‘সাপ্লাই চেইন বিপর্যয়, ৪০ ভাগ কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে সংকটে পোশাক শিল্প খাত’
চট্টগ্রামের বৃহৎ পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্লিফটন গ্রুপ। ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরুর পর প্রতিষ্ঠানটি নাসিরাবাদ, কালুরঘাট এবং ইপিজেড এলাকায় মোট ৯টি কারখানা গড়ে তুলে। শতভাগ রপ্তানিমুখী এই শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত আছে ১৬ হাজার শ্রমিক। এদের ৮০ ভাগ নারী। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টার্নওভার ১৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার।
ক্লিফটন গ্রুপ বর্তমানে বিশ্বখ্যাত জকি, টমি হিলফিগার, ন'টিকা, কলাম্বিয়া, টেড বেকার, স্যামস ক্লাব, ওয়ালমার্ট, কেনেথ কোল, হেমা, টার্গেট ইত্যাদি আন্তর্জাতিক ব্রান্ডের পণ্য উৎপাদন করছে।
এই শিল্প গ্রুপটির উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে কোন ধরনের ব্যাংক ঋণ ছাড়াই পরিচালিত হয় এর কার্যক্রম। সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে (সিএসআর) প্রতিবছর ব্যয় করে ২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩০ লাখ টাকা ব্যয় হয় শুধুমাত্র শ্রমিকদের কল্যাণে।
পারিবারিক ব্যবসায় গড়ে উঠা এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্বে আছেন এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। রপ্তানি ট্রফি অর্জনের পাশাপাশি প্রায় ২০ বছর ধরে সিআইপি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। বিজিএমইএ'র নতুন কমিটির পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।
করোনার সংকটকালীন এ সময় ক্লিফটন গ্রুপ কিভাবে মোকাবেলা করছে, এই দুর্যোগে কর্মীকল্যাণ এবং এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠানটির কি ভূমিকা ছিল এ নিয়ে টিবিএসের মুখোমুখি হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।
করোনাকালীন সময়ে আপনার প্রতিষ্ঠান কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে?
চীনে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সাপ্লাই চেইনে ব্যাঘাত ঘটে। ডিসেম্বর থেকেই আমাদের প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ৩০ ভাগ কমে যায়।
ফেব্রুয়ারির পর থেকে এক মাস উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। লকডাউন পরবর্তী ৫ মাসে ৪০ ভাগ ব্যবসা কমে যায়। সারা বিশ্বে প্রকোপের কারণে শিপমেন্ট পৌঁছাতে দেরি হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে করোনার দ্বিতীয় ধাপে সাপ্লাই চেইন পুনরায় বিঘ্নিত হয়েছে।
এর মধ্যে পোশাক শিল্পের কাঁচামাল বিশেষ করে কটনের দাম ৪০ ভাগ বেড়ে যায়। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে কন্টেইনার জটের কারণে সাপ্লাই ডিলে (দেরি) হয়। এর ফলে সমুদ্রপথে ৪০ ফুট সাইজের একটি কন্টেইনার পরিবহন ব্যয় ২২০০ ডলার থেকে বেড়ে ৫০০০ ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সল্টের চালান পরিবহন করতে অনীহা দেখা দিয়েছে শিপিং এজেন্সিগুলোর। পরবর্তী মৌসুমের অর্ডার প্লেস করতে না পারায় সংকট তৈরী হয়েছে। করোনার কারণে এ পর্যন্ত ক্লিফটন গ্রুপের ৫০ কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনতে হয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে অন্তত ৫ বছর।
এই সমস্যাগুলো কিভাবে মোকাবেলা করছেন?
ক্লিফটন গ্রুপ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজস্ব টাকায় ব্যবসা পরিচালনা করে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে বর্তমানে কিছুটা সংকট তৈরী হয়েছে। সংকট মোকাবেলায় সরকারী প্রণোদনার আওতায় ক্লিফটন গ্রুপ ৫০ কোটি টাকা গ্রহণ করেছে। তাছাড়া সাপ্লাই চেইন সংক্রান্ত সংকটগুলো একটি বিশেষ পরিস্থিতির কারণে সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে গার্মেন্টস শিল্প কি কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন ?
