পরিবার থেকে শিশুদের বিচ্ছিন্ন, জোর করে জন্মনিয়ন্ত্রণ: গ্রিনল্যান্ডে ডেনমার্কের অন্ধকার ইতিহাস
১৯৫০-এর দশকের কথা। গ্রিনল্যান্ডের বিভিন্ন গ্রাম থেকে পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সি প্রায় ২০ জন ইনুইট শিশুকে তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোপেনহেগেনে পাঠানো হয় ড্যানিশ ভাষা শিখতে। তাদের স্রেফ ডেনমার্কের ভাষায় পারদর্শী করে তোলাই উদ্দেশ্য ছিল না। আসল উদ্দেশ্য ছিল একটি ক্ষুদ্র, দক্ষ অভিজাত গোষ্ঠী তৈরি করা, যারা গ্রিনল্যান্ডকে আধুনিকতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। সবচেয়ে মেধাবী ও সম্ভাবনাময় শিশুদেরই বেছে নেওয়া হয়েছিল এই প্রকল্পের জন্য।
ডেনমার্কে দুই বছর কাটায় তারা। গ্রিনল্যান্ডে ফেরার পর দেখা গেল, এই শিশুদের অনেকেই মাতৃভাষা ভুলে গেছে; ভাষা ভুলে তারা বাবা-মায়ের সঙ্গেও কথা বলতে পারছে না। দেশে ফিরলেও তারা কিন্তু নিজ গ্রামে ফেরেনি—তাদের পাঠানো হয় এক ধরনের অনাথাশ্রমে। সেখানে আরও কয়েক বছর 'পুনঃশিক্ষা' দেওয়া হয় তাদের।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শিশুদের অনেকেই পথচ্যুত হয়। কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, কেউ ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমে পড়ে নুকের বরফাচ্ছন্ন রাস্তায়—হয়ে পড়ে শেকড়চ্যুত ও লক্ষ্যহীন। বাকিরা ডেনিশদের নারী বিয়ে করে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন ওই ইনুইট শিশুদের মধ্যে জীবিত ছয়জনের সামনে দাঁড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চান। তারা তখন জীবনের শেষপ্রান্তে, বাকিরা আগেই প্রয়াত। ফ্রেডেরিকসেন বলেন, 'আপনাদের যা সহ্য করতে হয়েছে, তা ভয়াবহ। এটা ছিল অমানবিক, অন্যায় ও হৃদয়হীন।'
১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ড্যানিশ ডাক্তাররা হাজার হাজার ইনুইট নারী ও কিশোরীর জরায়ুতে ইন্ট্রাইউটেরাইন ডিভাইস (আইইউডি)—এক ধরনের গর্ভনিরোধক—স্থাপন করেন। অথচ এই তথ্য এসব নারী-কিশোরীদের কাউকেই জানানো হয়নি, অনুমতি নেওয়া তো দূরের কথা। আইইউডি স্থাপন করা এই নারীদের অনেকের বয়সই তখন মাত্র ১২।
বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, এই কাজের উদ্দেশ্য ছিল গ্রিনল্যান্ডের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানো, যাতে ডেনমার্কের ওপর অর্থনৈতিক চাপ না বাড়ে। এই ঘটনা পরে 'স্পাইরাল কেস' নামে কুখ্যাত হয়ে যায় (আইইউডির সর্পিলাকার হওয়ায় সে অনুসারে এই নাম)। অনেক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, আইইউডি স্থাপনের প্রক্রিয়াতা ছিল অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। এই নারীদের অনেকে বছরের পর বছর এর কাজ না জেনেই শরীরে বয়ে বেড়িয়েছেন। তারা কখনও জানতেও পারেননি কেন সন্তান ধারণ করতে পারছেন না।
এই ঘটনার শিকার ঠিক কতজন নারী, তা আজও অজানা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ডের গবেষকদের নিয়ে একটি যৌথ কমিশন গঠন করা হয় এই ঘটনার তদন্ত করতে।
