মালিকানা সংকটে নগদ
কার্যক্রম শুরু করার পর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নেয়নি দেশের দ্রুত বর্ধনশীল আর্থিক মোবাইল সেবাদানকারী (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান নগদ। মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতায় লাইসেন্স না নেওয়ায় ঝুঁকিতে আছেন নগদের রেজিস্ট্রিকৃত ৩ কোটি ৮০ লাখ গ্রাহক।
২০১৯ সালের ২৬ মার্চ থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেডের অধীনে যাত্রা শুরু করে নগদ। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মালিকানা উল্লেখ করে নিজেদের রাষ্ট্রচালিত আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রচার করলেও, প্রকৃতপক্ষে এর কোনও সরকারি অংশীদারি নেই।
নগদের অধিকাংশ বিনিয়োগ সিগমা গ্রুপের। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সাথে এমএফএস চুক্তির মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে সিগমা গ্রুপ। কিন্তু এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এমএফএস নীতিমালা অনুযায়ী, লাইসেন্স পেতে হলে নগদের ন্যূনতম ৫১ শতাংশ অংশীদারি মালিকানা বাংলাদেশ ডাক বিভাগের অধীনে থাকতে হবে। মালিকানায় অংশীদারির বিষয়টি অমীমাংসিত থাকায়, প্রতিষ্ঠানটি গত দুই বছরে লাইসেন্সের জন্য আবেদন পর্যন্ত করতে পারেনি।
তবে, গত বছরের মার্চে আর্থিক সেবাদান কার্যক্রম পরিচালনা করতে ডাক বিভাগের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক সাময়িকভাবে 'নো অবজেকশন সার্টিফিকেট' জারি করে।
গড়ে দৈনিক ৪০০ কোটি টাকা লেনদেনের মাধ্যমে- নগদ বর্তমানে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। নগদের গ্রাহক সংখ্যা এবং বাজারে শেয়ার দ্রুত বাড়লেও প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন এখনও নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। ফলে, গ্রাহকদের জন্য বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ কর্মকর্তা জানান, দুই বছরের মোবাইল সেবাদানের মাধ্যমেই বাজারের ৩০ শতাংশের বেশি এখন নগদের দখলে। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি না থাকায় প্রতিষ্ঠানটি এমএফএস নীতিমালার আওতাধীন কি না, তা কেউ জানেন না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মালিকানার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ মিশুক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে রেভিনিউ-শেয়ারিং মডেল বা মুনাফা বন্টন চুক্তির মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে নগদ। এই মডেল অনুসারে, সরকারের সাথে নগদ কেবলমাত্র মুনাফার অংশ শেয়ার করবে। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স পেতে হলে, প্রতিষ্ঠানটিকে এমএফএস নীতিমালায় উল্লেখিত অংশীদারি মডেল অনুসরণ করতে হবে।
এমএফএস অংশীদারি মডেল অনুযায়ী, ডাক বিভাগ ৫১ শতাংশ মালিকানা পাবে বলে জানান তিনি। তানভীর আহমেদ মিশুক নিজেও সিগমা গ্রুপের পক্ষ থেকে নগদের একজন অংশীদার। "প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে লোকসানের মুখে থাকায় মালিকানা প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা কিছু জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছি। সুতরাং, ডাক বিভাগকেও লোকসানের অংশ বইতে হবে। আগে, রেভিনিউ-শেয়ারিং মডেল অনুসারে তারা আয়ের অংশ পেত," বলেন তিনি।
অন্যদিকে, সরকারি সংস্থার মালিকানা গ্রহণ প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। ফলে, লাইসেন্স পেতে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানান মিশুক।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে, আয়ের অংশ হিসেবে সরকারকে এক কোটি ১২ লাখ টাকা প্রদান করে নগদ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ডাক বিভাগের নেট আয়ের হিসাবে এই অর্থ অন্তর্ভুক্ত হয়।
আয়ের অংশ শেয়ারের মাধ্যমে, ডাক বিভাগের অধীনে একমাত্র লাভজনক সেবা প্রদানকারী হওয়ার ইতিহাস গড়ে নগদ।
দৈনিক মোট লেনদেন ৪০০ কোটি টাকা হওয়ায় নগদের বর্তমান মূল্য এখন এক বিলিয়ন ডলারের বেশি বা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি বলে দাবী করেন মিশুক। তৃতীয় পক্ষের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে গত বছর জুনে তারা প্রতিষ্ঠানটির মূল্যায়ন যাচাই করান। তখন দৈনিক ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির মূল্য বা সম্পদের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
তবে, তিনি মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করতে চাননি। ডাক বিভাগের ৫১ শতাংশ অংশীদারি ঐ প্রতিষ্ঠানটির মূল্যায়নের ভিত্তিতে হবে বলেও জানান তিনি। সরকার নগদ অর্থে এখানে বিনিয়োগ না করলেও তাদের সদিচ্ছা এবং সম্পদের বিষয়টি মূল্যায়ন করা হবে।
নগদের মালিকানা সংকটের বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন জানান, থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিসের সাথে কোম্পনি গঠনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। "কিছু বিষয় নিয়ে সমাধানে আসতে আমাদের আরও দুই বা তিন দফায় আলোচনায় বসতে হবে। তারপর, আমরা মূল্যায়নের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের নিকট আবেদনপত্র পাঠাব," বলেন তিনি।
তিনি জানান, ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠানটির ৫১ শতাংশ মালিকানা পেলেও কোনও বিনিয়োগ করবে না।
তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীনে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্য এবং নগদের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ শাফায়েত আলম জানান, ডাক বিভাগের বিনিয়োগের বিষয় মূল্যায়নে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ডাক বিভাগ কীভাবে অবকাঠামোগত ব্যবস্থাকে বিনিয়োগ মূল্যে রূপান্তর করতে পারে তা নিয়ে ইতোমধ্যে কমিটি দিক-নির্দেশনা তৈরি করেছে বলে জানান তিনি।
নগদ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ডিজিটাল অর্থ লেনদেনের মাধ্যম হলেও, লাইসেন্স না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট মোবাইল আর্থিক সেবার পরিসংখ্যানে প্রতিষ্ঠানটির লেনদেনের প্রতিফলন নেই। বর্তমানে বাজারে ১৫ টি আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেটা অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে গড় দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি।