ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের সঙ্গত উদ্বেগ আছে: ফাহমিদা খাতুন
মন্দ বা খেলাপি ঋণের চাপ কমাতে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কাজ শুরু করেছেন অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এমন সংবাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। ব্র্যাক সেন্টারে শনিবার সকালে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের প্রতিক্রিয়া ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন সংস্থাটির বিশেষজ্ঞগণ। শুরুতেই বক্তব্য উপস্থাপন করেন অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন।
তিনি বলেছেন, ‘সিপিডি দীর্ঘদিন ধরেই দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে গবেষণা করছে, এ কথা কারও অজানা নয়। তাই ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের সঙ্গত উদ্বেগ আছে। সেই উদ্বেগ নিয়ে আমরা সাম্প্রতিক ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে বিভিন্ন সুপারিশের অংশ হিসেবে একটি কমিশনের কথা সরকারের নানা পক্ষ বলে আসছে। এই বিষয়ে আমরা নিজেদের বিশ্লেষণ নীতি-নির্ধারকদের কাছে বারবার উপস্থাপন করেছি, কিন্তু পরামর্শের প্রেক্ষিতে তেমন সাড়া পাইনি। এর মাঝেই সম্প্রতি পত্রিকান্তরে জানতে পারি মাননীয় অর্থমন্ত্রী বহুল প্রতিক্ষীত ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। আমরা সিপিডির পক্ষ থেকে এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তবে সেটার ওপর আমাদের কিছু মন্তব্য আছে।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য এখন ক্রমাগত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। সেই প্রেক্ষিতে সিপিডি গত কয়েক বছর ধরেই একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং সাময়িক ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দাবি করে। এর মাধ্যমে অর্থনীতির জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ খাত, সেটির প্রকৃত অন্তর্নিহিত সমস্যা উদঘাটন এবং তথ্য-উপাত্তের সাহায্যে সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করে ব্যাংকিং খাতের জন্য সহযোগী এবং উপযোগী সুপারিশমালা তৈরির দাবি উপত্থাপন করে আসছে সিপিডি।’
তিনি জানান, ‘২০১২ সালে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির কথা হয়তো অনেকেরই স্মরণ আছে। ওই ঘটনার পরেই সিপিডি একটি আলোচনা করেছিল, তখন কিন্তু আমরা সেই সমস্যার প্রেক্ষিতে প্রথম একটি ব্যাংকিং কমিশনের দাবি করেছিলাম।
‘শুধু তাই নয়, একটি ব্যাংকিং কমিশন কিভাবে কাজ করবে বা এর টার্মস অব রেফারেন্স কি হতে পারে, কার্যঃপরিধি এবং কার্যঃপ্রণালী সেগুলোও আমরা উত্থাপন করেছিলাম। এসব কিছুই আমরা বলছি আজ থেকে আট বছর আগে।’
অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বছরে তিনবার আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতির নানা খাত নিয়ে আইআরবিডি প্রতিবেদন প্রকাশ করি। সেখানে প্রতিবারই ব্যাংকিং খাতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। গুরুত্ব দিয়েই আমরা এইখাতের বিভিন্ন সূচকের গতি-প্রকৃতি আমরা পর্যবেক্ষণ করি। ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যও সেখানে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়।
‘এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সব কয়টি আইআরবিডি প্রতিবেদনেই আমরা ব্যাংকিং কমিশন গঠন দাবি করে আসছি। কিন্তু এর প্রেক্ষিতে আমরা সরকারের নীতি-নির্ধারকদের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাইনি।
তবে একটা ব্যাপার হয়েছে, এর আগের অর্থমন্ত্রী ব্যাংকিং কমিশন নিয়ে বেশ কয়েকবার আলোচনা করেছেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গেও মত-বিনিময় করেছেন। আগের ও বর্তমান অর্থমন্ত্রী ব্যাংকিং কমিশন নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কতবার কথা বলেছেন, এই ব্যাপারে আমাদের একটি হিসাব আছে।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘প্রতিটি আলোচনায়, 'শিগগিরই আপনারা একটি ব্যাংকিং কমিশন দেখতে পারবেন', এমন আশ্বাস দেওয়া হলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। বর্তমান অর্থমন্ত্রীও দায়িত্ব নেওয়ার পরেই ব্যাংকিং খাত বিষয়ক টাস্কফোর্স গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই কমিটির মাধ্যমে নাকি তিনি খাতটির সংস্কার করবেন, এমন কথাও বলেছেন।
