স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য সুবিধা হারাতে পারে পোশাক খাত
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর যুক্তরাজ্যের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধায় তৈরি পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এছাড়া, সমুদ্রে অনিয়ন্ত্রিতভাবে মৎস্য আহরণের কারণে দেশের অন্যতম রপ্তানি বাজারটিতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় হিমায়িত মাছ রপ্তানিও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
ব্রেক্সিট পরবর্তী নিজস্ব জিএসপি স্কিম প্রণয়ণের কাজ শুরু করেছে যুক্তরাজ্য, যেখানে লিস্ট ডেভেলপট কান্ট্রি ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় বাংলাদেশের অস্ত্র বাদে সকল পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে।
তবে মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার লঙ্ঘন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও অর্থ পাচার বিষয়ে আন্তর্জাতিক কনভেনশন প্রতিপালনের ব্যর্থতা এবং জাতিসংঘের সিঙ্গেল কনভেনশন অন নারকোটিক ড্রাগস- এর লঙ্ঘন ও অবৈধ পণ্য বাণিজ্য প্রতিরোধে ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন কারণে এই সুবিধা বাতিল বা স্থগিত করার বিধান রাখতে যাচ্ছে দেশটি।
এসব শর্ত সঠিকভাবে মেনে চলা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য কঠিন বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তাই শর্তগুলো শিথিল করতে দেশটিকে অনুরোধ জানানো হবে।
শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০১৩ সালের জুন থেকে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখতে শ্রমিক অধিকারের পাশাপাশি মানবাধিকার সুরক্ষাসহ ৯ দফা অ্যাকশন প্ল্যান দিয়ে তা বাস্তবায়নের রোডম্যাপ চেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। গত অর্থবছর দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৭০ কোটি ডলার, যা দেশের মোট রপ্তানির ৯.৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে ওভেন পোশাক রপ্তানিতে আয় হয়েছে ১৩৩ কোটি ডলার, নিটওয়্যার ২১১ কোটি ডলার ও হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর ইউরোপিয় ইউনিয়নের মতো বাংলাদেশ আরও তিন বছর ট্রানজিশন পিরিয়ড হিসেবে এ সুবিধা পাবে কি-না, তা এখনও নিশ্চিত নন ঢাকার কর্মকর্তারা। তবে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরের তিন বছর জিএসপি সুবিধা বহাল রাখার বিষয়ে মৌখিকভাবে ঢাকাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে লন্ডন। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনারও এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
জানা গেছে, যেসব দেশ স্বল্প এবং স্বল্প মধ্য আয়ের তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হিসেবে বিবেচনা করে এবং ২৭টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন সন্তোষজনকভাবে মেনে চলার শর্তের আলোকে জিএসপি সুবিধা দেওয়ার জন্য ইইউ জিএসপি প্লাসের মতো বর্ধিত পরিকাঠামো প্রণয়ন করছে যুক্তরাজ্য। এর আওতাভুক্ত দেশগুলোর প্রোডাক্ট লাইনের দুই-তৃতীয়াংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে।
তবে বর্ধিত পরিকাঠামোর আওতায় কোন পণ্য নির্দিষ্ট হারের অতিরিক্ত রপ্তানি করলে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল করে 'প্রোডাক্ট গ্র্যাজুয়েশন' এর বিধান রাখা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান তৈরি পোশাক পণ্য শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা হারাতে পারে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
ইতোমধ্যে নতুন জিএসপি স্কিমের ওপর প্রশ্নমালা পাঠিয়ে আগামী ১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের কাছে পজিশন পেপার চেয়েছে যুক্তরাজ্য। সোমবার এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে স্টেকহোল্ডার সভা করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অবস্থানপত্র পাঠাবে। সেখানে কিছু বিষয় শিথিল করতে যুক্তরাজ্যকে অনুরোধ জানানো হবে।
