৯ মাসে ব্যাংক খাতে খেলাপী ঋণ বেড়েছে ৩১ হাজার কোটি টাকা
দেশ এখনো করোনা মহামারির ক্ষতি ঠিকমতো পুষিয়ে উঠতে পারেনি। এর মধ্যেই সারা বিশ্ব যেখানে মন্দার আশঙ্কা করছে, সেখানে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও গত ৯ মাসে ৩১ হাজার ১২২ কোটি টাকা বেড়েছে খেলাপী ঋণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশে মোট বিতরণ করা ঋণ রয়েছে ১৪.৩৬ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপী ঋণ ১.৩৪ লাখ কোটি টাকা। জুন শেষে এই খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ১.২৫ লাখ কোটি টাকা।
অর্থাৎ, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে ব্যাংক খাতে খেলাপী ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা, যেটি মোট বিতরণ করা ঋণের ৯.৩৬%।
এর আগে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১১ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৮.৯৬%।
সে হিসাবে মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপী ঋণের অংশও বেড়েছে আগের প্রান্তিকের তুলনায় ৪০ বেসিস পয়েন্ট। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণ আছে ৬০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৩.০৪%। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণ মোট ঋণের ৬.২০% বা ৬৬,৬৯৬ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে ৪,২৭৮ কোটি টাকা বা ১১.৮০%। বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণের এই হার ৪.৭৭%।
করোনার কারণে ব্যাংকঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে যে ছাড় দেওয়া হয়েছিল, তা তুলে নেওয়ার পর ধাপে ধাপে এখন খেলাপি ঋণ বাড়তে শুরু করেছে।
জুলাইয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হওয়ার পর, বাংলাদেশ ব্যাংক তার শিডিউলিং পলিসি সংশোধন করে, ডাউন পেমেন্টে ছাড় দেয়।
একই সময়ে, ঋণগ্রহীতাদের দীর্ঘ ২৯ বছর পর্যন্ত তাদের ঋণ পুনঃতফসিল করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
গত ১৮ জুলাই ইস্যুকৃত নতুন সার্কুলার অনুযায়ী, খেলাপিদের তাদের আউটস্ট্যান্ডিং ওভারডিউয়ের সর্বনিম্ন ২.৫% এবং সর্বোচ্চ ৪.৫% ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করার অনুমতি দেয়া হয়।
আগে প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট ছিল সর্বনিম্ন ১০%-৩০%; কিন্তু খেলাপিরা বিশেষ বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ছাড় নিতো।
এছাড়াও আগে ব্যাংকগুলো খেলাপিদের সর্বোচ্চ তিনবার ঋণ পুনঃতফসিল করার অনুমতি দিত, তবে এখন তারা চারবার সুযোগ পাবে।
সেইসঙ্গে, নতুন নীতিমালায় খেলাপি ঋণের সুবিধা প্রদান ও পুনঃতফসিলের ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে এখন ব্যাংকমালিকেরাই ঠিক করছেন, কোন ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা পাবে। আগে ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে সেই দায়দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। খেলাপী ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ছাড়ের পরও কমছে না খেলাপী ঋণ।
এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি ও সিইও সেলিম আরএফ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে দেশের অর্থনৈতিক খাত সার্বিকভাবে চাপে আছে, এর একটা প্রভাব তো পড়বেই বিভিন্ন খাতে।"
তিনি বলেন, "মূল্যস্ফীতি বাড়ার প্রভাব সবার উপরেই পড়বে। সেইসঙ্গে ফ্যাক্টরিগুলো জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদনে প্রভাব পড়ছে। তবে আমাদের ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের যে অভাব রয়েছে, গত পাঁচ-ছয় বছরে এর কোনো উন্নতি হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।"
বড় অঙ্কের ঋণগুলোই বেশি খেলাপী হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "ব্র্যাক ব্যাংকের ৫০% লোনই সিএমএসএমই খাতে। আমরা কিন্তু কোনো সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি না। করোনা মহামারীর ক্ষতি আমরা এখন অনেকটাই পুষিয়ে উঠেছি। সরকারও অনেক ধরণের প্রণোদনা ও সুবিধা দিয়েছে। প্রফিট মার্জিন কমলেও যারা ভালো গ্রাহক তারা এর মধ্যেও তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারছে। তবে, দেখেছি বড় অঙ্কের ঋণ যারা নিচ্ছেন, মূল ঝামেলাটা তারাই করেন। অনেক বড় বড় উদ্যোক্তাদের মন-মানসিকতাই হয়ে গেছে লোন ফেরত না দেওয়ার। তাদের অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপী হচ্ছেন।"
"এসব খেলাপী গ্রাহকদের ব্যাপারে আমাদের আরো কঠিন হতে হবে। সেইসঙ্গে আমাদের আইনি ব্যবস্থা যদি আরেকটু সহায়ক হতো, তাহলে হয়তো এই খাতটা আরেকটু ভালো থাকতো।"
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বরের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে পেমেন্ট ডিফারেল রেখেছিল তা ব্যাংকগুলোকে বছরজুড়ে ৫,৬০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কমাতে সাহায্য করেছিল।
সে বছরের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকায় নেমে আসে, যা মোট ঋণের ৭.৬৬% এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।
তবে পেমেন্ট ডিফারেল সুবিধাটি গত বছরের শুরু থেকে আংশিকভাবে তুলে নেওয়া হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রচুর বাড়ে; গত বছরের সেপ্টেম্বরে এটি ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।