‘‘এছাড়া সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী একটি ব্যাংকিং কমিশন করা যায় কিনা সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এর মাঝে বেশ কয়েকবার বললেও সর্বশেষ গত বছরের আগস্ট এবং নভেম্বর মাসে ব্যাংকিং কমিশনের কথা তিনি উল্লেখ করেন।’’
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘‘এ সময় অর্থমন্ত্রী বারবার বলেছেন, ‘ব্যাংকিং কমিশন ইজ অ্যা মাস্ট’ বা তাড়াতাড়ি হবে এই সমস্ত বিষয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রকৃত উদ্যোগ নিতে কোথাও যেন একটা অনীহা রয়ে গেছে। তাই এখন দু’একটি পত্রিকায় ব্যাংকিং কমিশন গঠনের যে খবর এসেছে সেটা যদি সত্যি সত্যি হয়, তাহলে সেটা একটা ভালো উদ্যোগ।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি সিপিডি এবং আরও অনেকেই এই কমিশনের কথা বলেছেন। আবার অনেকে এর বিরোধিতাও করেন। তবে সত্যি হলে সিপিডিসহ অন্যদের দাবি করা ব্যাংকিং কমিশন হয়তো শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখতে পারবে। সেদিক থেকে একে আমরা সিপিডি'র নীতি প্রভাবের প্রক্রিয়ার ফসল বলেও উল্লেখ করতে পারি।
‘আজকের সম্মেলনে উপস্থিত সংবাদকর্মীরা ব্যাংকিং কমিশনের গুরুত্ব ভালো করেই অনুধাবন করতে পারেন। কারণ আপনারা নানা গণমাধ্যমে দেশের ব্যাংকিংখাতের বেহাল দশা নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন লিখছেন। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেটা হলো খেলাপি ঋণের পরিমাণ।
‘গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা সংবাদে অবশ্য তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।
‘গত নভেম্বরে সিপিডির এক সংবাদ সম্মেলনে এই পরিমাণ টাকা দিয়ে দেশের কী কী উন্নয়ন করা যেত তা আলোচনা করা হয়। যেমন ওই টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু বানাতে পারি, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানাতে পারি- এমন বেশ কিছু বড় অবকাঠামো প্রকল্প বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের টাকায় করা সম্ভব ছিল, যদি এসব অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে থাকত।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘আরেকটা ব্যাপার হলো, এতদিন আমরা দেখেছি শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকেই সমস্যা রয়েছে। সেখানে ঋণ খেলাপির পরিমাণ বেশি। সেখানে বিভিন্ন ধরনের সেবার মান অত্যন্ত নিম্ন। কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকেও সমস্যা রয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এখানেও বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম দেখা দিচ্ছে।
‘এর আগে সিপিডি জানিয়েছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের মোট ঋণের মাঝে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ হচ্ছে খেলাপি ঋণ। আর ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের মোট ইস্যুকৃত ঋণের ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হচ্ছে খেলাপি ঋণ।
‘আবার আমরা যদি মোট খেলাপি ঋণ কোন কোন ব্যাংকে রয়েছে- সেদিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং সরকারি কিছু ব্যাংক সেখানে প্রায় সমান সমান অবস্থানে আছে।’
অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, ‘সরকারি মালিকানাধীন এবং বিশেষায়িত ব্যাংকের মোট ঋণের ৫১ শতাংশ খেলাপি হয়েছে। বাকি ৪৭ শতাংশ হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের। তবে বিশেষায়িত ব্যাংকের সংখ্যা বাদ দিলে দেখা যাবে সরকারি এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন উভয়ের ঋণ খেলাপি ৪৭ শতাংশ।
‘সুতরাং এতদিন যে আমরা বেসরকারি খাতের ব্যাংকিংয়ে দক্ষ এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনার উদাহরণ দিয়ে আসছিলাম, সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এই ব্যতিক্রম তৈরি করেছে।
‘সামগ্রিক অবস্থার পেক্ষাপটে এটা স্পষ্ট রাজনৈতিক প্রভাবের আওতার বাহিরে গিয়ে যদি নতুন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা সম্ভব হয়, তাহলে এটা আর্থিকখাতের ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারবে। পাশাপাশি জনগণের মতামতকেও কমিশনের কার্যাবলীতে প্রাধান্য দিতে হবে। আর্থিক খাতে সংস্কারের প্রতিটি ধাপ নিয়ে স্বচ্ছ সুপারিশমালা প্রকাশ করাটাও আমাদের অন্যতম প্রধান দাবি।’