করোনাকালীন বিশ্বমন্দা পরিস্থিতির কারণে অর্ডার কমে যাওয়া গার্মেন্টস শিল্পের জন্য বড় ধরনের সংকট। তাছাড়া সাপ্লাই চেইন ভেঙ্গে পড়ায় সঠিক সময়ে পণ্য হাতে পাওয়া নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। অন্যদিকে বেড়েছে র' মেটেরিয়াল এবং পণ্য পরিবহন ব্যয়। বিদেশী ক্রেতারাও পণ্যের সঠিক মূল্য পরিশোধ করছেনা। নানামুখী সংকটের কারণে পোশাক শিল্প খাত বর্তমানে চরম অস্থিরতার মধ্যে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এই সংকট আরো প্রকট হবে।
এই সমস্যা সমাধানে কী উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন?
করোনার সংকট মোকাবেলায় সরকারী প্রণোদনা একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। তবে যেহেতু সংকট দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে পুনরায় প্রণোদনা প্রদান সময়ের দাবি। তাছাড়া আমদানি পণ্য খালাসে যে অনাকাঙ্খিত দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয় সেগুলো সমাধান করা গেলে পোশাক ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবে।
করোনাকালীন সময়ে কর্মীদের কল্যাণে আপনাদের উদ্যোগগুলো কি ?
করোনাকালীন এই সময়ে লোকসানের মুখে পড়েও আমরা কোন কর্মীকে ছাঁটাই করিনি। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে ক্লিফটন গ্রুপ কর্মীদের জন্য মাস্ক, পিপিই, স্যানিটাইজার, কর্মীদের পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান করেছে। কোন কর্মী অসুস্থ হলে আইসোলেশনে পাঠানোসহ প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে।
করোনা মোকাবেলায় কর্মীদের পাশাপাশি আর কী উদ্যোগ ছিল?
করোনাকালীন সময়ে ক্লিফটন গ্রুপ কর্মীদের পাশাপাশি চট্টগ্রাম জেলা এবং বিভিন্ন উপজেলায় সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সংগঠনসহ প্রান্তিক পর্যায়ে ৩০ লাখ পিস মাস্ক বিতরণ করেছে। মাস্ক বিতরণ খাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। এছাড়া করোনায় ফ্রন্টলাইনারদের জন্য ৫০০০ পিস পিপিই প্রদান করা হয়। করোনা মহামারিকালীন মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনের জন্য গড়ে উঠা মানবিক সংগঠন 'শেষ বিদায়ের বন্ধু' এবং 'সার্ভ ফর স্মাইল' এর মাধ্যমে অবদান রাখে ক্লিপটন গ্রুপ।
সিএসআর খাতে ক্লিফটন গ্রুপ বছরে কোন কোন খাতে কত টাকা ব্যয় করে?
সিএসআরের আওতায় শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে ক্লিফটন গ্রুপ প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয় করে। এর মধ্যে কর্মীদের পারিবারিক উৎসব, অসুস্থতাসহ বিভিন্ন সংকটে ক্লিফটন গ্রুপ বছরে খরচ করে প্রায় ৩০ লাখ টাকা।
সিএসআরের আওতায় ক্লিফটন গ্রুপ চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের আবুতোরাব এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছে একটি কলেজ। ক্লিফটন গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রফেসর এমডিএম কামাল উদ্দিন চৌধুরীর নামে প্রতিষ্ঠিত এমপিওভুক্ত এই কলেজে চালু আছে অনার্স কোর্স। মহিউদ্দিন চৌধুরীর পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত বজলুছ ছোবহান চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩৫০ জন শিক্ষার্থী বিনামূল্যে অধ্যয়ন করে। এসব শিক্ষার্থীর স্কুল ড্রেস, শিক্ষা উপকরণসহ সকল শিক্ষা ব্যয় নির্বাহ করে ক্লিফটন গ্রুপ।
ক্লিফটন গ্রুপের পরিচালনায় মিরসরাইয়ের দুর্গাপুর এলাকায় গড়ে উঠেছে একটি ইউপেস-ক্লিফটন-অপকা-টেকনিক্যাল স্কুল। দেশের বৃহৎ শিল্প এলাকা মিরসরাই ইকোনমিক জোনে দক্ষ শ্রমিক সরবরাহ করতে এই কারিগরি স্কুলের যাত্রা শুরু হয়।
এছাড়া সিএসআরের আওতায় ক্লিফটন গ্রুপ হেফজখানা, এতিমখানা পরিচালনা করছে। দাতব্য চিকিৎসালয়ে প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ জন রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা এবং ঔষধ প্রদান করা হয়। বিভিন্ন স্কুল কলেজ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, ক্লাব, লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে কাজ করে ক্লিফটন গ্রুপ। 'বজলুছ ছোবহান চৌধুরী ও হোসনে আরা স্মৃতি ট্রাস্ট' এর মাধ্যমে গরিব জনগোষ্ঠীকে বৃদ্ধ ভাতা, পঙ্গু ভাতা, বিধবা ভাতা প্রদান করা হয়। এছাড়া শিক্ষা বৃত্তি, বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ, শিক্ষামূলক প্রতিযোগিতা, উচ্চ শিক্ষার্থে সুদহীন শিক্ষা ঋণ চালু আছে এই ট্রাস্টের আওতায়। বিভিন্ন দুর্যোগে গৃহহারাদের পুনরায় গৃহ নির্মাণে আর্থিক সহযোগিতা এবং ঢেউটিন প্রদানসহ বিভিন্ন মানবিক কাজে এগিয়ে আসে ক্লিফটন গ্রুপ। লায়ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আইক্যাম্প, চোখের ছানি অপারেশনসহ বিভিন্ন মানবিক কাজে যুক্ত ক্লিফটন গ্রুপ।
বিজিএমইএ'র পরিচালক হিসেবে পোশাক শিল্প খাতের উন্নয়নে কি ভূমিকা রাখতে চান?
