সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেউলিয়া হয়েছে যে ৬ দেশ
কোনো দেশ যথাসময়ের মধ্যে তার ঋণ ও সুদ শোধ করতে না পারলে তখন তাকে দেউলিয়া হওয়া বলে।
ইউরোপ মহাদেশের প্রায় অর্ধেক দেশ, আফ্রিকার ৪০ শতাংশ দেশ আর এশিয়া মহাদেশের ৩০ শতাংশ দেশ গত দুইশ বছরে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে।
কোনো দেশের সরকার যদি দাতাদের ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয় তাহলে অনেক সময় তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নাও আসতে পারে।
বিশ্বের সার্বভৌম দেশগুলোর মধ্যে ইকুয়েডর সর্বাধিকবার নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। দেশটি এখন পর্যন্ত ১০ বার দেউলিয়া হওয়ার কথা জানিয়েছে।
একই সময়ে ব্রাজিল, মেক্সিকো, উরুগুয়ে, চিলি, কোস্টারিকা, স্পেন, ও রাশিয়া নয়বার নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে।
আড়াই বছরের মধ্যে আট বার দেউলিয়া হয়েছিল জার্মানি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাঁচবার, চীন ও যুক্তরাজ্য চারবার, ও জাপান দুইবার দেউলিয়া হওয়ার স্বাদ নিয়েছে।
আধুনিক যুগে রাশিয়া ১৯৯০-এর দশকের শেষভাগে ও ২০০১ সালে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। আর্জেন্টিনাও দেউলিয়া হওয়া দেশের তালিকায় রয়েছে।
আইসল্যান্ড
২০০৮ সালে ৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়ে আইসল্যান্ড দেউলিয়া হয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেওয়ার পরে বৈশ্বিক ঋণবাজারের অবস্থা শোচনীয় হলে এ পরিস্থিতির মুখে পড়ে দেশটি। ২০০৮ সালের মধ্যে দেশটির ব্যাংক ব্যবস্থায় জিডিপির চেয়ে ১০ গুণ বেশি ঋণ জমা হয়।
এ সময় আইসল্যান্ডের তিনটি বড় ব্যাংক আর্থিকভাবে ভেঙে পড়ে। এটি ব্যাংক ব্যবস্থার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পতন। এর ফলে আইসল্যান্ড মন্দার কবলে পড়ে। পরবর্তী দুবছরে দেশটির অর্থনীতি ১০ শতাংশ ছোট হয়ে যায়।
তবে অর্থনীতিতে এরকম ধাক্কার পরও তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় দেশটি। দেশটির বেকারত্বের হার চার শতাংশে স্থির থাকে এবং ২০১৪ সালের মধ্যে এর অর্থনীতি ২০০৮-এর আগের সময়কার অর্থনীতির তুলনায় এক শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
আর্জেন্টিনা
২০০১ সালে ১৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা। ডলারের বিপরীতে পেসো'র (আর্জেন্টিনার মুদ্রা) নির্ধারিত দাম বেঁধে দেওয়া, অনিয়ন্ত্রিত বেসরকারি ঋণ, ও অস্বাভাবিক দুর্নীতি দেশটিকে এরকম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিল।
২০০১ সালের মধ্যে দেশটিতে বেকারত্বের হার ২০ শতাংশের বেশিতে পৌঁছায়। আর্জেন্টিনা ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি দেশ হিসেবে পরিণত হয়েছিল।
রাশিয়া
রাশিয়া এ পর্যন্ত নয়বার দেউলিয়া হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে দেশটি ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়ে দেউলিয়া হয়। এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব ও তেলের চাহিদা পড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রাশিয়া তখন জাতীয় উৎপাদনশীলতায়ও পিছিয়ে গিয়েছিল।
এর ফলে সৃষ্ট রুবল সংকটের কারণে রাশিয়ার শেয়ারবাজার এর ৭৫ শতাংশ মূল্য হারায়। এতে করে শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগকারীরা সরে যাওয়ায় দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি ৮০ শতাংশ হয়।
১৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে ১০ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছিল রাশিয়া। বেকারত্ব ১৩ শতাংশে পৌঁছানোর কারণে ১৯৯৮ সালে রাশিয়ার অর্থনীতি ৫.৩ শতাংশ কমে গিয়েছিল।
মেক্সিকো
১৯৮২ সালে ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রাষ্ট্রীয় ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় লাতিন আমেরিকার আরেক দেশ মেক্সিকো। লুইস এশেভেরিয়া'র সরকারের অর্থনৈতিক বিস্তৃতিকরণের বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেওয়ার পর দেশটিতে রাষ্ট্রীয় ঋণের হার দ্রুতগতিতে বেড়ে যায়।
১৯৭০-এর দশকের শেষভাগে তেল-বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরও ক্রমবর্ধমান নেতিবাচক পরিস্থিতির কারণে, মেক্সিকান পেসো'র ৫০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়। এতে করে মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্র ও আইএমএফ-এর ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়।
পরবর্তী পাঁচ বছর মেক্সিকোর জিডিপি'র ১১ শতাংশ পতন ঘটে। এর ফলে সূচনা হয় লাতিন আমেরিকান ঋণ সংকটের। এ পরিস্থিতিতে লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের দেশগুলো তাদের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়। এতে করে আইএমএফ-কে বাধ্য হয়ে এ দেশগুলোতে তথাকথিত অর্থনৈতিক সংস্কারের বিনিময়ে ঋণ দিতে হয়।
লেবানন
২০১৯ সালের শেষদিকে লেবাননের সরকার নতুন প্রস্তাবিত করের ঘোষণা দিলে দেশটিতে সংকট শুরু হয়। এসব করের মধ্যে ছিল হোয়াটসঅ্যাপ ভয়েস কল সুবিধা ব্যবহার করার জন্য মাসিক ছয় ডলার ফি।
এ ঘোষণার ফলে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে আগে থেকেই জমে থাকা ক্ষোভ বিক্ষোভে পরিণত হয়। দেশটির জনগণ প্রতিবাদ শুরু করে। সরকার পুঁজির অনিয়মিত নিয়ন্ত্রণ চালু করে, এতে করে নিজেদের সঞ্চয় হারাতে শুরু করেন লেবানিজ জনগণ।
২০২০ সালে তখনকার হিসেবে ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের ঋণখেলাপি ঘোষণা করে দেশটি। এ অংক ছিল দেশটির জিডিপির ১৭০ শতাংশ। ২০২১ সালে জুন মাসে লেবাননের মুদ্রার প্রায় ৯০ শতাংশ দরপতন ঘটে। ওই সময় বিশ্ব ব্যাংক জানায়, লেবাননের এ অর্থনৈতিক সংকট গত ১৫০ বছরে বিশ্বের দেখা সবচেয়ে তীব্র সংকটগুলোর একটি।
২০২০ সালের এপ্রিল মাসে লেবাননের তৎকালীন সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী সাদেহ আল-শামি রাষ্ট্র ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেউলিয়াত্ব ঘোষণা করেন।
শ্রীলঙ্কা
বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় সর্বশেষ দেশ হিসেবে দেউলিয়া হলো শ্রীলঙ্কা। দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহে মঙ্গলবার (৫ জুলাই) দেউলিয়াত্ব স্বীকার করে নিয়ে সংসদকে জানিয়েছেন, দেশটির এই নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকট অন্তত আগামী বছরের শেষ পর্যন্ত চলবে।
এর আগে এ বছরেরে এপ্রিলে দেশটির সরকার জানিয়েছিল, ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে না পারায় দেশটি দেউলিয়াত্ব ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এ সময় আরও জানানো হয়, সম্ভাব্য বেইলআউট প্যাকেজের জন্য দেশটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে।