এলডিসি পরবর্তী পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলায় বিভিন্ন সুপারিশ সিনিয়র সচিবদের
বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ ও পণ্য বৈচিত্র্য বাড়ানোর প্রয়োজনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন সরকারের জ্যেষ্ঠ সচিবরা।
বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) রাজধানীর প্যান-প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত 'ন্যাশনাল সেমিনার অন এলডিসি গ্রাজুয়েশন' শীর্ষক আয়োজনে যোগ দিয়ে তারা এই তাগিদ দেন। জ্যেষ্ঠ সচিবরা অবকাঠামো ঘাটতি পূরণ, ব্যবসায় প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং রপ্তানি-বান্ধব নীতি গ্রহণের বিভিন্ন সুপারিশও করেন।
সেমিনারের একটি সেশনে সভাপতিত্বকালে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, আমাদের রপ্তানি পণ্য সংখ্যা বাড়াতে হবে। এজন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। একইসঙ্গে, এলডিসি থেকে উত্তরণ যাতে নির্বিঘ্ন হয় সেজন্য রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, 'তৈরি পোশাক (আরএমজি) রপ্তানি বৃদ্ধির অনেক সুযোগ রয়েছে। আমাদের এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। তবে একটি পণ্যের ওপর রপ্তানি খাতকে ধরে রাখা ঠিক হবে না'।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে টিপু মুনশি আরও বলেন, বাণিজ্যের বিভিন্ন সুবিধা আদায়ে সরকার বিভিন্ন দেশের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) সইয়ের চেষ্টা করছে।
সেমিনারের দ্বিতীয় সেশনের বিষয়ের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। তিনি বিনিয়োগের মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন। এরমধ্যে আছে- অবকাঠামো ঘাটতি এবং আর্থিক বাজারের বর্তমান অস্থিতিশীলতার মতো বিষয়।
এলডিসি গ্রাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়- অর্থনৈতিক অঞ্চল, বন্দর , রেল ও সড়কের - ইন্টারমোডাল সংযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের সুপারিশ করেন তিনি। একইসঙ্গে পুঁজিবাজার শক্তিশালী করার ওপরও জোর দেন।
কুটির শিল্পসহ ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি আকারের উদ্যোগগুলিকে রপ্তানি বাজারের সুবিধা দিতে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন তিনি। একইসঙ্গে, রপ্তানি পণ্য বৈচিত্র্যকরণের তাগিদ দেন।
তোফাজ্জল মিয়া উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের ৫৮% রপ্তানি ইউরোপীয় বাজারে। ১৪% যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। কানাডা, জাপান, অষ্ট্রেলিয়া, চীন ও ভারতের বাজারেও আমাদের প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু, আমরা তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না।
'বর্তমানে আমরা কোনো শুল্ক দেই না। কিন্তু, এলিডিসি থেকে গ্রাজুয়েশন হলে- আমরা ইউরোপের বাজারে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা হারাব। তখন আমাদের রপ্তানির জন্য সাড়ে ৯ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে'।
'এছাড়া কানাডার বাজারে পণ্য রপ্তানির জন্য ১৭%, চীনের জন্য ১৬.২%, ভারতের জন্য ৮.৬% এবং জাপানের বাজারে ৮.৭% শুল্ক দিতে হবে'- যোগ করেন তিনি।
তোফাজ্জল মিয়া আরও বলেন, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সূচকে ভারত ও ভিয়েতনামের মতো প্রতিযোগী দেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এজন্য প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়েও মনোযোগ দিতে হবে।
সেমিনারে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ২০২৩ সালের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি প্লাস এবং অনুকূল 'রুলস অভ অরিজিন' সুবিধা পাওয়ার একটি কার্যকর ব্যবস্থা তৈরির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে।
অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে তিনি মেধাসত্ত্ব সম্পদ অধিকার (ট্রিপস) চুক্তির আওতায়– বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে ছাড়ের সুযোগ হারানোর দিকটি উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে, পর্যায়ক্রমে রপ্তানিতে দেওয়া ভর্তুকি, প্রনোদণা প্রত্যাহার এবং আমদানি শুল্ক যৌক্তিকীরণের ওপর আলোকপাত করেন।
স্থানীয় প্রতিকূলতা নিরসনের উপায়
বৃহস্পতিবারের সেমিনারে দেশের অভ্যন্তরীন চ্যালেঞ্জগুলোও আলোচিত হয়েছে। এগুলি সমাধানে দেওয়া হয় নানান সুপারিশ।
বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেছেন, স্থানীয় সম্পদ কাজে লাগানোর পাশাপাশি প্রতিযোগী সক্ষমতা বৃদ্ধি, দক্ষতা ঘাটতি পূরণ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নও অপরিহার্য।
উদ্বোধনী সেশনের বক্তৃতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বেশি হচ্ছে– তাই ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আর থাকবে না।
সেমিনারে এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, এসএমই (ছোট ও মধ্যম আকারের উদ্যোগ) খাতের পণ্য রপ্তানি বাড়াতে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা দেওয়ার কথা এখন আলোচনা হচ্ছে। এটি কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে না দিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কিছু কিছু কোম্পানিকে সরকার বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। রপ্তানি বাড়াতে এই ধরনের সুযোগ একক কোনো কোম্পানিকে না দিয়ে- খাতভিত্তিক দিতে হবে।
ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ সীমিত রপ্তানি পণ্য ও নির্দিষ্ট বাজারের মধ্যে আটকে আছে।
গত ৫ বছরের (২০১৭-২১) রপ্তানি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আরএমজির বাইরে চামড়াজাত পণ্য আসবাবপত্র, ফুটওয়্যার রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাড়ছে। ফলে এ ধরনের সম্ভাবনাময় পণ্যে মনোযোগ দিতে হবে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আরএমজির ক্ষেত্রে ম্যান-মেইড ফাইবারের তৈরি পণ্যে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ বিশ্বব্যাপী এর চাহিদা বাড়ছে। তা নাহলে আমরা প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পড়ব।
প্রধান অতিথি হিসেবে সেশনে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। সেশনে মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস।
প্রয়োজন শুল্ক যৌক্তিকীকরণ
অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন জানান, আয়করের জন্য নতুন একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। রাজস্ব আদায় বাড়াতে এটি আগামী অর্থবছরের মধ্যে চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এজন্য বর্তমানে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলির সঙ্গে আলোচনার পরিকল্পনা করছে।
তিনি বলেন, ভ্যাট (মূসক) আদায় বাড়াতে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসের বিস্তার বাড়াচ্ছে এনবিআর। রাজস্ব লিকেজ বন্ধে বন্ড অটোমেশনের কাজও জোরালো করেছে। এর পাশাপাশি আমদানি পর্যায়ে কাস্টমস (আবগারি) ও অন্যান্য শুল্ক যৌক্তিকীকরণেরও বিভিন্ন প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে– যাতে স্থানীয় শিল্পগুলো বিরূপভাবে প্রভাবিত না হয়।
এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর বাংলাদেশ আর নগদ প্রণোদনা দিতে পারবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ধরনের সহায়তা রপ্তানি আয় কমায় না।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, সরকারি ও বেসরকারি খাতের আরও বেশি বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। এনবিআর রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে, তবে করদাতাদের মধ্যেও উৎসাহ থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশন পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা এবং উন্নয়ন চাহিদা মেটাতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ অতি-গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে করছাড় আরও শিল্পায়নের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাই এদিকেও নজর দিতে হবে।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
সেমিনারে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম-ও যোগ দেন। তিনি বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর বাংলাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে সেতুবন্ধন হয়ে উঠতে পারে।
সেমিনারের সমাপনী সেশনে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গুয়েইন লুইস বলেন, এলডিসি থেকে নির্বিঘ্নে উত্তরণে একটি সুপরিকল্পিত, পরামর্শবান্ধব, সময়নিষ্ঠ, কর্মমুখী ও বাস্তবায়নযোগ্য কৌশল থাকা অপরিহার্য।
জাতিসংঘ নির্ধারিত পাঁচ বছরের প্রস্তুতিমূলক মেয়াদের শেষে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে মধ্য আয়ের দেশে বাংলাদেশের উত্তরণের প্রত্যাশা করা হচ্ছে।