পোশাক শিল্প খাতে ব্যবসায়িক নীতির উন্নয়ন করে এই খাতের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সরকারের সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় তৈরীতে কাজ করবো। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে বন্দর, কাস্টমস হাউস, কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, সংশ্লিষ্ট শুল্ক বিভাগ, শিপিং লাইন্স প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সমন্বয় করে ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ভূমিকা রাখবো। পোশাক শিল্প মালিকরা যাতে অপ্রত্যাশিত সমস্যায় না পড়ে, গার্মেন্টস শ্রমিকরা যাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনার টিকা পায় সেই লক্ষ্যে কাজ করবো।
আমদানি রপ্তানিতে কি কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা?
এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী: তৈরী পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে ভয়াবহ কন্টেইনার জটের কারণে সময়মতো পণ্য ডেলিভারি পাওয়া যায় না। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আসার পর খালাস প্রক্রিয়ায় পণ্য পরীক্ষা, শুল্কায়নসহ নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আসার পরও কখন ডেলিভারি পাওয়া যাবে নেই নিশ্চয়তা থাকে না। এতে বিদেশী ক্রেতাদের নির্ধারিত সময়ে পণ্য পাঠাতে বিলম্ব হয়। অনেক সময় শিডিউল ঠিক রাখতে আকাশপথে পণ্য ডেলিভারি করতে হয়। তখন আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়।
চট্টগ্রামে গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান কেন কমে এসেছে?
অবকাঠামোগত সমস্যা চট্টগ্রামে গার্মেন্টসের সংখ্যা কমার অন্যতম কারণ। গত দুই দশক আগে চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট না থাকা, অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের স্বল্পতা, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নাজুক পরিস্থিতির কারণে বিদেশী ক্রেতারা চট্টগ্রাম বিমুখ ছিল। তাছাড়া পোশাক শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ার কারণেও চট্টগ্রাম পিছিয়ে যায়। এর ফলে ঢাকা এবং ঢাকার আশেপাশের এলাকায় ক্রমাগত গার্মেন্টস সংখ্যা বাড়তে থাকে। ক্রেতা সংকটের কারণে পিছিয়ে যায় চট্টগ্রামের গার্মেন্টস সেক্টর।
তবে চট্টগ্রামকে ঘিরে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে চট্টগ্রামের গার্মেন্টস সেক্টরে উন্নতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে মিরসরাই ইকোনমিক জোনে গার্মেন্টস পল্লী, চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, কর্ণফুলী টানেলসহ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রামের গার্মেন্টস শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
প্রতিবছর ঈদ এলে গার্মেন্টসে শ্রমিকদের বেতন বোনাস নিয়ে সমস্যা হয় কেন?
কোন মালিক শ্রমিকদের বেতন বোনাস পরিশোধ নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করতে চান না। রমজান মাসে উৎপাদন কমে যায়। অনেক শ্রমিক অর্জিত ছুটি না কটিয়ে তার টাকাও ঈদের সময় নিতে চায়। বেতন বোনাস ও শ্রমিকদের নানা সুবিধার টাকা একসাথে পরিশোধ করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এর ফলে একসাথে বেতন বোনাসের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে অর্থ সংকটে পড়তে হয় মালিকদের। কিছু গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়।
বিশ্বব্যাপী মন্দার কারণে বর্তমানে অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক। ব্যাংক ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধা এবং প্রণোদনার কারণে এবার রমজানের ঈদে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়া গেলেও পরবর্তী কোরবানির ঈদে সংকটে পড়বে পোশাক শিল্প মালিকরা।