ঢাকায় ইমিগ্রেশন কাউন্টারের কচ্ছপগতিতে বিরক্ত বিদেশি বিনিয়োগকারীরা
অভিবাসন কর্তৃপক্ষের কচ্ছপগতির কারণে বাংলাদেশে আসতে চান না বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। বিশেষ করে, জাপানি বিনিয়োগকারীরা এতে খুবই অসন্তুষ্ট। ইমিগ্রেশনে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয় বলে অভিযোগ তাদের, দেশের প্রধানতম গেটওয়ে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কখনো কখনো ৩-৪ ঘণ্টার বেশি অভিবাসন প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগে।
গত মাসে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-বিডা'র নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি- ইউজি আনদো অভিযোগ করেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই হয়রানি ও সময়ক্ষেপণের কারণে বাংলাদেশে আসতে চান না।
আনদো বলেন, 'হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে কখনো ৩-৪ ঘণ্টা সময় লাগে। তাই বাংলাদেশে আসতে বিদেশিরা; বিশেষত জাপানি বিনিয়োগকারীরা উৎসাহী নন। তবে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থার উন্নতি হলে- তা বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করবে।'
তিনি উল্লেখ করেন যে, একটি দেশের প্রধান বিমানবন্দর, সেদেশের প্রধান প্রবেশদ্বার। তাই বিমানবন্দরে দ্রুত ও ঝামেলামুক্ত সেবাদান নিশ্চিত হলে তা দেশটির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে। ওই বিমানবন্দরই সেদেশে বিদেশিদের পর্যটন, ব্যবসা ও বিনিয়োগের লক্ষ্যে ভ্রমণ উৎসাহিত করে।
গেল বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাপান-বাংলাদেশ পাবলিক-প্রাইভেট ইকনোমিক ডায়ালগ- শীর্ষক বৈঠকে জাপানি বিনিয়োগকারীরা ইমেগ্রেশনে দীর্ঘ কালক্ষেপণের বিষয়টি তুলে ধরে নিজেদের হতাশার কথা বর্ণনা করেন।
বাংলাদেশে বিনিয়োগ ঘাটতি দূর করতে, সফররত বিনিয়োগকারীকে বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা, অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ও হোটেল বুকিংয়ে সাহায্য থেকে শুরু করে পরিবহন ব্যবস্থাপনার মতো সেবা দেয় বিডা।
এজন্য বিমানবন্দরে একটি হেল্প ডেস্কও স্থাপন করে সংস্থাটি, কিন্তু জনবল সংকটে তা এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এবিষয়টি তুলে ধরে বিনিয়োগকারীরা বৈঠকে বলেছেন, 'সেখানে মাত্র একজন কর্মীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তার একার পক্ষে তো ২৪ ঘণ্টা সেবাদান সম্ভব নয়।'
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব কর্তৃপক্ষের (পিপিপি) সহায়তায় এই ডেস্কের জনবল সমস্যাটি দূর করতে বৈঠকে পরামর্শ দেওয়া হয়।
বিমানবন্দরে বিনিয়োগকারীদের অভ্যর্থনামূলক সেবাদানে আলোচিত সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয় করবে বিডা।
এনিয়ে এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়ামের সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক ইউশিনোরি গোতো বলেন, অভিবাসন কর্মকর্তাদের শূন্য পদগুলি পূরণ করা হলে এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য নির্ধারিত লেনের সংখ্যা বাড়িয়ে বিমানবন্দরের বিদ্যমান কাঠামোকে অধিক কার্যকর ও উন্নত করা যেতে পারে।
সাধারণত ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে যাত্রীপ্রতি অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ৫-১০ মিনিট সময় লাগে, তবে কোন বিশেষ কারণ থাকলে সময় বেড়ে যায়। এজন্য অভিবাসন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব বলেও জানান তিনি।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অটোমেটেড বর্ডার কন্ট্রোল বা ই-গেট বসানো হলেও, মেশিনগুলো এখনও চালু হয়নি। এগুলো চালু হওয়ার পর অভিবাসন প্রক্রিয়ায় গতি আসবে- বলে জানান ইউশিনোরি গোতো।
তিনি উল্লেখ করেন যে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি পেমেন্ট ভিত্তিক অটোমেটেড বর্ডার কন্ট্রোল সিস্টেম চালু করা যেতে পারে।
সম্পূর্ণরুপে টিকাপ্রাপ্ত বিনিয়োগকারীদের অন-এরাইভাল ভিসা দেওয়ারও প্রস্তাব দেন গোতো।
বৈঠকে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতকরণ ও সহজে ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টির সাথে ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত প্রক্রিয়ার বিষয়গুলি সরাসরি সম্পৃক্ত।
তবে শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ মাত্র দুটি আন্তর্জাতিক টার্মিনাল নিয়ে ক্রমবর্ধমান যাত্রী ও মালামাল ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না। এজন্য সরকার বিমানবন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে তৃতীয় আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে।
বর্তমান স্থাপনাগুলোর উন্নতি সাধন করা হলে, বিনিয়োগকারীরা ঝক্কিমুক্ত সেবা পাবেন।
এব্যাপারে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম তৌহিদ-উল-আহসান বলেন, ইমিগ্রেশন সেবা দেওয়ার জন্য বর্তমানে ৪৮টি কাউন্টার রয়েছে।
তবে অভিবাসন কর্মকর্তাদের নিয়োগদান ও যাত্রীদের অপেক্ষমাণ সাড়ি নির্ধারণের দায়িত্ব অভিবাসন বিভাগের।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তরফ থেকে প্রস্তাব পাঠানো হলে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুনির্দিষ্ট ইমিগ্রেশন কাউন্টার চালু করা যাবে, বলেও জানান তিনি।
ঢাকায় অবস্থিত দেশের এই প্রধান বিমানবন্দরে বর্তমানে মাত্র ৫৫ জন অভিবাসন কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা আট ঘণ্টা পর পর পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করছেন বলেও জানান নির্বাহী পরিচালক।
এনিয়ে সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপ-সচিব মো. শাহরিয়ার জানান, তারা অভিবাসন প্রক্রিয়া দ্রুতকরণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন। ই-গেট চালু হলে ই-পাসপোর্টধারী ভ্রমণকারীরা দ্রুত ইমিগ্রেশন পার হতে পারবেন।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দুর্ভোগ কমাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে বিনিয়োগকারী ও পিআই, বি, ই ও ই-ওয়ান ভিসাধারী ব্যবসায়ীদের অন-এরাইভাল ভিসা সুবিধা দেওয়ার অনুরোধ করবে বিডা। বৈঠকের ধারা বিবরণী অনুসারে, বিডা এজন্য অন-এরাইভাল ভিসার সময় সংক্ষিপ্ত করতে একটি অনুরোধপত্র পাঠাবে।
এছাড়া, বিনিয়োগকারীদের জন্য শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে চারটি এবং প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনালে একটি স্বতন্ত্র ইমিগ্রেশন কাউন্টার চালু করতে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছেও প্রস্তাব দেবে বিডা।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, সুরক্ষা সেবা বিভাগ অভিবাসন কর্মকর্তাদের শূন্যপদে নিয়োগ দেবে এবং অভিবাসন প্রক্রিয়া দ্রুতকরণে এক লাইনের পরিবর্তে মাল্টি-চ্যানেল সাড়ি ব্যবস্থা চালুর দরকারি পদক্ষেপ নেবে।