শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির থেকে সোনালী ব্যাংকের আদায় ০.৪৩ শতাংশ
খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংক। শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি গ্রাহকের কাছ থেকে আটমাসে আদায় হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ০.৪৩ শতাংশ।
চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দুই হাজার ২৩২ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ব্যাংকটি তাদের কাছ থেকে আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
সোনালী ব্যাংকের লোন রিকভারি ডিভিশনের শীর্ষ ২০ শ্রেণীকৃত ঋণগ্রহীতার চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট থেকে আদায়ের বিবরণী থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণের তথ্য অনুযায়ী সোনালী ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ হলো ৫৪ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। বর্তমানে এই ঋণের মধ্যে প্রায় ১৮.৯৩ শতাংশই খেলাপি।
ব্যাংকটির খেলাপির পরিমাণ বর্তমানে ১০ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। এরমধ্যে শীর্ষ ২০টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি রয়েছে ৪,০৮৩ কোটি টাকা। শতাংশ হিসেবে খেলাপির ৩৭ দশমিক ৩২ শতাংশ এই ২০টি প্রতিষ্ঠানের।
শীর্ষ ২০ খেলাপির মধ্যে চলতি সময়ে খেলাপি ঋণের লক্ষ্যমাত্রার ৪ শতাংশ ঋণ পরিশোধ করেছে মডার্ন স্টিল মিলস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি লালদীঘি কর্পোরেট শাখা থেকে নেওয়া ঋণের খেলাপির পরিমাণ রয়েছে ৪৫৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে চলতি বছরে খেলাপি ঋণ পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। তবে, প্রতিষ্ঠানটি পরিশোধ করেছে মাত্র ৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
ফ্লিচ ফেব্রিকস, নিট ফেব্রিকস, ইয়ার্ন ডায়িং এবং গার্মেন্টস ডায়িং ওয়াশিং নিয়ে কাজ করে তাইপেই বাংলা ফেব্রিকস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় থেকে নেওয়া ঋণের বর্তমানে ৩৩১.৬০ কোটি টাকা খেলাপি। এর মধ্যে চলতি বছরে ৩১৭ কোটি টাকা পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি গত আটমাসে একটাকাও পরিশোধ করেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক জহির উদ্দীন আহমেদ দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে ঋণের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, "এ বিষয়ে আপনাদেরকে আমার বলার কিছু নেই। আপনারা সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।"
খেলাপির শীর্ষে থাকা অন্য ২০টি প্রতিষ্ঠান হলো- মেসার্স টি এন্ড ব্রাদার্স গ্রুপ, মেসার্স হল মার্ক গ্রুপ, মডার্ন স্টিল মিলস লি, তাইপেই বাংলা ফেব্রিক্স লিমি, মেসার্স ফেয়ার ট্রেড ফেব্রিক্স, মেসার্স রহমান গ্রুপ, মেসার্স লীনা গ্রুপ, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস, মেসার্স এফ আর জুট ট্রেডিং, মেসার্স মেঘনা কনডেন্স মিল্ক, মেসার্স সোনালী জুট মিলস, মেসার্স এ কে জুট ট্রেডিং, মেসার্স ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, মেসার্স এফ আর জুট মিলস, আব্দুর রাজ্জাক লিমিটেড, মেসার্স সুপ্রিম জুট এন্ড নিটেক্স লিমিটেড, মেসার্স সানবীম টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, মেসার্স সাইয়ান কর্পোরেশন।
এ বিষয়ে দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান বলেন, "যারা খেলাপি হয়েছে আমাদের লক্ষ্য যেভাবেই হোক টাকা আদায় করা। আমরা ব্যক্তিগতভাবে তাদের সঙ্গে বসছি। আমাদের বোর্ড চেষ্টা করে যাচ্ছ। এছাড়া ডিএমডি হেডেড কমিটি করা হয়েছে। একইসঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। আদালতের মাধ্যমে যাতে টাকাগুলো আদায় করা যায় সেই প্রচেষ্টাও রয়েছে।"
তিনি বলেন, "কোভিডে অনেক প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক হতে পারছে না সেটাও বিবেচনায় রয়েছে। রহমান গ্রপের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ পুনঃতফসিলের প্রস্তাব দিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে পাঁচ থেকে সাত কোটি টাকা পরিশোধও করবে।"
তিনি আরও বলেন, "সাম্প্রতি রহমান গ্রুপের বিরুদ্ধে একটি ওয়ারেন্টও হয়েছে। যে প্রক্রিয়াই হোক আমরা খেলাপির টাকা আদায় করব।"
সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা তৎপরতার পরও কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না খেলাপি ঋণ। উল্টো করোনার মধ্যে বেড়েই চলেছে আর্থিক খাতের এই 'বিষফোঁড়া'।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি 'ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশন' শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৮ হাজার ১৬৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, যা মার্চ শেষে ছিল ৯৪ হাজার ২৬৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ৩ হাজার ৮৯৯ কোটি ১২ লাখ টাকা।
দেশে বিতরণ করা মোট ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে বছরের প্রথম ছয় মাসে জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৭০১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং গত মার্চে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। খেলাপির হার বেড়েছে শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ। দেশে বিতরণ করা মোট ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৮ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা।
করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর গত বছর কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি করতে পারেনি ব্যাংক। এ বছর নতুন করে আগের মতো ঢালাও সুযোগ দেওয়া হয়নি। তবে ঋণগ্রহীতারা তাদের চলতি বছরের ঋণের কিস্তির ২৫ শতাংশ পরিশোধ করলেই ওই ঋণকে খেলাপি বলা যাবে না। এছাড়া কিস্তির বাকি ৭৫ শতাংশ পরবর্তী এক বছরের মধ্যে জমা দিতে হবে।
করোনার কারণে ছাড়ের আগে ২০১৯ সালে মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। এ সুবিধার পর ব্যাংকগুলোতে ৫২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত হয়। যে কারণে ২০১৯ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ব্যাপক কমে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকায় নেমে আসে। এদিকে এ সুবিধা ফের বাড়িয়ে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়।