প্রত্যেক গ্রিনল্যান্ডবাসী এ দুটি ঘটনা জানে। ১৯৭০-এর দশকে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার পর উপকূলবর্তী গ্রামগুলোর মৎস্যজীবীদের প্রায় জোর করে শহরে স্থানান্তরিত করার ঘটনাও জানে তারা। নুক শহরের উপকণ্ঠে তাদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক বানানো হয়েছিল, যাতে মাছ ধরার কার্যক্রমকে আরও সংগঠিত ও কার্যকর করা যায়। কিন্তু হঠাৎ করে গ্রাম ছেড়ে শহরের নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে না পেরে অনেক ইনুইট মদে ডুবে যান কিংবা হতাশায় ভুগতে শুরু করেন।
গ্রিনল্যান্ড ও ডেনমার্কের সম্পর্কের ইতিহাসের পরতে পরতে রয়েছে জটিলতা। রেখে গেছে এমন ক্ষত, যা সহজে মুছে যাওয়ার নয়। ১৯৫৩ সালের আগে গ্রিনল্যান্ড ছিল ডেনমার্কের উপনিবেশ। এরপর অঞ্চলটি ডেনমার্কের একটি কাউন্টিতে পরিণত হয়। ১৯৭৯ সালে গ্রিনল্যান্ড স্বায়ত্তশাসন লাভ করে, ২০০৯ সালে আরও বেশি ক্ষমতা পায়। তবে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষাবিষয়ক সিদ্ধান্ত এখনও ডেনমার্কের হাতেই আছে।
এই ঐতিহাসিক ক্ষত আবারও উসকে ওঠে, যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি বলেন: নিরাপত্তার স্বার্থে গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকা দরকার এবং এ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ বা অর্থনৈতিক চাপও দেওয়া যেতে পারে। গ্রিনল্যান্ডবাসীরা এই বক্তব্যকে একদিকে হুমকি হিসেবে দেখেছে—আশঙ্কা করছে, তারা হয়তো ওয়াশিংটনের অধীনে চলে যাবে। আবার অন্যদিকে, ট্রাম্পের এই বক্তব্যকে সুযোগ হিসেবেও দেখেছে—এবার হয়তো তারা ডেনিশ শাসন থেকে মুক্ত হতে পারবে।
৪৮ বছর বয়সি ড্যানিশ সমাজবিজ্ঞানী রিক্কে ওস্টারগার্ড মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকে গ্রিনল্যান্ডে বসবাস করছেন। এখন তিনি ডেনিশ ও গ্রিনল্যান্ডবাসীদের সম্পর্ক নিয়ে ডক্টরাল থিসিস লিখছেন। এ সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ঝটপট জবাব দিলেন: 'এটা যুগপৎ ভালো এবং খারাপ।' এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, এখনও ডেনিশদের একাংশের মধ্যে ইনুইটদের এক ধরনের নিচু করে দেখার প্রবণতা রয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি দুটি ঘটনা তুলে ধরেন। 'ছোটবেলায় ক্লাসে আমাদের আলাদা আলাদা বসানো হতো। ডেনিশরা বসত একপাশে, গ্রিনল্যান্ডবাসীরা অন্যপাশে। এখন সেটা নেই। তবে এখন অনেক ড্যানিশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের ব্যয়বহুল বেসরকারি স্কুলে পাঠাচ্ছেন। এর মাধ্যমে আবার সেই বিভক্তিটা তৈরি হচ্ছে।'
'একসময় আইন ছিল, ডেনিশ সরকারি কর্মচারীরা গ্রিনল্যান্ডে কাজ করলে গ্রিনল্যান্ডে জন্ম নেওয়া মানুষদের চাইতে বেশি বেতন পাবেন। যদিও তারা একই কাজ করতেন। এই নিয়ম এখন আনুষ্ঠানিকভাবে উঠে গেছে, কিন্তু গোপনে এখনও চালু আছে।'
