ব্যাংকের কাছে রেস্তোরাঁ মালিকের দেনা ২৩৪ কোটি টাকা, এখন নিজেকেই ভিকটিম দাবি করছেন
২০১৫ সালে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের (এফএসআইবি) চকবাজার শাখা থেকে ১২ কোটি টাকা কৃষি ঋণ নেয় চট্টগ্রাম-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নীলিমা নীল এগ্রো লিমিটেড।
পরে জানা যায়, চট্টগ্রাম শহরের 'লা এরিস্টোক্রেসি' নামের একটি দামি রেস্তোরাঁর স্টোর কিপার মুজিবুর রহমানকে চেয়ারম্যান এবং রেস্তোরাঁর মালিকের ঘনিষ্ঠ একজন নারীকে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তাঁদের অজ্ঞাতেই সই জাল করে নেওয়া হয় ঋণ।
রেস্তোরাঁর মালিক নাজমে নওরোজ একই কৌশলের মাধ্যমে ব্যাংকের এক নারী পিয়ন ও তার স্বামীর নামে একই ব্যাংক থেকে নওরোজ এন্টারপ্রাইজ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য আরও ঋণ নেন।
বর্তমানে এফএসআইবির তিনটি শাখা নাজমে নওরোজের কাছে ২৩৪ কোটি টাকা পাবে।
২০০৮ সালে চট্টগ্রাম নগরীর এসএস খালেদ রোডের সিপিডিএল ভবনে 'লা এরিস্টোক্রেসি' নামে পার্টনারশিপে রেস্তোরাঁ ব্যবসা শুরু করেন নাজমে নওরোজ। তিনবার ঠিকানা বদলানোর পরে চলতি বছরেই বন্ধ হয়েছে রেস্তোরাঁটি, ব্যাংকের কাছে যেটির দেনা ১১৬ কোটি টাকা।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের দেখা নথিপত্র অনুসারে, ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে রাখা জামানতের মূল্য মাত্র ১২ কোটি টাকা, ফলে এই ঋণ আদায় নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ফাস্ট ফুড থেকে শুরু করে কৃষি নানান খাতে ব্যবসা রয়েছে নাজমে নওরোজের — গোপন অংশীদারদের নিয়ে নীলিমা নীল এগ্রো লিমিটেড ও নওরোজ এন্টারপ্রাইজের মতো আরও উদ্যোগে পা বাড়ান তিনি, যেখানে অর্থায়নকারী হিসেবে পেয়ে যান ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে (এফএসআইবি)।
নওরোজ এন্টারপ্রাইজের কাছে ব্যাংকের বর্তমান পাওনা ৯০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং নীলিমায় নীল এগ্রোর কাছে ২৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
ঋণগুলো নেওয়াও হয় খুবই কৌশলে— যেখানে জাল সইয়ের মাধ্যমে অংশীদারদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এরপরে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করতে তাঁদের তাদের স্থলে অন্যদের (অংশীদার বা পরিচালক হিসেবে) আনা হয় বলে নথিপত্রে দেখা গেছে।
ঋণের বিপরীতে তিনি যেসব চেক জমা দেন সেগুলোও যখন ডিজঅনার হয়, তখন নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট (এনআই অ্যাক্ট) আইনের আওতায় তার বিরুদ্ধে বেশকিছু মামলা দায়ের করেছে এফএসআইবি। চট্টগ্রামের মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে ব্যাংকটির প্রবর্ত্তক মোড় শাখার এমন একটি মামলার নথিতে ২ কোটি টাকার একটি চেকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেটি ইস্যু করেছিল 'লা এরিস্টোক্রেসি' — যার একমাত্র মালিক নাজমে নওরোজ। ব্যাংকে যথেষ্ট টাকা না থাকায় গত বছরের ৩ আগস্ট ডিজঅনার করা হয় এই চেক।
এ ধরনের এক ডজনের বেশি চেক ডিজঅনার বা প্রত্যাখানের মামলার মুখে এখন নিজেকে-ই ভিকটিম বলে দাবি করছেন নাজমে নওরোজ। তার অভিযোগ, তাঁকে ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া হয়, এবং চট্টগ্রামের একজন শীর্ষ ব্যবসায়ীর 'নিকট আত্মীয়েরা'-ও এই ঋণের সুবিধাভোগী ছিলেন, কিন্তু ঋণের দায় একা তার ওপর চাপানো হয়েছে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, লা এরিস্টোক্রেসির কর্ণধার নাজমে নওরোজের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ১৫ টি চেক ডিজনার মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় আদালতের সমন জারির পর জামিনে রয়েছেন নওরোজ।