প্রোডাক্ট গ্র্যাজুয়েশন বিষয়ে ইউকে জিএসপি স্কিমের পাবলিক ডকুমেন্টে বলা হয়েছে, টেক্সটাইল ও অ্যাপারেলসহ পোশাক পণ্যে গ্র্যাজুয়েশন বিধিমালা তখনই আরোপিত হবে যখন আমদানি অনুপাত ৪৭.২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে এই সীমা ৫৭ শতাংশ। অন্যদিকে, জীবন্ত গাছের চারা, ঔষধি পণ্য, সবজি পণ্য এবং প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জজাত তেল, চর্বি, মোম এবং খনিজ পণ্যে আমদানির অনুপাত ১৭.৫ শতাংশ ছাড়ালে গ্র্যাজুয়েশন সীমা আরোপিত হবে। প্রতি তিন বছর অন্তর গ্র্যাজুয়েশন করা পণ্য তালিকা পর্যালোচনা করবে ব্রিটিশ সরকার।
পণ্যের গ্র্যাজুয়েশন বলতে বোঝায় কোন নির্দিষ্ট পণ্যের গ্র্যাজুয়েশন পর্যালোচনার পর সেটির অগ্রাধিকার হারের (জিএসপি) সুবিধা বাতিল হওয়া। কোন পণ্য গ্র্যাজুয়েট বলে বিবেচিত হওয়ার অর্থ, সেটি যুক্তরাজ্যের বাজারে উচ্চ মাত্রায় প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম এবং সেকারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিক শুল্ক সুবিধার প্রয়োজন নেই। ফলে এসব পণ্যের আমদানি যুক্তরাজ্য সরকারের অগ্রাধিকার হারের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না এবং দেশটির বৈশ্বিক শুল্ক নীতির আওতায় পড়বে। ব্রিটিশ সরকারের নতুন সাধারণ বাণিজ্য পরিকাঠামোর আওতায় কোন দেশ থেকে আমদানিও বন্ধ রাখার বিধান রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের বাজারে এখনও বর্ধিত ও সাধারণ পরিকাঠামোর (জেনারেল ও ইনহ্যান্সড ফ্রেমওয়ার্ক) আওতায় ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা রয়েছে, যারা তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এর মধ্যে ভিয়েতনামের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি থাকায় তারা জিএসপি সুবিধা পাবে না।
এতে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর জিএসপি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান প্রধান আইটেমগুলোর রপ্তানির হার ৪২ শতাংশের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর বাংলাদেশ বর্ধিত ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় যুক্তরাজ্যে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার আশা করছে। সেখানে তৈরি পোশাক রপ্তানি শর্তমুক্ত জিএসপি সুবিধা পেতে চেষ্টা করবে বাংলাদেশ। সেজন্যই অবস্থানপত্রে বাংলাদেশ প্রোডাক্ট গ্র্যাজুয়েশনের শর্ত শিথিল করার অনুরোধ জানাবে।
তারা বলেন, যুক্তরাজ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধায় সামুদ্রিক মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রে রেগুলেটেড ও কন্ট্রোলড ফিশিং এর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সমুদ্রে মৎস্য আহরণকারী জাহাজগুলো রেগুলেট করার ব্যবস্থা নেই বাংলাদেশে। তাই এ শর্তও শিথিল করার অনুরোধ জানানো হবে।
এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানেন না বলে টিবিএসকে জানান বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
তবে বর্ধিত ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় জিএসপি সুবিধা পেতে বলে ২৭টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন মেনে চলতে হবে। এ প্রসঙ্গে দেশটি বলেছে, তাদের লক্ষ্য মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার নিশ্চিতে সুবিধা পেতে উৎসাহী দেশগুলো যেন উৎসাহী হয় তা নিশ্চিতকরণ এবং সুশাসন ও টেকসই উন্নয়ন জোরদার করা। তাই বর্ধিত ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে সকল দেশকে ২৭টি আন্তর্জাতিক কনভেনশনের প্রতি সম্মতি ও প্রতিপালনে অঙ্গীকার করার আহবান জানানো হয়েছে। এবং সে অনুসারে অগ্রগতির প্রতিবেদনও জানাতে হবে।
এনিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম টিবিএসকে বলেন, ব্রেক্সিট পরবর্তী যুক্তরাজ্য দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিকে প্রাধান্য দেবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করবে। তাতে ইউনিলেটারাল স্কিমের গুরুত্ব কমে যেতে পারে। যুক্তরাজ্য যাদের সঙ্গে এফটিএ করবে, তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ থাকলে বাংলাদেশের রপ্তানির ক্ষতি হতে পারে।
তিনি বলেন, বিদ্যমান জিএসপি সুবিধা যাতে বাতিল না হয় এবং উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পরও যাতে তিনবছর এ সুবিধা পাওয়া যায়, সেদিকে বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্য এফটিএ করবে, সেখানে বাংলাদেশের প্রতিযোগী সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে যাতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়- সেজন্য বাংলাদেশের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।