বেশিরভাগ গ্রিনল্যান্ডবাসী স্বাধীনতা চায়, অংশত অতীতে তাদের ওপর হওয়া অন্যায়গুলোর কারণে। তবে এই মুহূর্তে স্বাধীনতা চাওয়া মানুষের সংখ্যা খুব কম। কারণ গ্রিনল্যান্ডের সমাজকল্যাণ খাতে, বিশেষত স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করার জন্য ডেনমার্ক প্রতি বছর প্রায় ৬১৮ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়।
৫৭ হাজার জনসংখ্যার বিশাল এই দ্বীপটির (স্পেনের চেয়েও চারগুণ বড়) স্বাস্থ্যসেবা খাত লজিস্টিক্যাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সমগ্র দ্বীপে হাসপাতাল মাত্র একটি—নুকের শতাধিক শয্যাবিশিষ্ট রেইনা ইনগ্রিড হসপিটাল। এর বাইরে দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে আছে চারটি ছোট স্বাস্থ্যকেন্দ্র। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রোগীদের নুকে নিয়ে আসতে বিমান বা হালকা উড়োজাহাজ ব্যবহার করা হয়। আর যদি কারও অবস্থা গুরুতর হয়, তাহলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে আনা হয়।
নুকের হাসপাতাল যদি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব না হয়—হৃদরোগ, প্রসব জটিলতা, ক্যান্সার বা অন্যান্য গুরুতর অসুস্থতার ক্ষেত্রে—তাহলে তাদের পাঠানো হয় কোপেনহেগেনে। বাণিজ্যিক ফ্লাইট বা মেডিক্যাল ফ্লাইটে তাদের কোপেনহেগেনে পাঠানো হয়। সব ব্যবস্থা গ্রিনল্যান্ড করলেও চিকিৎসার পুরো ব্যয় বহন করে ডেনমার্ক। রোগীদের এক টাকাও খরচ করতে হয় না।
গ্রিনল্যান্ডবাসীদের এখনই স্বাধীনতা চাওয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগার অন্যতম কারণ এই সুবিধা। সম্প্রতি গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এবং ইনুইট আতাকিতিগিত-এর (ইনুইট পিপলস পার্টি) নেতা মুটে এগেদে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, স্বাধীনতার জন্য এখনও কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি।
গ্রিনল্যান্ডের মাটির তলায় রয়েছে তেল, গ্যাস, সোনা, লোহা এবং বিদ্যুৎচালিত গাড়ি ও উইন্ড টারবাইন তৈরির জন্য অপরিহার্য মূল্যবান বিরল খনিজের মজুত । এসব সম্পদ এখনও সেই মাত্রায় কাজে লাগানো হয়নি, যা ডেনমার্কের বার্ষিক অনুদানের বিকল্প হতে পারে। বর্তমানে গ্রিনল্যান্ডের ৯৫ শতাংশ রপ্তানি আয় আসে মাছ ধরার খাত থেকে, যা দেশটির প্রধান শিল্প।
গ্রিনল্যান্ড ফিশারমেনস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নিক্কুলাত জেরেমিয়াসেন বলেন, ডেনমার্ক প্রায়ই গ্রিনল্যান্ডের জেলে ও ক্রেতাদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। এতে মুনাফার একটি বড় অংশ ডেনমার্কে চলে যায়। গ্রিনল্যান্ড স্বাধীন হলে এই মুনাফা এখানেই থাকত।
তবে দৃশ্যপট দ্রুত বদলাচ্ছে। গত শুক্রবার সকাল ৮টায় নুকের শিশুরা যখন মাইনাস ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস শীতের মধ্যে গরম জামা পরে স্কুলে যাচ্ছিল, তখন মার্কিন বিনিয়োগকারী ও ট্রাম্প প্রশাসনের সাবেক আর্কটিক উপদেষ্টা টমাস ইমানুয়েল ড্যান্স শহরের কেন্দ্রস্থলের এক হোটেলে নাস্তা করছিলেন। কয়েকদিন গ্রিনল্যান্ডে কাটিয়ে খনি, মৎস্য ও পর্যটন শিল্প নিয়ে বৈঠক করেছেন তিনি। তিনি বলেছেন, 'এই দেশে অনেক কিছু করার আছে। অসংখ্য সুযোগ রয়েছে।'