এসব ঋণ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট তিন শাখার ব্যবস্থাপক।
তবে এফএসইবির চট্টগ্রামের জোনাল হেড (নর্থ) মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান স্বীকার করে বলেন যে, 'এসব ঋণের শুরু থেকে শেষ পর্য়ন্ত যথেষ্ট অনিয়ম হয়েছে। অনিয়মগুলো চিহ্নিত করে আমরা প্রধান কার্য়ালয়কে জানিয়েছি এবং আইনগত পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছি।'
লা এরিস্টোক্রেসির নেপথ্যে
২০০৮ সালে পার্টনারশিপে চট্টগ্রামের এসএস খালেদ রোডের সিপিডিএল ভবনে লা এরিস্টোক্রেসি চালু করে নাজমে নওরোজ।
ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, ২০১১ সালে বাকি দু'জন পার্টনার তাদের অংশীদারত্ব ছেড়ে দিলে তা কিনতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের মহিলা শাখা থেকে ২ কোটি টাকা ঋণ নেন এই উদ্যোক্তা।
এরপর রেস্তোরাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণের কারণ উল্লেখ করে কালক্রমে আরও ঋণ নিয়েছেন।
এভাবে কয়েক দফায় ঋণ নেওয়ার পরে ২০১৯ সালে এসে 'লা এরিস্টোক্রেসি'র ঋণ দাঁড়ায় ৫৯ কোটি টাকায়, যা বর্তমানে সুদসহ বেড়ে হয়েছে ১১৬ কোটি টাকা।
নথিপত্র অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির নামে অনুমোদিত ঋণ সীমা মাত্র দেড় কোটি টাকা হওয়ার পরেও এই বিপুল ঋণ পেয়েছে।
এই ঋণের বিপরীতে ৯ কোটি টাকার ১৯৯ শতক জমি জামানত হিসেবে রয়েছে। যার প্রকৃত মূল্য আরো অনেক কম বলে পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন ঋণগ্রহীতা নাজমে নওরোজ নিজেই।
দীর্ঘদিন এস এস খালেদ রোডের সিপিডিএল ভবনে থাকার পর ২০২০ সালে লা এরিস্টোক্রেসি স্থানান্তর হয় একই সড়কের কর্ণফুলী টাওয়ারে। ২০২১ সালে আবার স্থানান্তর হয় আগ্রাবাদ এলাকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার সড়কে। তবে চলতি বছরের মার্চ থেকে 'লা এরিস্টোক্রেসি' সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।
মালিকানায় যত কৌশল
২০১৪ সালে এফএসআইবির প্রবর্ত্তক শাখা থেকে ৪৩ কোটি টাকা ঋণ নেয় নওরোজ এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড। ঋণ নেয়ার সময় ব্যাংকের ওপর ব্যাপক প্রভাব থাকা এক ব্যবসায়ীর দুজন আত্মীয়কে নাজমে নওরোজ তার প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে উল্লেখ করেন। ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে জানতে নাজমে নওরোজের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিজেই তা দাবি করেছেন।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালে এ দুই আত্মীয়কে বাদ দিয়ে তাদের স্থলে নওরোজ এন্টারপ্রাইজের পরিচালক করা হয় ফার্স্ট সিকিউরিটি মহিলা ব্রাঞ্চের তৎকালীন এক নারী পিয়ন ও তাঁর স্বামীকে।
প্রতিষ্ঠানটির কাছে সুদাসলে প্রবর্তক শাখার বর্তমান পাওনা ৯০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এই ঋণের বিপরীতে একটি ফ্ল্যাট ও একটি জমি বন্ধক রয়েছে। যার সর্বোচ্চ মূল্য ২ কোটি টাকা হতে পারে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে নীলিমা নীল এগ্রোর কাছে এফএসআইবির পাওনা ২৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এই ঋণের বিপরীতে ৪০০ শতক কৃষিজমি জামানত রয়েছে। যার প্রকৃত মূল্য সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকার বেশি হবে না। এই প্রতিষ্ঠানেও স্বাক্ষর জালিয়াতির ঘটনা ঘটে বলে স্বীকার করেন নাজমে নওরোজ।
পাহাড়ি জমি কিনে কৃষি ঋণ নিতে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও — বান্দরবান থেকে জন্মসনদ সংগ্রহ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে নওরোজের বিরুদ্ধে।