানীগঞ্জে মূল বেচাকেনা হয়ে থাকে। সারাদেশ থেকে খুচরা বিক্রেতারা এখানে আসেন। ঈদকে কেন্দ্র করে ২,০০০-২,৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত পোশাক বিক্রি করেন এখানকার ব্যবসায়ীরা'।
অনিশ্চয়তায় বাটিক-জামদানি পল্লী
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার বান্টি গ্রামে প্রায় এক যুগ ধরে দেশীয় পোশাক বাটিক উৎপাদন ও বিপণন করছেন মো. বাচ্চু মিয়া। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে অন্তত ১০ লাখ টাকার ব্যবসা করেন তিনি।
প্রায় ৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে করোনার কারণে ২০২০ সালে সম্পূর্ণ ব্যবসায় লোকসান গুনেছে বাচ্চু মিয়ার মারিয়া বাটিক হাউজ। তবে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় এবার আবারো প্রস্তুতি নিয়েছেন। করোনার নতুন ঢেউ ও লকডাউন ভবিষ্যত অন্ধকারে ফেলেছে বাচ্চু মিয়াকে।
মো. বাচ্চু মিয়া দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, 'ধারদেনা করে এবার ৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। লেবারদের অনেককে বসিয়ে রাখা এবং গত বছরের লোকসান পুষাতে বেশি বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এবারের পহেলা বৈশাখ এবং ঈদেও বিক্রি করতে পারিনি। এখন ব্যাংক ঋণ, শ্রমিকদের বেতন, কারখানার ভাড়া ও নিজের পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছি'।
মারিয়া বাটিক হাউজের মতোই অবস্থা আড়াই হাজারের ৮-১০ হাজার উদ্যোক্তার। হারানো পুঁজি পুনুরুদ্ধারের চেষ্টায় আবারো হারানোর শঙ্কা চেপেছে তাদের ওপর। এসব উদ্যোক্তার অধীনে কাজ করছে লক্ষাধিক মানুষ। জীবন ও জীবিকা নিয়ে সংশয়ে তারাও।
তাঁত শ্রমিকদের অন্তহীন দুর্ভোগ
দেশের হস্তচালিত পোশাক উৎপাদনে দেশে সবচেয়ে বেশি কারিগর পাবনা-সিরাজগঞ্জ। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, কামারখন্দ, কাজীপুর ও সদর উপজেলাতে ৩.৫ লাখ তাঁত শ্রমিক শাড়ি, লুঙ্গি, গামছাসহ দেশীয় পোশাক উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। একইভাবে টাঙ্গাইলের কালিহাতি, বাসাইল. নাগরপুর এবং পাবনার কয়েকটি উপজেলায় দেশীয় পোশাক উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত তিন লাখের বেশি তাঁতি।
তাঁত ব্যবসায়ীরা বলছেন, ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় নামেন তারা। সারা বছর উৎপাদনে থাকলেও মোট বিক্রির ৬০ শতাংশই ঈদ ও পহেলা বৈশাখর সময় হয়।
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি তামাইল গ্রামের সৈয়দ বলছেন, 'ঈদের ১৫ দিন আগে পর্যন্ত দিনে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। গত দুই বছর উৎপাদন করে তা রেখে দিতে হচ্ছে। দুই বছরের লোকসানের কারণে এখন চার ছেলে-মেয়ে জীবন চলা দায়। মাঠ কাজ করা ছাড়া ভবিষ্যতে আর কোনো উপায় দেখছি না'।
ভৈরবের ১০,০০০ পাদুকা কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে
রোজা শুরু হওয়ার পরই বিপুল জমজমাট হয়ে উঠে দেশের সবচেয়ে বড় পাদুকা উৎপাদন ও বিপণন কেন্দ্র কিশোরগঞ্জের ভৈরব। রোজার শুরুতেই পাদুকার বেচাকেনা শুরু হয়ে যায়। এর একমাস আগেই পাদুকা কারখানাগুলোর উৎপাদন ২-৩ গুণ বেড়ে যায়। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জেলার পাদুকা ব্যবসায়ীরা ভৈরব থেকে জুতা কিনে নেন।
তবে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বন্ধ পাদুকা কারখানা ও পাইকারি মার্কেটের বিশাল কর্মযজ্ঞ। লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে পথে বসেছেন এখানকার ১০ হাজারের বেশি কারখানার মালিক। ধার দেনা করে ছোট ছোট পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করছেন এখানকার উদ্যোক্তারা।
পাদুকাকে কেন্দ্র করে ভৈরবে প্রায় দেড় লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। রোজার মাসের আয়-উপার্জন দিয়ে তারা সারা বছর বেঁচে থাকেন। একমাস যা আয় করেন তা দিয়েই ১১ মাস ভালোভাবে সংসার চালাতে পারেন বলে জানান ভৈরব পাদুকা মালিক সমিতির সভাপতি মো. আল-আমিন।
তিনি বলেন, 'করোনার কারণে পাদুকা ব্যবসায় এবার ধস নেমেছে। কারখানায় নেই কোনো উৎপাদন, দোকানে নেই কোনো বেচাকেনা। সবই বন্ধ। উৎপাদন ও বিক্রিসহ লক্ষাধিক মালিক, কর্মচারী ও শ্রমিক এখন বেকার হয়ে পড়েছেন'।